উৎপল শুভ্রর লেখা

যে ছক্কা মারতে লেগেছিল ২১ বছর

টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট ছক্কাকে বড় সস্তা বানিয়ে ফেলেছে। ছক্কা মারা এখন আর বড় কোনো ব্যাপার নয়। না মারতে পারাই বরং আলোচনার বিষয়। বল কত দূরে পড়ল, সেই দূরত্ব নিয়ে এখন ছক্কার মাহাত্ম্য বোঝানো হয়। টি-টোয়েন্টির এই প্রভাব ওয়ানডেতে তো পড়বেই, পড়েছে টেস্টেও। ছক্কাময় এই সময়ে তাই কাউকে বিশ্বাস করানোই কঠিন যে টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম ছক্কা দেখতে অপেক্ষা করতে হয়েছে ২১ বছর। ম্যাচের হিসাবে ৫৫ নম্বর টেস্ট পর্যন্ত।

এর আগে একজন ব্যাটসম্যানের এক শটে সর্বোচ্চ প্রাপ্তি ছিল ৫ রান। হ্যাঁ, ঠিকই পড়েছেন। ৫ রানই। ১৮৭৭ সালে মেলবোর্নে টেস্ট ক্রিকেটের প্রথম বলটি খেলেছেন যে ব্যাটসম্যান, প্রথম ‘পাঁচ’টিও মেরেছেন সেই চার্লস ব্যানারম্যানই।

আর প্রথম ছক্কা? ৫৫তম টেস্টে এসে মেরেছেন তা অস্ট্রেলিয়ারই জো ডার্লিং। প্রথম চারটি কে মেরেছিলেন, সুনির্দিষ্টভাবে তা জানা না গেলেও সেটি ব্যানারম্যানই হবেন বলে অনুমান করা যায়। তা ক্রিকেট আইন চার–পাঁচ–ছয় থেকে শুধু চার–ছয়ে আসার গল্পটা কী? তা বলার আগে আপনার মনে যে প্রশ্নটা জেগে উঠেছে, সেটির উত্তর দিয়ে নেওয়া ভালো। ক্রিকেটে চার-ছয় মারা যায়, এটা তো সবারই জানা। ‘পাঁচ’ মারে কীভাবে?

অস্ট্রেলিয়া দলকে নিয়ে মাঠে নামছেন জো ডার্লিং। ছবিটি ১৯০৫ সালের

একসময় মারা যেত। বল মাটি না ছুঁয়ে বাউন্ডারি সীমানার ওপারে পড়লেই ছয়...বর্তমান এই আইন তো সর্বজনগ্রাহ্য স্বীকৃতি পেয়েছে ১৯১০ সালে, টেস্ট ক্রিকেট শুরু হওয়ার ৩৩ বছর পর! টেস্ট ক্রিকেটের শুরুতে চার-পাঁচ-ছয় সবই মারতে পারতেন কোনো ব্যাটসম্যান। যদিও ‘পাঁচ’ মারার ব্যাপারটা ছিল শুধু অস্ট্রেলিয়াতেই সীমাবদ্ধ।

অস্ট্রেলিয়ায় বল শুধু সীমানার ওপারে গেলে ব্যাটসম্যান পেতেন ‘পাঁচ’, একেবারে স্টেডিয়ামের বাইরে উড়ে গেলে ছয়। ইংল্যান্ডে ছিল অন্য নিয়ম। সেখানে এক শটে ‘পাঁচ’ রান নেওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। বল মাঠের বাইরে না গেলে ৪ রানের বেশি পেতেন না ব্যাটসম্যান, ৫ রানের সান্ত্বনাও নয়। ১৮৯৯ সালে সফরকারী অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচে এমসিসির অ্যালবার্ট ট্রটের যে বিগ হিটটি লর্ডস মাঠে সবচেয়ে ‘বড়’ বলে স্বীকৃত, তাতে বল প্যাভিলিয়নের ছাদে ড্রপ খেয়ে মাঠের পাশের টেনিস কোর্টে পড়ার পরও ট্রট ৪ রানই পেয়েছিলেন। বল যে সরাসরি মাঠের বাইরে গিয়ে পড়েনি।

অস্ট্রেলিয়ায় বল শুধু সীমানার ওপারে গেলে ব্যাটসম্যান পেতেন ‘পাঁচ’, মাঠের বাইরে গেলে ছয়। ইংল্যান্ডে ছিল অন্য নিয়ম। সেখানে এক শটে ‘পাঁচ’ রান নেওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। বল মাঠের বাইরে না গেলে ৪ রানের বেশি পেতেন না ব্যাটসম্যান, ৫ রানের সান্ত্বনাও নয়।

বল উড়ে গিয়ে বাউন্ডারি সীমানার বাইরে পড়লেই ছয়...অস্ট্রেলিয়ায় অবশ্য ১৯০৪-০৫ মৌসুমেই চালু হয়ে যায় এই নিয়ম। ৫ রান হলে ব্যাটসম্যান আর স্ট্রাইকিং প্রান্তে থাকতে পারেন না, কারণ ছিল এটাই। ১৯০৫ সালের ইংল্যান্ড সফরে অস্ট্রেলীয় অধিনায়ক জো ডার্লিং (যাঁর ব্যাট থেকে টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম ছক্কা) টেস্ট সিরিজের বাইরে অন্য ম্যাচগুলোতে এই নিয়ম অনুসরণ করার জন্য ইংলিশ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে অনেক দেনদরবার করেও সফল হতে পারেননি। ১৯১০ সালে কাউন্টি ক্রিকেটের উপদেষ্টা কমিটির সভায় সিদ্ধান্ত হওয়ার আগপর্যন্ত ইংল্যান্ডে ছক্কা মারতে বল মাঠের বাইরেই পাঠাতে হতো। ছক্কার নিয়ম পরিবর্তনেও তাই জো ডার্লিংয়ের ভূমিকা আছে। অবদান আছে ক্রিকেটে আরেকটি সংযোজনেও। এখন যে বোলারদের রানআপের জায়গাটায় কোনো সমস্যা থাকলে মাঠকর্মীদের কাঠের গুঁড়া ছড়াতে দেখেন, আগে এটা নিয়মসিদ্ধ ছিল না। চিন্তাটা জো ডার্লিংয়ের মাথা থেকেই আসে এবং তিনি তা পাসও করান।

জো ডার্লিংয়ের আবক্ষ মূর্তি

টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম ছক্কা তো তাঁকে অমর করে রেখেছেই, আরও অনেক ক্রিকেটীয় কীর্তির কারণেও স্মরণীয় হয়ে আছেন জো ডার্লিং। টেস্টে সেঞ্চুরি করা প্রথম বাঁহাতি ব্যাটসম্যান তিনি। এক সিরিজে ৩টি সেঞ্চুরি করার প্রথম কীর্তিও তাঁর, প্রথম ৫০০ রান করারও (দুটিই ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১৮৯৭-৯৮ সিরিজে)। সেই সিরিজেই অ্যাডিলেডে টেস্ট ক্রিকেটের প্রথম ছক্কাটি মারেন ডার্লিং। অর্থাৎ বল পাঠিয়ে দেন মাঠের বাইরে। সেটিও তিন-তিনবার। এর প্রথমটি মেরেই পূর্ণ করেছিলেন নিজের সেঞ্চুরি।

৩৪ টেস্টে ২৮.৫৬ গড়ে ১৬৫৭ রান...এই পরিসংখ্যান ডার্লিংয়ের ব্যাটিং–সামর্থ্যের পুরো প্রতিফলক নয়। তবে অধিনায়কত্বের রেকর্ডে ঠিকই মূর্ত নেতৃত্বগুণ। ২১টি টেস্টে নেতৃত্ব দিয়ে হেরেছেন মাত্র ৪টিতে। তিনটি অ্যাশেজ জয়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ১৯০২ সালে তাঁর নেতৃত্বাধীন অস্ট্রেলিয়া সর্বকালের সেরা দল নিয়ে আলোচনাতেও আসে। ১৯০৫ সালে ক্যারিয়ারের শেষ সিরিজটিতে হেরে যাওয়ায় অধিনায়কত্বের ক্যারিয়ারের শেষটা অবশ্য সুখকর হয়নি।

সেই সিরিজেই ডার্লিংকে নিয়ে মজার একটা ঘটনা আছে। সেবার ইংল্যান্ডের অধিনায়ক স্ট্যানলি জ্যাকসন, পরে যিনি ব্রিটিশ–শাসিত বাংলার গভর্নর হয়েছিলেন। তো কাকতালীয়ভাবে দুই অধিনায়ক ডার্লিং-জ্যাকসন দুজনেরই জন্ম হয়েছিল একই দিনে। মজার ঘটনা এটা নয়। সেই সিরিজের পাঁচটি টেস্টেই টসে হারার পর সফরের শেষে স্কারবরোতে একটি প্রদর্শনী ম্যাচের আগে ডার্লিং কোমরে তোয়ালে জড়িয়ে জ্যাকসনকে গিয়ে বলেন, ‘আর টস করতে রাজি নই। টসের বদলে কুস্তি হবে।’

১৯০৫ অ্যাশেজ সিরিজে দুই দলের অধিনায়ক জো ডার্লিং ও স্ট্যানলি জ্যাকসন

কুস্তি করতে খুব পছন্দ করতেন জো ডার্লিং। তাতে বেশ পারদর্শীও ছিলেন। সেই সময়ে অস্ট্রেলিয়ার ঘরোয়া ক্রিকেটের রীতি অনুযায়ী দলে নতুন আসা কাউকে দলের সবচেয়ে শক্তিমান কারও সঙ্গে খালি গায়ে কুস্তি করতে হতো। খালি গায়ে লিখেছি বটে, তবে বইপত্রে ‘নেকেড’ শব্দটাই পাচ্ছি। কাজেই ওই কুস্তির সময় শুধু উর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত থাকত, নাকি পুরোই বিবস্ত্র হতে হতো—এ ব্যাপারে ঠিক নিশ্চিত হতে পারছি না। যা–ই হোক, জো ডার্লিংয়ের দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়া দলে অভিষেকের সময় তাঁকে কুস্তির চ্যালেঞ্জ জানান ফাস্ট বোলার আর্নি জোনস। জোনস উচ্চতায় ৫ ফুট ১১ ইঞ্চি, ফাস্ট বোলাররা যেমন শক্তপোক্ত হন, ঠিক তেমনই। তারপরও সবাইকে অবাক করে দিয়ে মাত্র ৫ ফুট ৮ ইঞ্চির ডার্লিং তাতে জিতে যান।

কুস্তিগীর হিসেবে জো ডার্লিংয়ের প্রবল আত্মবিশ্বাসই হয়তো স্ট্যানলি জ্যাকসনকে টসের বদলে কুস্তিতে আমন্ত্রণ জানানোর কারণ। জ্যাকসনের ঘটনা ছিল উল্টো। যে কারণে তিনি পাশে দাঁড়ানো অলরাউন্ডার জর্জ হার্স্টকে দেখিয়ে বলেন, ‘এই ম্যাচে তো ও আমাদের অধিনায়ক!’ ইয়া লম্বা-চওড়া হার্স্টের দিকে একবার তাকিয়ে ডার্লিং বলেন, ‘ক্রিকেট খেলায় কুস্তি-টুস্তির কী দরকার! প্রথাগত টসই হোক।’ তা-ই হয় এবং টসে আবার হারেন ডার্লিং!

তা হঠাৎ করে আজ টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম ছক্কা নিয়ে পড়ার কারণ কী? কারণ তো আছেই। ১৮৯৮ সালের ১৪ জানুয়ারি, অর্থাৎ আজকের এই দিনেই জো ডার্লিংয়ের ওই ‘প্রথম’–এর কীর্তি।