ঘরোয়া ক্রিকেটে আহামরি কিছু না করেও বাংলাদেশ জাতীয় দলে ফিরেছিলেন। প্রধান কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহের প্রিয় শিষ্য হওয়ায় সুবাদে তেমন কিছু না করেই ফিরেছেন—এমন প্রশ্নও উঠেছিল। ফেরার পর টানা দুই ম্যাচে শূন্য রানে আউট হওয়ায় তীব্র সমালোচনাও হয়েছে। আগের ম্যাচে তো ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি বোলিং-ফিল্ডিংয়েও দলকে ডুবিয়েছেন। তবু সৌম্য সরকারের ওপর আস্থা রেখেছিল টিম ম্যানেজমেন্ট।
নেলসনে আজ নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সৌম্য সেই আস্থার প্রতিদান দিলেন ১৫১ বলে ১৬৯ রানের দুর্দান্ত ইনিংস খেলে, যা তাঁর ক্যারিয়ার–সেরা। যদিও ২২ চার ও ২ ছক্কায় সাজানো ইনিংসটা বৃথা গেছে। বাংলাদেশের দেওয়া ২৯২ রানের লক্ষ্য ২২ বল আর ৭ উইকেট বাকি রেখে টপকে গেছে নিউজিল্যান্ড। তবে ক্যারিয়ার–সেরা ইনিংসে ম্যাচসেরার পুরস্কার জেতা সৌম্য নিজেকে ফিরে পাওয়ার একটা বার্তা ঠিকই দিয়ে রেখেছেন।
প্রত্যাশিতভাবে আজ ম্যাচপরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে সৌম্যই এসেছিলেন বাংলাদেশের প্রতিনিধি হয়ে। আর তাঁকে প্রত্যাশিতভাবেই আগের ব্যর্থতা নিয়ে হওয়া সমালোচনা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হওয়া ট্রলের ছড়াছড়ি নিয়েই বেশি প্রশ্ন করলেন সাংবাদিকেরা। একপর্যায়ে বিসিবির মিডিয়া ম্যানেজার এ–জাতীয় প্রশ্ন বাদ দিয়ে ম্যাচসংক্রান্ত প্রশ্ন করার অনুরোধ জানালেন। তবু এগুলো এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। সৌম্যও উত্তর দিয়েছেন তাঁর মতো করেই।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ৮ বছর পার করে মাত্র চতুর্থ শতক পাওয়া সৌম্য জানালেন কীভাবে দুঃসময় পেছনে ফেলে এলেন, ‘আমি তো খেলোয়াড়, আমাকে খেলতেই হবে। ভালো করলে ভালোটা নিয়ে লিখবেন, খারাপ করলে খারাপটা নিয়ে। এটা আপনাদের কাজ। আমার কাজ খেলা। তাই ওই সব (সমালোচনা) নিয়ে অত ভাবিনি। কারণ, ভাবলে নিজের ওপরই চাপ পড়ত বা নিজের ওপর আরও বেশি নেতিবাচক প্রভাব পড়ত। আমি শুধু নিজের ওপর বিশ্বাস রেখেছিলাম এবং প্রক্রিয়াগুলো ঠিক রাখতে চেয়েছিলাম।’
ডানেডিনে প্রথম ওয়ানডের পর সৌম্যর সঙ্গে আলাদাভাবে কাজ করেছেন কোচ হাথুরুসিংহে। হাথুরুর সঙ্গে আলাদা সেশনের পরই আজ সেটার প্রতিফলন দেখা গেল কি না কিংবা ক্যারিয়ারের শুরুর দিকের সৌম্যকে বাংলাদেশ আবার ফিরে পেল কি না, এমন প্রশ্নে ৩০ বছর বয়সী অলরাউন্ডারের উত্তর, ‘না না, এমন কোনো কিছুই নয়। সৌম্য সৌম্যই ছিলাম। হয়তো তিনি (হাথুরুসিংহে) আমাকে ভালো বোঝেন। যে কারণে এমন ছোট একটা কথা বলেছেন, যা আমার কাজে দিয়েছে। আমরা ব্যাপারটাকে কীভাবে দেখি, সেটাই বড় বিষয়। আপনারা যদি কারও নেতিবাচক দিক খোঁজেন, তাহলে শুধু নেতিবাচকতাই পাবেন। ইতিবাচকভাবে দেখলে অনেক ইতিবাচকতা খুঁজে পাবেন। হয়তো তিনি ইতিবাচক দিকটা নিয়েই চিন্তা করেন।’
সমালোচনা নিয়ে খারাপ লাগা কাজ করলেও ব্যাপারটা থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করেছেন সৌম্য, ‘একটা সময় হয়তোবা (সমালোচনার খবর) দেখতাম। কিন্তু সত্যি বলতে, প্রায় এক বছর আমার ফোনে এ ধরনের কোনো সংবাদ আসেনি। আমার ফেসবুক বন্ধু বা অন্যরা ক্রিকেট নিয়ে কোনো কথা বললে আমি তার সঙ্গে থাকি না। যে ইতিবাচক কথা বলে, আমি তার সঙ্গেই থাকি এবং ইতিবাচক দিকগুলো নিয়েই ভাবি। ভালো-খারাপ দুটোই থাকবে। কিন্তু খারাপ করলে তো ক্রিকেট ছেড়ে চলে যেতে পারব না। ক্রিকেটের জন্যই এত দূর আসতে পেরেছি, ক্রিকেটের জন্যই এত পরিশ্রম করছি।’
সব খেলোয়াড়ের ক্যারিয়ারেই উত্থান-পতন থাকে। সৌম্যর বেলায় পতনের প্রভাবটা দীর্ঘমেয়াদি হয়েছে। ছন্দ হারিয়ে ফেলার পর থেকেই ছিলেন বড্ড অধারাবাহিক। আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরাতেই কি এমনটা হয়েছিল?
সৌম্য বললেন, ‘একজন ক্রিকেটার প্রতিদিন ভালো খেলবে না। একজন মানুষ যেমন প্রতিদিন ভালো খাবারের প্রত্যাশা করে না, তেমনি আমরা যারা ক্রিকেটার, তারাও প্রতিদিন ভালো কিছুর আশা করি না। আসলে আমরা ক্রিকেটাররা হাসার চেয়ে বেশি কাঁদি। কারণ, একটা সিরিজে প্রত্যাশা পূরণ করতে পারলে হয়তোবা কেউ একটি-দুটি ম্যাচে ভালো খেলে। বাকিটা খারাপই যায়। কিন্তু খারাপটা নিয়েই যদি পড়ে থাকি, তাহলে আমরা পিছিয়ে যাব।’
আজ দলের ৫৮.০৭% রান একাই করেছেন সৌম্য। নিজে এক প্রান্ত আগলে রাখলেও মুশফিকুর রহিম ছাড়া কেউ তাঁকে যোগ্য সঙ্গ দিতে পারেননি। পঞ্চম উইকেটে মুশফিকের সঙ্গে ৯১ রানের জুটি গড়ার পর ষষ্ঠ উইকেটে মেহেদী হাসান মিরাজকে সঙ্গে নিয়ে যোগ করেছিলেন আরও ৬১।
তবে মুশফিক ও মিরাজ ইনিংস বড় করতে না পারায় ও শুরুর দিকে বড় জুটির না হওয়ায় ৪০ থেকে ৫০ রান কম হয়েছে বলে মনে করেন সৌম্য, ‘আমার শতকটা বিফল মনে হচ্ছে। যদি আমরা ম্যাচটা জিততাম, তাহলে অনেক ভালো লাগত। ব্যক্তিগতভাবে যদি বলেন, তাহলে ভালো লাগছে। কিন্তু দিন শেষে না। কারণ, ক্রিকেট দলীয় খেলা। দল যদি জিতত, তাহলে ভালো লাগাটা পরিপূর্ণতা পেত। ভালো স্মৃতি থাকত। আমরা পাওয়ারপ্লেতে কয়েকটি উইকেট হারিয়ে ফেলেছি। দ্রুত উইকেট যদি না যেত, ওই সময় একটা ভালো জুটি যদি হতো, তাহলে মুশি ভাই (মুশফিকুর রহিম) ও মিরাজ এসে সংগ্রহটাকে আরও বড় করতে পারত। আবার মুশি ভাই-মিরাজ যে সময় আউট হয়েছে, সে সময় যদি না হতো, তাহলে আরও ৪০ থেকে ৫০ রান হতে পারত। ৩০০-এর আশপাশে রান করতে পারলে গল্পটা আলাদা হতে পারত।’
জাতীয় দলে ফেরার পর প্রথম দুই ম্যাচেই শূন্য রানে আউট হওয়ায় আজ যে চাপ অনুভব করেছেন, সেটা অস্বীকার করেননি সৌম্য, ‘প্রতিটি বল ফেস করাই চাপের। একজন ব্যাটসম্যান একটাই সুযোগ পায়। একটা ভুল শট খেললেই আউট হয়ে যায়। খারাপ করলে তো সবারই খারাপ লাগে। হয়তো ভালো করলে আজ এই কথাগুলো শুনতে হতো না। হয়তোবা ভালোর জন্যই এটা হয়েছে। কিছু পেতে গেলে কিছু দিতে হয়। ঈশ্বর যেটা দিয়েছেন, তা নিয়েই সন্তুষ্ট। সেটা শূন্য হোক বা আজকের ১৬৯ হোক।’
কীভাবে বড় ইনিংস খেললেন, সেটাও জানিয়েছেন সৌম্য, ‘যেহেতু দ্রুত কয়েকটি উইকেট পড়ে গিয়েছিল, ইনিংস গড়ে তুলতে একটু সময় তো লেগেছেই। অর্ধশত করার পরে শতকের চিন্তা করেছি। শতক পূরণের পর আবার নতুনভাবে পরিকল্পনা করেছি। মাঝেমধ্যে আটকে গিয়েছি, মাঝেমধ্যে শটগুলো খেলতে পেরেছি। এভাবেই ইনিংসটাকে বড় করেছি।’
পরের শতক পেতে আর বেশি দিন সময় নিতে চান না সৌম্য। সম্ভব হলে আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের পঞ্চম শতক করতে চান আগামী শনিবার নেপিয়ারে সিরিজের শেষ ওয়ানডেই, ‘পরের ম্যাচেই আরেকটা শতক হতে পারে (হাসি...)। যেদিন প্রথম জাতীয় দলে সুযোগ পেয়েছিলাম, অবশ্যই চাইনি এখান থেকে আর বের হব। চেয়েছি জাতীয় দলের হয়ে খেলেই অবসর নেব। সবার ইচ্ছা তো এটাই। কখনো নিজ থেকে খারাপ খেলতে চাইনি। এখন চাওয়া থাকবে ভবিষ্যতেও যেন এভাবে খেলে যেতে পারি। নিজেদের ওপর বিশ্বাস রেখে যতটুকু সম্ভব দলকে দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করব।’