মিচেল স্টার্ক, যশপ্রীত বুমরা, কাগিসো রাবাদা, শাহিন শাহ আফ্রিদি কিংবা মার্ক উডরা তাহলে এবার আশাবাদী হতে পারেন। এবার তাহলে তাঁদেরও সুযোগ থাকছে বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড় হওয়ার।
সামনে উদাহরণ হিসেবে যে এখন স্যাম কারেন আছেন। একমাত্র উদাহরণ অবশ্য। একমাত্র ‘পেসার’, যিনি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে টুর্নামেন্ট-সেরা হয়েছেন।
কেউ কেউ একটু বিভ্রান্ত হতে পারেন। স্যাম কারেন শুধু পেসার কেন, তিনি তো পুরোদস্তুর অলরাউন্ডার। খুবই সত্যি কথা। তবে ২০২২ সালে অস্ট্রেলিয়ায় সর্বশেষ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে আসলে ব্যাটসম্যান কারেনের দরকারই পড়েনি ইংল্যান্ডের। ২ ইনিংসে ১২ রান—এই ছিল ওই বিশ্বকাপে কারেনের ব্যাটিং পরিসংখ্যান।
তারপরও যে বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড় হয়েছেন, সেটা মূলত ৬ ম্যাচে ২২.৪ ওভার বোলিং করে ৬.৫২ ইকোনমিতে নেওয়া ১৩ উইকেটের জন্য, যার মধ্যে আছে পাকিস্তানের বিপক্ষে ফাইনালে ১২ রানে ৩ উইকেট নিয়ে ম্যাচ জেতানো পারফরম্যান্সও।
এর আগে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ৭টি আসরের সেরা খেলোয়াড়দের নামগুলোয় একবার চোখ বুলিয়ে আসুন। শহীদ আফ্রিদি, তিলকরত্নে দিলশান, কেভিন পিটারসেন, শেন ওয়াটসন, বিরাট কোহলি, ডেভিড ওয়ার্নার…‘পেসার’ পরিচয়ের কাউকে খুঁজে পেলেন কি? দীর্ঘদিন ধরে তাই এটাই মনে হচ্ছিল, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ বুঝি পেসারদের কখনো সেরা হতে দেবে না।
কারেন কেন ব্যতিক্রম এবং স্টার্ক-বুমরা-আফ্রিদিদের প্রেরণা, এবার বুঝতে পারছেন তো?
অবশ্য এখানে একটা শর্তও আছে। কারেনের মতো সেরা খেলোয়াড় হতে হলে নিজের দলটাও চ্যাম্পিয়ন হতে হবে বিশ্বকাপে। ওই বিশ্বকাপে কারেন ছিলেন দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি। ১৫ উইকেট নিয়ে সবার ওপরে ছিলেন শ্রীলঙ্কার ওয়ানিন্দু হাসারাঙ্গা। ব্যাট হাতে সেরাদের তালিকায় সবার ওপরের নামটা ছিল ২৯৬ রান করা বিরাট কোহলির।
টি-টোয়েন্টি ব্যাটিংয়ে সবচেয়ে বেশি যেটা গুরুত্বপূর্ণ, সেই স্ট্রাইক রেটে ২০০-এর বেশি রান করেছেন যাঁরা, তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে ওপরে ছিল সূর্যকুমার যাদবের নাম (১৮৯.৬৮ স্ট্রাইক রেটে ২৩৯ রান)। তারপরও কারেন সেরা হওয়ার প্রধান কারণ অবশ্যই তাঁর দল ইংল্যান্ডের শিরোপা জয়।
এখানেও কারেন একটু ব্যতিক্রমী। নিজে সেরা খেলোয়াড় এবং দল চ্যাম্পিয়ন, এ রকম সৌভাগ্য তাঁর আগে হয়েছে শুধু কেভিন পিটারসেন আর ডেভিড ওয়ার্নারের। কারেনের সঙ্গে তাঁদের আরও একটা মিল, ওই দুজনের কেউই নিজ নিজ বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি রান বা সবচেয়ে বেশি উইকেটের মালিক ছিলেন না।
২০১০ সালে ইংল্যান্ডের শিরোপাজয়ী অভিযানে ৬ ম্যাচ ২ ফিফটিতে টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২৪৮ রান করেছিলেন পিটারসেন। রানসংখ্যায় তাঁর চেয়ে এগিয়ে ছিলেন শুধু মাহেলা জয়াবর্ধনে (৩০২)। বল হাতে সেবার ১৪ উইকেট নিয়ে সবার ওপরে ডার্ক ন্যানেস।
২০২১ বিশ্বকাপেও গল্পটা প্রায় একই রকম। ব্যাট হাতে ৩০৩ রান ছিল বাবর আজমের, ১৬ উইকেট নিয়ে সেরা বোলার ওয়ানিন্দু হাসারাঙ্গা। অস্ট্রেলিয়া চ্যাম্পিয়ন না হলে হয়তো ২৮৯ রান করা ওয়ার্নার নয়, অন্য কেউই টুর্নামেন্ট–সেরা হতেন।
অবশ্য চ্যাম্পিয়ন দল থেকে টুর্নামেন্ট–সেরা বেছে নেওয়ার এই রীতি বেশির ভাগ সময়ই মানা হয়নি। সেসব সিদ্ধান্ত যে খুব একটা ভুল মনে হয়েছে, এমনও নয়।
একেবারে প্রথম টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের কথাই মনে করে দেখুন। শহীদ আফ্রিদির পাকিস্তান সেবার হেরে গিয়েছিল মহেন্দ্র সিং ধোনির ভারতের কাছে। আফ্রিদি টুর্নামেন্টে সবচেয়ে বেশি রান করেননি, পাননি সবচেয়ে বেশি উইকেটও। ওই দুই তালিকায় সবার ওপরের নাম দুটি ছিল ম্যাথু হেইডেন ও উমর গুলের।
তারপরও আফ্রিদি টুর্নামেন্ট–সেরা হয়েছিলেন মূলত তাঁর প্রভাবের কারণে। ৭ ম্যাচে ১২ উইকেট, যেগুলোর বেশির ভাগই দলের একেবারে প্রয়োজনের সময়। ব্যাট হাতে মাত্র ৯১ রান, কিন্তু সেটা ১৯৭.৮২ স্ট্রাইক রেটে। পাকিস্তানকে ফাইনাল পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ায় সবচেয়ে বড় ভূমিকা ছিল তাঁর। ফাইনালে ব্যর্থ হলেও টুর্নামেন্টজুড়ে তাঁর ওই ম্যাচের রং বদলে দেওয়া পারফরম্যান্সই যথেষ্ট ছিল সেরা খেলোয়াড় হওয়ার জন্য।
এমন প্রভাব ছিল তিলকরত্নে দিলশানেরও। ২০০৯ বিশ্বকাপটাকে শুধু তাঁর ‘দিলস্কুপ’ শটের জন্যই আলাদা করে মনে রাখতে হবে। জিম্বাবুয়ের ডগলাস ম্যারিলিয়ারের হাত ধরে যে প্যাডল স্কুপ শটের উদ্ভব, মোহাম্মদ আশরাফুলের যে শটকে ২০০৭ বিশ্বকাপে আরও পরিচিত করে তোলেন, সেটারই আরেকটু পরিবর্তিত সংস্করণ দুই বছর পর ইংল্যান্ডে দেখা গিয়েছিল দিলশানের ব্যাটে। উইকেটকিপারের ঠিক পেছনে পাঠানো সেই শট খেলে খেলে ওই বিশ্বকাপে দিলশান ৩১৭ রান করেছিলেন ১৪৮ স্ট্রাইক রেটে। ৩টি ফিফটি করেছিলেন, যার মধ্যে সেমিফাইনালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ৫৭ বলে অপরাজিত ৯৬ রানের ইনিংসটাই শ্রীলঙ্কাকে ফাইনালে নিয়ে গিয়েছিল।
ফাইনালে অবশ্য আর হাসেনি দিলশানের ব্যাট। আগেরবার ফাইনালে ব্যর্থ শহীদ আফ্রিদি ৪০ বলে অপরাজিত ৫৪ রানের এক কার্যকর ইনিংস খেলে জেতান পাকিস্তানকে। তবে আফ্রিদি নয়, টুর্নামেন্ট–সেরার স্বীকৃতি পান দিলশানই; যদিও টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ ১৩ উইকেট পাওয়া উমর গুলও পেতে পারতেন পুরস্কারটা। এর আগের বিশ্বকাপেও সর্বোচ্চ ১৩ উইকেট পেয়েছিলেন গুল। মন্দ কপাল তাঁর, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ যে তখনো শুধু পেসার নয়, বোলারদেরই আপন করে নিতে পারেনি!
দুর্ভাগা এই বোলারদের তালিকায় পড়েছেন ২০১২ বিশ্বকাপে শ্রীলঙ্কার ট্রফি জয়ে বড় ভূমিকা রাখা অজন্তা মেন্ডিসও। ১৫ উইকেট নিয়েও টুর্নামেন্ট–সেরা হতে পারেননি। অবশ্য যিনি হয়েছিলেন, তাঁর হাতেই ট্রফিটা সবচেয়ে মানিয়েছিল। ৬ ম্যাচে ১৫০ স্ট্রাইক রেটে ২৪৯ রান, বল হাতে মাত্র ১৬ গড়ে ১১ উইকেট। সেমিফাইনাল পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ার অভিযান সেবার আসলেই ছিল ওয়ান–ম্যান শো। ব্যাটিং-বোলিং দুই ক্ষেত্রেই ইনিংস ওপেন করা সেই ওয়ান–ম্যান শেন ওয়াটসন। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত সেটাই সেরা অলরাউন্ড পারফরম্যান্স। শুধু আক্ষেপ, এমন অবিশ্বাস্য খেলেও দলটাকে চ্যাম্পিয়ন বানাতে পারলেন না।
এ আক্ষেপে অবশ্য ওয়াটসনের চেয়েও বেশি পুড়েছেন বিরাট কোহলি। ২০১৪ ও ২০১৬—পরপর দুটি বিশ্বকাপে কোহলি যেভাবে ব্যাট করেছেন, তারপরও ভারতের চ্যাম্পিয়ন হতে না পারাটা আসলেই ব্যাখ্যাতীত। ২০১৪ বিশ্বকাপে ৬ ম্যাচে ৪ ফিফটিতে ১০৬.৩৩ গড়ে ৩১৯ রান, যার মধ্যে আছে ফাইনালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৫৮ বলে ৭৭ রানের সেই দুর্দান্ত ইনিংসও। কিন্তু যুবরাজ সিং সেদিন কী ভেবে ১১ রান করতে ২১ বল লাগিয়েছিলেন, সেই রহস্যের সমাধান হয়নি আজও। ফাইনালে ভারতের হারের জন্য যুবরাজের সেই ইনিংসকে দায়ী করা হয় এখনো।
পরের বিশ্বকাপেও কোহলি একই রকম উজ্জ্বল। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে গ্রুপ পর্বে তো টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ইতিহাসেই অন্যতম সেরা ইনিংসটা খেলেছিলেন। নকআউটে রূপ নেওয়া অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে গ্রুপ পর্বের সেই ম্যাচে ৫১ বলে ৮২ রানের ইনিংস ছিল কোহলির ব্যাটসম্যানশিপেরই চূড়ান্ত প্রদর্শনী। এরপর ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সেমিফাইনালেও ৪৭ বলে অপরাজিত ৮৯ রান। কিন্তু সেই ম্যাচ কোহলির হতে দেননি লেন্ডল সিমন্স-আন্দ্রে রাসেলরা। ওয়েস্ট ইন্ডিজের গ্যাংনাম নাচের উৎসবে ৫ ম্যাচে ২৭৩ রান করা কোহলির সান্ত্বনা ছিল আরও একটা টুর্নামেন্ট–সেরার ট্রফি।
অধরা টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জয়ের এবারই শেষ সুযোগ কোহলির সামনে। শুধু টি-টোয়েন্টি কেন, আর কোনো বিশ্বকাপেই হয়তো দেখা যাবে না সর্বকালের অন্যতম সেরা এই ব্যাটসম্যানকে। শেষবারের মতো বিশ্বকাপ খেলবেন ডেভিড ওয়ার্নারও। তাঁর অবশ্য কোনো আক্ষেপই থাকার কথা নয়। ওয়ানডে বিশ্বকাপ তো দুবার জিতেছেনই, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার একমাত্র শিরোপা জয়ের নায়কও তিনিই।
২০২১ বিশ্বকাপে অবশ্য ওয়ার্নারের চেয়েও বেশি রান ছিল বাবর আজমের (৩০৩)। কিন্তু ১৪৬.৭০ স্ট্রাইক রেটে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২৮৯ রান করা ওয়ার্নার ম্যাচ জেতানো ইনিংস খেলেছেন অনেকগুলো। সুপার টুয়েলভে শ্রীলঙ্কা (৪২ বলে ৬৫) ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে (৫৬ বলে ৮৯*) ফিফটির পর সেমিফাইনালে পাকিস্তানের বিপক্ষে ৩০ বলে ৪৯। ফাইনালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ৩৮ বলে ৫৩ রানের পর তাঁর হাতে টুর্নামেন্ট–সেরার ট্রফি তুলে দিতে খুব একটা ভাবতে হয়নি বিচারকদের।
কেভিন পিটারসেনের পর তাই দ্বিতীয় খেলোয়াড় হিসেবে একই সঙ্গে বিশ্বজয় ও বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড় হওয়ার সৌভাগ্য হয় ওয়ার্নারের। দুজনের এই দলকে স্যাম কারেন তিনজনের বানিয়েছেন বছর দুয়েক আগে অস্ট্রেলিয়ায়।
এবার কি দলটা চারজনের হবে?