বাংলাদেশের পেস বোলার তাসকিন আহমেদ
বাংলাদেশের পেস বোলার তাসকিন আহমেদ

কী হয়েছে তাসকিনের?

২০১৯ বিশ্বকাপ জয়ের পরও এর চার বছর আগের বিশ্বকাপের সেই দুঃস্মৃতি ভুলতে পারেননি এউইন মরগান। ২০১৫ বিশ্বকাপে অ্যাডিলেডে বাংলাদেশের বিপক্ষে ওই ম্যাচ মনেই করতে চান না। কিন্তু সুযোগ পেলেই তা মনে করিয়ে দেন নাসের হুসেইন। অ্যাডিলেডে বাংলাদেশের জয়ের মুহূর্তে ধারাভাষ্যকক্ষে সাবেক ইংল্যান্ড অধিনায়কের মুখেই ছিল মাইক্রোফোন। 'ইংলিশ লায়ন'দের বিদায় করে দিয়ে 'বাংলার বাঘ'দের কোয়ার্টার ফাইনালে উঠে যাওয়ার বেদনাতুর প্রাঞ্জল বর্ণনা আপনি ইউটিউবে খুঁজলেই পেয়ে যাবেন।

অ্যাডিলেডে বাংলাদেশের ওই জয়ে বড় ভূমিকা পেসারদের। মরগান কেন সেই বিশ্বকাপে বাংলাদেশের পেস আক্রমণকে এখনকার চেয়ে এগিয়ে রাখতে চান, সেটি তাই অনুমান করাই যায়। তাহলে গত দুই/আড়াই বছরে বাংলাদেশের পেস বোলিংয়ে যে বিপ্লবের কথা বলা হয়, সেটির কী হবে? সমস্যা হলো, এই বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত সেই বিপ্লবের কোনো চিহ্নই নেই। মরগান যে ২০১৫ বিশ্বকাপের পেস আক্রমণকে এগিয়ে রাখছেন, তা তো এই বিশ্বকাপের বাংলাদেশকে দেখেই।

একটা বড় কারণ অবশ্যই বাংলাদেশের কথিত পেস বিপ্লবের নেতৃত্ব দেওয়া তাসকিন আহমেদের নিজেকে হারিয়ে খোঁজা। প্রথম তিন ম্যাচের কোনোটিতেই তাসকিনের বোলিংয়ে তাসকিনের ঝাঁজ খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাঁর বোলিংয়ে সবচেয়ে বড় অস্ত্র গতি-ও হঠাৎই ঝুপ করে পড়ে গেছে। নয় বছর আগে যে ভারতের বিপক্ষে ওয়ানডেতে স্মরণীয় এক অভিষেক (৫/২৮), সেই ভারতের বিপক্ষে ম্যাচে বাদই পড়ে গেছেন দল থেকে। বিশ্রাম না বাদ--এ নিয়ে সংশয় ছিল। দলীয় সূত্র নিশ্চিত করেছে, তাসকিন বাদই পড়েছেন।

এই বিশ্বকাপে যেন নিজেকে হারিয়ে খুঁজছেন তাসকিন।

প্রথম তিন ম্যাচের কোনোটিতেই ১০ ওভার বোলিং করেননি। প্রথম দুই ম্যাচে তো করেছেন মাত্র ৬ ওভার করে। এই পারফরম্যান্সের পর বাদ পড়তেই পারেন। তবে গত দেড়/দুই বছর তাসকিনের ধারাবাহিকতা বিবেচনায় সিদ্ধান্তটা সহজ হওয়ার কথা নয়। কাঁধে একটা সমস্যা আছে অনেকদিনই। সেটিকে শুশ্রূষা করেই খেলে যাচ্ছেন। সেটিই আবার না খেলার মতো হয়ে গেল কি না, এই শঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছিল না

সমস্যাটা এখনো আছে। একটু হয়তো বেশিই। বলে গতি কমে যাওয়ার কারণও তাই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। গতকাল মুম্বাইয়ে প্রথম অনুশীলন সেশনে বোলিং করেননি। শুধু কিছুক্ষণ দৌড়েছেন। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ম্যাচেও তাসকিন খেলবেন কি খেলবেন না, এই সিদ্ধান্তে তাই তাঁর ফর্মের সঙ্গে কাঁধের অবস্থাও বিবেচনায় আসবে।

তাসকিন অবশ্যই খেলতে চাইবেন। তাসকিনের পুনর্জন্ম নিয়ে এত কথা, সেই পুনর্জন্মের সবচেয়ে বড় প্রমাণের সঙ্গে যে জড়িয়ে আছে দক্ষিণ আফ্রিকা। গত বছর মার্চে দক্ষিণ আফ্রিকায় দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজ জয় বাংলাদেশের ওয়ানডে ইতিহাসেই গৌরবময় এক অধ্যায়। উপমহাদেশীয় পরাশক্তি ভারত-পাকিস্তান যেখানে গিয়ে খাবি খায়, সেখানেই কিনা এমন দাপুটে জয়! অভাবিত সেই সাফল্যে সবচেয়ে জ্বলজ্বলে নাম তাসকিন আহমেদ। তিন ম্যাচ সিরিজের দ্বিতীয়টিতেই শুধু উইকেট পাননি। বাংলাদেশও সেই একটা ম্যাচই হেরেছে। প্রথম ম্যাচে ৩ উইকেট নিয়েছেন। সিরিজ নির্ধারণী তৃতীয় ম্যাচে অভিষেকের পর প্রথম ৫ উইকেট নিয়ে মাত্র ১৫৪ রানে শেষ করে দিয়েছেন দক্ষিণ আফ্রিকাকে।

খালেদ মাহমুদের সঙ্গে বাংলাদেশের দুই পেসার তাসকিন (বাঁয়ে) ও ইবাদত

সামনে দক্ষিণ আফ্রিকা বলেই ওই সিরিজটা নিয়ে এত বিস্তারিত বলা। তবে তাসকিন তো 'ওয়ান সিরিজ ওয়ান্ডার' নন। ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে এই বিশ্বকাপের আগ পর্যন্ত বাংলাদেশের পেসারদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি উইকেট তাঁর। ২৪ ম্যাচে সেই ৩৭ উইকেটও মাত্র ২৫.৪০ গড়ে। স্ট্রাইক রেটও দারুণ। গড়ে প্রতি ৩০.৪ বলে উইকেট। পেসার-স্পিনার মিলিয়েই এই সময়ে তাসকিনের চেয়ে বেশি উইকেট নিয়েছেন শুধু মেহেদী হাসান মিরাজ। তবে এই অফ স্পিনারকে সেজন্য ১০টি ম্যাচ বেশি খেলতে হয়েছে। বোলিং করতে হয়েছে ৬০ ওভারেরও বেশি।

বাংলাদেশের ক্রিকেটে যে পেস-বিপ্লবের কথা বলা হয়, তা প্রতিফলিত এই সময়ের পরিসংখ্যানেও। ওয়ানডেতে বাংলাদেশের সবচেয়ে সফল সাত বোলারের ৫ জনই পেসার। তাসকিনের পর ক্রমানুসারে আসবেন মোস্তাফিজ (২৯ ম্যাচে ৩১ উইকেট), শরীফুল (২২ ম্যাচে ৩৩), ইবাদত (১২ ম্যাচে ২২) ও হাসান মাহমুদ (১৬ ম্যাচে ২১)। এদের মধ্যে ইবাদতকে হারিয়ে ফেলাটা বড় একটা ধাক্কা হয়েই এসেছে। এক সময় শুধুই টেস্ট বোলার হিসেবে বিবেচিত ইবাদত রঙিন জার্সি গায়ে দেওয়ার দিন থেকেই রঙিন। স্ট্রাইকরেটে এমনকি তাসকিনের চেয়েও এগিয়ে। গড়ে ২৪.৫ বলে একটি উইকেট। বিশ্বকাপকে সামনে রেখে বাংলাদেশের পরিকল্পনায় মাঝের ওভারগুলোতে বোলিংয়ে তাঁকেই সবচেয়ে বড় ভরসা বলে ভাবা হয়েছে।

সেই ইবাদত আগে থেকেই নেই। এখন তাসকিনও যদি নিজেকে হারিয়ে খোঁজেন, তাহলে আর এই বিশ্বকাপে 'পেস বিপ্লব'-এর প্রমাণ কীভাবে রাখবে বাংলাদেশ!