আফগানিস্তান: ৫০ ওভারে ২৯১/৫
অস্ট্রেলিয়া: ৪৬.৫ ওভারে ২৯৩/৭
ফল: অস্ট্রেলিয়া ৩ উইকেটে জয়ী
অবিশ্বাস্য, অতিমানবীয়, অকল্পনীয়—এ শব্দগুলোকে বিশেষণ হিসেবে খুব হালকা মনে হয়েছে কখনো? মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে আফগানিস্তানের বিপক্ষে গ্লেন ম্যাক্সওয়েলের ১২৮ বলে ২০১ রানের অপরাজিত ইনিংস দেখার পর অমন অনুভূতিই হওয়ার কথা। যে ইনিংসে রেকর্ড ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে, ব্যাটসম্যানের ফুটওয়ার্ক বা পায়ের কাজ চলে গেছে অভিধানের বাইরে, অবিশ্বাস্য কাজকারবার যখন হয়ে পড়েছে হাস্যকর রকমের সহজলভ্য, অকল্পনীয় সব ব্যাপার ঘটেছে অবলীলায়! একটা সময় গিয়ে এমন মনে হয়েছে, মাঠে যেন খেলছেন ম্যাক্সওয়েল একাই, বাকি সবাই শুধু চেয়ে চেয়ে দেখছেন!
৯১ রানে ৭ উইকেট পড়ে যাওয়ার পর ওয়াংখেড়ের পাশে আরব সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছিল অস্ট্রেলিয়ার এ ম্যাচে জয়ের সম্ভাবনা, অঘটন শব্দটাকে আরেকবার সস্তা বানিয়ে ফেলার ইঙ্গিত দিচ্ছিল আফগানিস্তান। ছয় নম্বরে আসা ম্যাক্সওয়েলকে তো নেমেই সামলাতে হয়েছে হ্যাটট্রিক বল, যিনি আগের ম্যাচে ছিলেন না অদ্ভুতভাবে কনকাশনে পড়ে! বিশ্বকাপে কোনো দলই পরে ব্যাটিং করে এত কম রানে এতগুলো উইকেট হারিয়ে এর আগে জেতেনি ম্যাচ। ম্যাক্সওয়েল সেখান থেকে প্যাট কামিন্সের সঙ্গে অবিচ্ছিন্ন অষ্টম উইকেট জুটিতে যোগ করেছেন ওয়ানডেতে রেকর্ড ২০২ রান, যেখানে অস্ট্রেলিয়া অধিনায়কের অবদান ৬৮ বলে ১২ রান!
শতকের পরপরই পায়ে ক্র্যাম্প নিয়ে খেলেছেন ম্যাক্সওয়েল, সিঙ্গেল নেওয়া দূরে থাক, শট খেলছিলেন পা না নড়িয়েই! দশম ব্যাটসম্যান অ্যাডাম জাম্পা একাধিকবার ওয়াংখেড়ের ড্রেসিংরুমের সিঁড়ি থেকে নেমে এসেছিলেন নামবেন বলে, কিন্তু ম্যাক্সওয়েল উঠে যাননি। তাঁর বিপক্ষে প্রথম বলে এলবিডব্লুর রিভিউ নিয়েছিল আফগানিস্তান, আদতে যেটি লেগেছিল তাঁর ব্যাটে। ২৬ রানে তাঁর মোটামুটি কঠিন ক্যাচ ফেলেন হাশমতউল্লাহ শহীদি, ৩৩ রানে সহজতম ক্যাচ নিতে পারেননি মুজিব উর রেহমান, তার আগে ৩০ রানে এলবিডব্লু হয়ে হাঁটা ধরেছিলেন রিভিউ করার পরও! তবে সে দফা বেঁচে যান, ম্যাক্সওয়েল ভাগ্যের সহায়তা পেয়েছেন ভালোভাবেই। কিন্তু এ রাতে ম্যাক্সওয়েল আসলে ভাগ্যকে বশ করেছিলেন। তাঁর ওপর যেন ভর করেছিল কিছু।
৫১ বলে করেছিলেন ৫০ রান, পরের ৫০ করতে লাগে মাত্র ২৫ বল। পরের ১০০ রান তিনি করেছেন মাত্র ৫২ বলে। তবে এ পরিসংখ্যান আদতে বোঝাতে পারবে না, বলের পর বল সিঙ্গেল নেননি তিনি, আদতে পা-ই নড়াতে পারছিলেন না। তবু খেলেছেন অদ্ভুত সব শট, তাঁর কবজি হয়ে উঠেছিল খ্যাপাটে! কখনোবা গুটি গুটি পায়ে সিঙ্গেল পূর্ণ করেই করেছেন উদ্যাপন! একসময় অস্ট্রেলিয়ার ড্রেসিংরুমে হতাশা ছিল স্পষ্ট, এরপর সেটি রূপ নিয়েছে স্কুলছাত্রদের কোনো ক্লাসরুমে, যখন শিক্ষক থাকেন না! অথচ তখনো অস্ট্রেলিয়া জয় থেকে বেশ খানিকটা দূরে। কিন্তু ম্যাক্সওয়েলের ইনিংস এমনভাবে এগোচ্ছিল, সেটি ঠিক উপভোগ করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। আফগানদের শরীরী ভাষাও বলছিল, খানিকটা বিমোহিত হয়ে গেছেন তাঁরাও!
অনেকক্ষণ থেকেই ব্যাপারটি ছিল আফগানিস্তান বনাম ম্যাক্সওয়েল, একটু পর সেটি রূপ নেয় ম্যাক্সওয়েল বনাম মাংসপেশির টানে। আফগানরা জানতেন, জয় থেকে ১ উইকেট দূরে দাঁড়িয়ে তাঁরা। কিন্তু ফ্লাডলাইটের আলোয় ওয়াংখেড়ের উইকেট থেকে বিষাক্ত মুভমেন্ট আদায় করা নাভিন-উল-হক, হঠাৎ সুইংয়ের রাজা হয়ে হ্যাটট্রিকের সামনে দাঁড়িয়ে যাওয়া আজমতউল্লাহ ওমরজাই, রহস্য স্পিনার মুজিব উর রেহমান, ডানহাতি রিস্ট স্পিনার রশিদ খান বা বাঁহাতি রিস্ট স্পিনার নূর আহমেদ, ব্রেকথ্রু বিশেষজ্ঞ অফ স্পিনার মোহাম্মদ নবী—কেউই এনে দিতে পারেননি সেই উইকেটটা।
শেষ ২৪ বলে অস্ট্রেলিয়ার দরকার ছিল ২১ রান, মুজিবের করা ৪৭তম ওভারের প্রথম বল ডট দিয়েছিলেন ম্যাক্সওয়েল। এরপর—ছক্কা, ছক্কা, চার, ছক্কা। যার মধ্যে শেষটিতে ম্যাক্সওয়েল প্রথম অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটসম্যান ও রানতাড়ায় প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে পেয়েছেন দ্বিশতক। ওয়ানডেতে ছয় বা এর নিচে নেমে খেলা সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত স্কোর এত দিন ছিল ১৯৮৩ বিশ্বকাপে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে কপিল দেবের ওই ১৭৫ রান, ম্যাক্সওয়েল সেটিকে সংখ্যায় ছাড়িয়ে গেছেন আরও আগেই। মুজিবকে মারা ওই ছক্কায় ইনিংসের মাহাত্ম্যে সেটিকে যদি ছাড়িয়ে না–ও যান, ছুঁয়ে তো ফেললেনই! কপিলের সেই ইনিংস টেলিভিশনে দেখানো হয়নি, ম্যাক্সওয়েল এ ইনিংস খেলেছেন যখন টেলিভিশন ছাড়িয়ে ইন্টারনেটেও লাইভ স্ট্রিমিং এখন অভ্যাস। যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা নিশ্চিতভাবেই মনে রাখবেন আজীবন। আর যাঁরা দেখেননি, তাঁরা বিমোহিত হবেন এর গল্পে!
অথচ দিনটি ছিল আফগানিস্তানের জন্য ঐতিহাসিক। এ দিনই যে বিশ্বকাপে প্রথম কোনো আফগান ব্যাটসম্যান পেয়েছেন শতকের দেখা! ইব্রাহিম জাদরানের ১২৯ রানের ওই ইনিংস, রশিদ খানের শেষ দিকে খেলা ১৮ বলে ৩৫ রানের ক্যামিও ইনিংসে আফগানিস্তান তুলেছিল ২৯১ রান। বিশ্বকাপে এর আগে কখনোই এত রান তাড়া করে জেতেনি অস্ট্রেলিয়া। ৯১ রানে ৭ উইকেট পড়ার পর সেটিকে তো মনে হচ্ছিল সুদূরের কোনো কল্পনা।
কিন্তু ম্যাক্সওয়েল যে এদিন হয়ে উঠবেন অতিমানবের চেয়েও বড় কিছু, ঘটবে অকল্পনীয় সব ঘটনা। অবিশ্বাস্য বিশেষণটাকেও আপনার কেমন হালকা মনে হবে তখন।