এভাবে ম্যাচ জেতানোর পর উদযাপন তো এমন বাঁধনহারাই হওয়ার কথা!
এভাবে ম্যাচ জেতানোর পর উদযাপন তো এমন বাঁধনহারাই হওয়ার কথা!

উৎপল শুভ্রর লেখা

নাসিম শাহর কাছে মিয়াঁদাদও যেখানে ম্লান

৩৬ বছর আগে এই শারজাতেই একটি ছক্কা পাকিস্তানের ক্রিকেট রূপকথার অংশ হয়ে আছে এখনো। শেষ বলে পাকিস্তানের জয়ের জন্য প্রয়োজন ৪ রান। চেতন শর্মার ফুল টসে ছক্কার পর ব্যাট উঁচিয়ে জাভেদ মিয়াঁদাদের সেই উন্মাতাল দৌড়। ৩৬ বছর পরও যে ছক্কা নিয়ে কাব্য রচিত হয়ে চলেছে। সেই শারজাতেই নাসিম শাহর দুই ছক্কাও মিয়াঁদাদের কীর্তির মতোই আরও অনেক অনেক দিন মানুষের মুখে মুখে ফেরার কথা।

ম্যাচ দুটির হয়তো তুলনা চলে না। হয়তো কেন, চলেই না। মিয়াঁদাদের ছক্কার সেই ম্যাচ ছিল অস্ট্রেলেশিয়া কাপের ফাইনাল। তার ওপর প্রতিপক্ষ ভারত। শারজায় ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ তখন আগুনের ফুলকি ছোটায়। সেই ম্যাচে মিয়াঁদাদের ওই ছক্কার সুদূরপ্রসারী প্রভাবও ছিল। তা তো শুধুই একটা ম্যাচ জেতায়নি, বদলে দিয়েছিল পাক-ভারত দ্বৈরথের চিত্রও। এর আগ পর্যন্ত যে লড়াইয়ে ভারতের একাধিপত্য ছিল, ওই ছক্কার পর তা রাতারাতি বদলে গিয়ে পাকিস্তানের আধিপত্যের গল্প লিখতে শুরু করে।

নাসিম শাহর দুই ছক্কা ফাইনালে নয়, ফাইনালে ওঠার লড়াইয়ে। কিন্তু একদিক থেকে তো তা মিয়াঁদাদের ওই বিখ্যাত ছক্কাকেও ম্লান করে দেওয়ার মতো। কীভাবে? সংক্ষেপে বললে একজন জাভেদ মিয়াঁদাদ, আরেকজন নাসিম শাহ বলে। ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে লেগ স্পিনার পরিচয় বাদ দিলে মিয়াঁদাদ ছিলেন নির্ভেজাল ব্যাটসম্যান।

চেতন শর্মার শেষ বলে জাভেদ মিঁয়াদাদের সেই ছক্কা! শারজা, ১৯৮৬।

পাকিস্তানের সেই দলের অবিসংবাদিত সেরা তো বটেই, বিশ্ব ক্রিকেটেরই অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান। নাসিম শাহ যেখানে নির্ভেজাল বোলার। যে কারণে ব্যাটিং অর্ডারে সবার শেষের আগের জায়গাটা তাঁর। অর্থাৎ ১০ নম্বর ব্যাটসম্যান। সেই ১০ নম্বরই যখন পরপর দুই বলে ছক্কা মেরে এমন একটা ম্যাচ জিতিয়ে দেন, তখন অবিশ্বাসে চোখ কচলাতেই হয়।

অবিশ্বাস্যই তো! শেষ ওভারে দরকার ১১ রান, আর ১০ নম্বর ব্যাটসম্যান কিনা প্রথম দুই বলেই ছক্কা মেরে ম্যাচের মীমাংসা করে দিচ্ছেন! এই দৃশ্য কি আর প্রতিদিন দেখা যায়! এর আগে ২ বল খেলে ২ রান করেছেন বলে ম্যাচ শেষে নাসিম শাহর নামের পাশে ৪ বলে অপরাজিত ১৪। আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে তাঁর মোট রান কত, জানেন তো? ১৪-ই।

এর আগে যে কোনো রান করতে পারেননি, তা তো বুঝতেই পারছেন। ব্যাটিংই তো করেছেন মাত্র একবার। গত ২৮ আগস্ট এই এশিয়া কাপের ভারতের বিপক্ষে অভিষেক ম্যাচে প্রথম বলেই আউট হয়ে ফিরেছিলেন 'গোল্ডেন ডাক' নিয়ে। হংকং ও ভারতের বিপক্ষে পরের দুই ম্যাচে ব্যাটিং করারই সুযোগ পাননি।
আবার যখন সুযোগ এলো, নাসিম শাহ দাঁড়িয়ে প্রায় অসম্ভব এক সমীকরণের সামনে। 'প্রায়' শব্দটা তো রাখতে হচ্ছে শেষ পর্যন্ত তা করে ফেলেছেন বলে। নইলে তখন কে ভেবেছিল, এই ম্যাচ পাকিস্তান জিতবে!

আসিফ আলীর এই ছবিও মনে করিয়ে দিয়েছে জাভেদ মিয়াদাঁদকে।

বিশেষ করে আগের ওভারে যা হয়েছে। ১৯তম ওভারে ২ উইকেট তুলে নিয়ে আফগান পেসার ফরিদ আহমেদ আফগানিস্তানের জয় তো একরকম নিশ্চিতই করে দিয়েছিলেন। এর মধ্যে দ্বিতীয় উইকেটটি পাকিস্তানের শেষ আশা হয়ে থাকা আসিফ আলীর। আগের বলেই যিনি বিশাল এক ছক্কায় বল পাঠিয়েছেন গ্যালারিতে। পরের বলে একই চেষ্টা করতে গিয়ে শর্ট ফাইন লেগে ক্যাচ!

আসিফকে ফিরিয়ে দেওয়ার আনন্দ তো বলতে গেলে তখন ম্যাচ জিতে যাওয়ার আনন্দই। সেই আনন্দের আতিশয্যে ফরিদ আহমেদ নিশ্চয়ই আসিফ আলীকে আপত্তিকর কিছু বলেছিলেন। নাসিম শাহ দুই ছক্কায় মনে করিয়ে দেওয়ার আগেই যে কারণে ফিরে এসেছিল মিয়াঁদাদের স্মৃতি। ফিরে এসেছিল ১৯৮১ সালের পাকিস্তান-অস্ট্রেলিয়া পার্থ টেস্ট। যখন অস্ট্রেলিয়ান ফাস্ট বোলার ডেনিস লিলিকে ব্যাট উঁচিয়ে মারতে গিয়েছিলেন মিয়াঁদাদ। এর আগে অবশ্য লিলি তাঁকে লাথি দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ। এদিন শারজায় আসিফ আলীও ব্যাট তুলেছিলেন ফরিদ আহমেদকে মারতে।

আফগানিস্তানের অন্য খেলোয়াড়েরা মাঝখানে এসে না দাঁড়ালে কেলেঙ্কারিই হয়ে যেত। এর আগেই অবশ্য কিছুটা হয়েছে। ক্রিকেটে নৈবচ নৈবচ শারীরিক সংস্পর্শ হয়েছে দুজনের, যা ম্যাচ রেফারির নজরে না পড়ে পারেই না।

ডেনিস লিলিকে ব্যাট উঁচিয়ে মারতে গিয়েছিলেন জাভেদ মিয়াদাঁদ। পার্থ, ১৯৮১।

ঘটনাটা সবিস্তারে উল্লেখ করার কারণ একটাই, নাসিম শাহ শেষ ওভারের ওই অগ্নিপরীক্ষায় নামার আগে মাঠের পরিস্থিতি কেমন উত্তপ্ত ছিল, তা বোঝানো। খেলাটা যারা দেখেছেন, তাদের তো জানাই। যারা দেখেননি, তাদের একটু আফসোস হওয়ারই কথা। এমন সমাপ্তি তো আর প্রতিদিন হয় না।

শেষ ওভারে টানা চার ছক্কায়ও টি-টোয়েন্টি ম্যাচ শেষ হয়েছে, সেটিও আবার বিশ্বকাপ ফাইনালে। কিন্তু ১০ নম্বর ব্যাটসম্যানের দুই ছক্কায়? কার্লোস ব্রাফেটও মনে হয় এখানে এসে ম্লান হয়ে যাচ্ছেন নাসিম শাহর কাছে।

যে নাসিম শাহ এর আগে আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে ছক্কা মারা দূরে থাক, কোনো রানই করেননি!