রান তাড়ায় কোনো উইকেটই হারায়নি বাংলাদেশ দল
রান তাড়ায় কোনো উইকেটই হারায়নি বাংলাদেশ দল

বিদেশের মাটিতে প্রথম নয়, তবু যেখানে বিশেষ এ জয়

বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে সেন্ট ভিনসেন্টের আর্নস ভেল গ্রাউন্ডের নাম আসবে ঘুরেফিরেই। দেশের বাইরে প্রথম টেস্ট জয়ের ভেন্যু বলে কথা। যে কোনো ‘প্রথমে’র পর সবচেয়ে বেশি চর্চা হয় যা নিয়ে, সেই ‘বড়’র তালিকায় এবার ঢুকে গেল রাওয়ালপিন্ডি স্টেডিয়াম। দুই যুগের টেস্ট পথচলায় দেশের বাইরে এ নিয়ে সপ্তম টেস্ট জিতল বাংলাদেশ। এর মধ্যে উইকেটের বিচারে সবচেয়ে বড় আজ রাওয়ালপিন্ডিতে পাকিস্তানের বিপক্ষে পাওয়া ১০ উইকেটের জয়টিই।

তবে বড় জয়ের ‘বিপদ’ হচ্ছে পরে অন্য কোনো রেকর্ড এসে টপকে যাওয়ার সুযোগ থাকে, নিদেনপক্ষে একক রাজত্বে ভাগও বসাতে পারে। তবে নানা পারিপার্শ্বিকতা বিবেচনায় নাজমুল হোসেনদের এ জয়ে বিশেষ হয়ে থাকবে তাঁর মাহাত্মে। পাকিস্তানের মাটিতে বাংলাদেশের আক্ষেপ ও হাহাকারের স্মৃতি আর দেশের ভেতরে গত কয়েক সপ্তাহের ঘটনাপ্রবাহে যা এই ম্যাচকে দেশের টেস্ট ইতিহাসে ওপরের দিকেই রাখবে।

২০০৯ সালের জুলাইয়ে বাংলাদেশ বিদেশের মাটিতে প্রথম যে টেস্ট জিতেছিল, সেটিতে ‘ফুটনোট’ যোগ করেন অনেকেই। সেবার ক্রিকেট বোর্ডের সঙ্গে দ্বন্দ্বে বাংলাদেশের বিপক্ষে সিরিজ বয়কট করেছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটাররা। স্বাগতিক বোর্ডকে তখন দল বানাতে হয়েছিল জোড়াতালি দিয়ে। আর সেই দলের বিপক্ষেই বাংলাদেশ জিতেছিল ৯৫ রানে। মাশরাফি বিন মুর্তজার হঠাৎ চোটের জেরে সিরিজে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সাকিব আল হাসান। গ্রেনাডায় হওয়া পরের ম্যাচে ওই সাকিবের নৈপুণ্যেই বাংলাদেশ পায় ৪ উইকেটের আরেকটি জয়, সেই সঙ্গে দেশের বাইরে প্রথম সিরিজও।

পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রথম টেস্ট জয়ের মাহাত্ম অনেক

বাংলাদেশকে বিদেশের মাটিতে তৃতীয় টেস্ট জিততে অপেক্ষা করতে হয়েছিল চার বছর। ২০১৩ সালের এপ্রিলে হারারে স্পোর্টস ক্লাব মাঠে ১৪৩ রানের জয়ে ছিল রবিউল ইসলামের ঝলকানি। সিরিজজুড়ে ১২ উইকেট নেওয়া ডানহাতি এই পেসার হারারের ম্যাচে নিয়েছিলেন ৬ উইকেট। জিম্বাবুয়ের মাটিতে বাংলাদেশ জিতেছে আরও একটি টেস্ট, সেটি ২০২১ সালে।

হারারের ওই ম্যাচে দ্বিতীয় ইনিংসে সেঞ্চুরি করেছিলেন এখনকার অধিনায়ক নাজমুল হোসেন। যদিও প্রথম ইনিংসে ১৫০ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলে ম্যাচসেরার স্বীকৃতি উঠেছিল মাহমুদউল্লাহর হাতে। টেস্টে অনিয়মিত জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে বাংলাদেশের দুটি জয়ই অবশ্য বড় কোনো আলোড়ন তোলেনি, এমন জয় যেন পাওনাই ছিল।

তুলনায় ২০১৭ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে পি সারা ওভালের জয় ছিল বেশ আলোচিত। প্রথম কারণ, সেটি ছিল বাংলাদেশের শততম টেস্ট। তামিম ইকবাল, সাকিব আল হাসানদের সৌজন্যে উপলক্ষটা বাংলাদেশ রাঙিয়ে তোলে ৪ উইকেটের দারুণ জয়ে। ২০২২ সালের জানুয়ারিতে মাউন্ট মঙ্গানুইয়ের জয় ছিল অনেকের কাছেই অপ্রত্যাশিত। সেই শুরু থেকেই বাংলাদেশ দলের জন্য নিউজিল্যান্ড সফর মানে কোনোভাবে হারের ব্যবধানে কমিয়ে আনার চেষ্টা।

বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের যত টেস্ট জয়

কিন্তু মাউন্ট মঙ্গানুইয়ের বে ওভালে ক্রিকেট বিশ্বকে চমকে দিয়ে কিউইদের ৮ উইকেটের বড় ব্যবধানে হারিয়ে দেয় বাংলাদেশ। মুমিনুল হক, লিটন দাসদের চমৎকার ব্যাটিংয়ে প্রথম ইনিংসে লিড নিয়েছিল বাংলাদেশ। পরে এবাদত হোসেনের ৪৬ রানে ৬ উইকেট নেওয়া বোলিংয়ের সুবাদে স্বাগতিকদের অল্প রানে গুটিয়ে জয় নাগালে নিয়ে আসে বাংলাদেশ। ৪০ রান তাড়া করতে ২ উইকেট হারালেও এবাদতের বোলিং এবং নিউজিল্যান্ডের মাটিতে প্রথম জয় বলে সেটি হয়ে ওঠে স্মরণীয় এক জয়।

কিন্তু এত সব জয়ের মাঝে রাওয়ালপিন্ডি টেস্টকে আলাদা স্থান দিতেই হবে। সংখ্যা প্রাধান্য দিলে ১০ উইকেটের জয়, যা বাংলাদেশের বিদেশের মাটিতে উইকেটে সর্বোচ্চ ব্যবধান। কিন্তু ঘটনাপ্রবাহ বিচারে এই ম্যাচের সঙ্গে তুলনা চলে না আর কোনোটিরই।

বাংলাদেশ দল এমন সময়ে পাকিস্তান সফরে গেছে, দেশে যখন শত শত ছাত্র–জনতার রক্ত ঝরানোর পর ক্ষমতার পটপরিবর্তন হয়েছে, চারদিকে চলছে ওলট–পালট। এর মধ্যেই আবার দেশের পূর্বাঞ্চলে বন্যা এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চলা অস্থিরতায় এক ক্রান্তিকাল পার করছে বাংলাদেশ। ক্রিকেট দল যে এসব হাওয়া থেকে বাইরে তা–ও নয়, টেস্ট শুরুর দিনই বদল এসেছে ক্রিকেটের শীর্ষ পদে। ম্যাচ চলার মধ্যে একজন ক্রিকেটারের নাম জড়িয়ে গেছে হত্যা মামলায়। ভেতরে–বাইরের এত এত প্রতিকূলতার মধ্যেই এল রাওয়ালপিন্ডি জয়।