কাইল ভেরেইনা কেপটাউনের যে ওয়েইনবার্গ বয়েজ স্কুলের ছাত্র, সেই স্কুল বিখ্যাত অনেক ক্রীড়াবিদের জন্মভূমি। বিখ্যাত মানে কেমন বিখ্যাত, তা বোঝাতে একটা নামই যথেষ্ট—জ্যাক ক্যালিস। যে ক্যালিস সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডারের তর্কে স্যার গ্যারি সোবার্সকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারেন। ক্যালিসের স্কুলমেটকে অবশ্য ক্রিকেটের চেয়ে হকিই বেশি টানত। হকি খেলোয়াড়ই হতে চেয়েছিলেন। একটা দুর্ঘটনা বদলে দেয় ভেরেইনার জীবনের গতিপথ।
১৬ বছর বয়সে হকি মাঠেই হাত ভেঙে যায় ভেরেইনার। এমন ভাঙাই ভাঙে যে তা ঠিক করতে হাতে চারটি ধাতব পাত বসাতে হয়। এরপরই হকি থেকে মন উঠে যায়। ধ্যানজ্ঞান করে নেন ক্রিকেটকে। কী বলবেন—হকির ক্ষতি, ক্রিকেটের লাভ? বলতেই পারেন।
ম্যাচ রিপোর্টের শুরুতেই জীবনীর ঢংয়ে কাইল ভেরেইনার গল্প ফেঁদে বসার কারণ আপনার অনুমান করে ফেলার কথা। সেই অনুমান সত্যি হওয়া না–হওয়া অবশ্য আপনি বাংলাদেশ–দক্ষিণ আফ্রিকা মিরপুর টেস্টের খবর রাখছেন কি না, এর ওপর নির্ভরশীল।
স্পিন জয় করে ভেরেইনার সেঞ্চুরিই বাংলাদেশকে ঠেলে দিয়েছে গভীর খাদের কিনারে। প্রথম ইনিংসে দক্ষিণ আফ্রিকার ২০২ রানে এগিয়ে যাওয়ার মূল রসদ তো ওই সেঞ্চুরিই।
টেস্ট ক্রিকেটে কখনো কখনো এমন দিন আসে, যেদিন বলার মতো তেমন কিছুই ঘটে না। না দারুণ কোনো ব্যাটিং পারফরম্যান্স, না দুর্দান্ত কোনো বোলিং স্পেল অথবা কোনো বিতর্ক। ঢিমেতালে খেলা চলে, দিন শেষে মনে রাখার মতো তেমন কিছুই থাকে না। মিরপুর টেস্টের দ্বিতীয় দিনটিও প্রায় এ রকমই।
‘প্রায়’ শব্দটা রাখতে হচ্ছে এই কাইল ভেরেইনার জন্যই। ম্যাড়মেড়ে এই দিনেও যে ভেরেইনাকে মনে রাখতে হচ্ছে। যে দিনটির দিকে ফিরে তাকালে চোখে ভাসছে একের পর এক সুইপ করে যাওয়ার দৃশ্য। সেই সুইপ করে করেই উপমহাদেশে প্রথম ইনিংসেই সেঞ্চুরি করে ফেলেছেন ভেরেইনা। ১১৪ রানের সব তো আর সুইপে করা সম্ভব নয়। তবে অর্ধেকেরও বেশি, ৫৯ রানই সুইপে। ৮ চারের ৭টিই, ২ ছক্কার ১টিও।
প্রথম ইনিংসে ২৯১ রানে পিছিয়ে থাকা দলকেও জিততে দেখেছে টেস্ট ক্রিকেট। তাহলে ২০২ রানে পিছিয়ে থেকে কেন জেতা যাবে না? এমন প্রশ্ন তুললে বুঝতে হবে, আপনি খুব স্বপ্নবিলাসী মানুষ।
বছর দু–এক আগে ক্রাইস্টচার্চে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে তাঁর প্রথম সেঞ্চুরিটি বড় ভূমিকা রেখেছিল দক্ষিণ আফ্রিকার ম্যাচ জয়ে। রানও সেখানে ২২ বেশি, তার ওপর ছিলেন অপরাজিত। তারপরও ভেরেইনা নির্দ্বিধায় মিরপুরের ১১৪–কে এগিয়ে রাখছেন অচেনা বিরূপ পরিবেশের কারণে। তার চেয়েও বড় কারণ সম্ভবত বোলিং আক্রমণ। এক চিমটি পেসের মিশেলে যা স্পিন, স্পিন, আরও স্পিন। এত স্পিন এর আগে কোনো দিন খেলেছেন বলে মনে হয় না।
স্পিন জয় করে ভেরেইনার সেঞ্চুরিই বাংলাদেশকে ঠেলে দিয়েছে গভীর খাদের কিনারে। প্রথম ইনিংসে দক্ষিণ আফ্রিকার ২০২ রানে এগিয়ে যাওয়ার মূল রসদ তো ওই সেঞ্চুরিই। উইয়ান মুল্ডার ও ড্যান পিট সঙ্গতের কথাও অবশ্য একটু উল্লেখ করা উচিত। মুল্ডার ৫৪ রান করেছেন, পিট ৩২। তবে আসল কাজটা করেছেন দুটি মহাগুরুত্বপূর্ণ জুটিতে ভেরেইনাকে সঙ্গ দিয়ে। সপ্তম আর নবম উইকেটে ১১৯ আর ৬৬ রানের জুটি দুটিই তো বাংলাদেশকে এত পেছনে ফেলে দেওয়ার মূলে।
কত পেছনে? ফলোঅনের কথা মনে করিয়ে দেওয়ার মতো পেছনে। এখানে দক্ষিণ আফ্রিকা পরে ব্যাটিং করেছে বলে ফলোঅনের প্রশ্ন উঠছে না। তবে ইনিংস পরাজয় বলে একটা ব্যাপার তো থাকছেই। সে জন্য দক্ষিণ আফ্রিকাকে আবারও ব্যাটিং করাতে হবে। সে জন্য যা করতে হবে, কাল দ্বিতীয় সেশনের মাঝামাঝি সময়ে দ্বিতীয় ইনিংস শুরু করে বাংলাদেশ তার ঠিক অর্ধেক পথ পেরিয়েছে। কিন্তু ১০১ রান তুলতে হারাতে হয়েছে ৩ উইকেট। প্রথম ইনিংসের মতো এবারও সাদমান ও মুমিনুল এক অঙ্কের রানে আউট। অধিনায়ক নাজমুল হোসেন একটু উন্নতি করেছেন। প্রথম ইনিংসে করেছিলেন ৭ রান, এবার ২৩। বাঁহাতি স্পিনার কেশব মহারাজের বলে অদ্ভুতভাবে ডিফেন্স করতে গিয়ে এলবিডব্লু হওয়ার আগপর্যন্ত খেলছিলেনও বেশ ভালো। দারুণ একটি ছক্কায় ইতিবাচক বার্তাও ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। মিড অফের ওপর দিয়ে ছক্কাটাও ওই কেশব মহারাজের বলেই।
প্রথম ইনিংসে ২৯১ রানে পিছিয়ে থাকা দলকেও জিততে দেখেছে টেস্ট ক্রিকেট। তাহলে ২০২ রানে পিছিয়ে থেকে কেন জেতা যাবে না? এমন প্রশ্ন তুললে বুঝতে হবে, আপনি খুব স্বপ্নবিলাসী মানুষ। বাস্তবতাকে আপনার থোড়াই কেয়ার। তা বাস্তবতাটা কী? বাস্তবতা হলো, এই টেস্টে বাংলাদেশ পরাজয় এড়াতে পারলে সেটাই হবে প্রায় জয়ের সমান। ইতিহাস যে ব্যাপারে খুব একটা আশাবাদী হতে দিচ্ছে না। এই টেস্টের আগে প্রথম ইনিংসে বাংলাদেশ যে ৬৫ বার প্রতিপক্ষের চেয়ে ২০০ বা এর চেয়ে বেশি রানে পিছিয়ে পড়েছে, পরাজয় এড়াতে পেরেছে তার মাত্র চারটিতেই। এর দুটি আবার পুরোপুরিই বৃষ্টির কৃপাধন্য। নিজেদের কৃতিত্বে শুধুই দুবার। বৃষ্টি অবশ্য চোখ রাঙাচ্ছে এখানেও। টেস্টের শেষ তিন দিনই বৃষ্টির পূর্বাভাস আছে।
তবে সেই আশায় তো বসে থাকলে চলে না। নিজেদের মতো করে পরিকল্পনা করতে হয়। জ্বালিয়ে রাখতে হয় আশার দীপও। দিন শেষে বাংলাদেশ দলের প্রতিনিধি হয়ে আসা হাসান মাহমুদ যেন সেই চেষ্টাই করলেন। দক্ষিণ আফ্রিকাকে ২০০ রানের লক্ষ্য দিতে চাওয়ার উচ্চাভিলাষী ইচ্ছার কথা জানিয়ে সে জন্য করণীয়টাও বলে দিলেন—তৃতীয় দিন তিন সেশন ব্যাটিং করা। সেটি অবশ্যই সম্ভব, কারণ ক্রিকেটে অসম্ভব বলে কিছু নেই বলেই। নইলে হাসান মাহমুদের আগেই তো ভেরেইনা বলে গেছেন, প্রথম দিনের তুলনায় দ্বিতীয় দিন প্রথম সেশনে উইকেট ব্যাটিংয়ের জন্য একটু ভালো থাকলেও দিন যত গড়িয়েছে, ততই তা কঠিন হয়েছে। তৃতীয় দিন আরও কঠিন হবে।
তৃতীয় দিন বাংলাদেশ ব্যাটিং করবে বলে ভেরেইনার কথাটা হয়তো মনস্তাত্ত্বিক খেলার অংশ, হয়তো নয়। মিরপুরে তৃতীয় দিনের উইকেটের তো একটু উল্টোপাল্টা কিছু করারই কথা। সেই উইকেটে রাবাদা–মহারাজ...না, স্বপ্ন দেখলে নিজ দায়িত্বে দেখুন।