পরের অ্যাশেজটি আগামী বছরের শেষে। ব্যাটসম্যান ডেভিড ওয়ার্নারের তখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের দৃশ্যপটে থাকার কথা নয়। আগামীকাল শুরু পাকিস্তানের বিপক্ষে সিডনি টেস্ট দিয়ে ক্যারিয়ারের ইতি টানছেন। গতকাল নিশ্চিত করেছেন, বিশ্বকাপ ফাইনালেই শেষ ওয়ানডেটিও খেলে ফেলেছেন এই বাঁহাতি ব্যাটসম্যান (এটাও অবশ্য বলেছেন, দল চাইলে আগামী বছরের শুরুতে চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে ফিরতে পারেন)। সামনের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ দিয়ে বিদায় বলবেন ক্রিকেটের সবচেয়ে ছোট সংস্করণকেও। ওয়ার্নার কি মিস করবেন অ্যাশেজ?
সেটি করতেই পারেন, খেলোয়াড়মাত্ররই ড্রেসিংরুম মিস করার কথা, আর অ্যাশেজের মতো সিরিজ হলে তো কথাই নেই। এমনিতে ইংল্যান্ড কখনোই আরও অনেকের মতো দুহাত ভরে দেয়নি টেস্ট ব্যাটসম্যান ডেভিড ওয়ার্নারকেও। অ্যাশেজে দেশের মাটিতে যেখানে তাঁর গড় ৫১.৫৪, ইংল্যান্ডে সেটি মাত্র ২৬.৭৪। ২০১৯ সালে স্টুয়ার্ট ব্রড তো বলে বলে আউট করেছেন তাঁকে।
তারপর বেন স্টোকস ও ব্রেন্ডন ম্যাককালামের ইংল্যান্ড যেভাবে খেলছে, তাতে দেশের মাটিতে তাঁদের বিপক্ষে খেলা সবচেয়ে বেশি মিস করার কথা ওয়ার্নারেরই। এই যে স্টোকসরা আক্রমণাত্মক ক্রিকেটের নতুন গান গাইছেন, ওয়ার্নারের পুরো ক্যারিয়ারই তো সেই সুরে বাঁধা। গতকাল সিডনির সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন করা হয়েছিল, তাঁকে টেস্ট ক্রিকেটার হিসেবে কীভাবে মনে রাখা হবে? ওয়ার্নারের উত্তর, ‘যে মাঠে নেমে সবটা দিয়ে এসেছে। সব সময়ই বলে এসেছি, আমার মতো ছেলের জন্য এটা স্বপ্নের মতো। হয়তো সব সময় খাপ খাওয়াতে পারিনি, তবে সৎ ও অকৃত্রিম থেকেছি। আমার মনে হয়, টেস্ট মাঠে সেটি দেখা গেছে, আমি ঠিক এভাবেই খেলেছি।’
সেভাবে খেলেই ওয়ার্নার ওয়ার্নার হয়েছেন। টেস্ট ক্রিকেটে কমপক্ষে ৮ হাজার রান করেছেন, এমন ব্যাটসম্যানদের মধ্যে ওয়ার্নারের (৭০.২৬) চেয়ে বেশি স্ট্রাইক রেট মাত্র একজনের। তাঁর একসময়ের আদর্শ বীরেন্দর শেবাগ (৮২.২৩)। এই তালিকায় শুরুর নামগুলো পড়ুন—শেবাগ, ওয়ার্নার, ভিভ রিচার্ডস, কেভিন পিটারসেন, ব্রায়ান লারা…। চোখের সামনে যে ঘরানার ব্যাটসম্যানের চিত্র ভেসে ওঠে, ওয়ার্নার ঠিক তেমনই।
অথচ ওয়ার্নারের আন্তর্জাতিক দৃশ্যপটে আগমন হুট করেই। যে অস্ট্রেলিয়ার পরবর্তী অধিনায়কও বলতে গেলে কয়েক বছর আগে থেকে ঠিক করা থাকত, সেই অস্ট্রেলিয়ার ১৩২ বছরের ইতিহাসে প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে প্রথম শ্রেণির অভিষেকের আগেই আন্তর্জাতিক অভিষেক হয়ে গিয়েছিল নিউ সাউথ ওয়েলসের অখ্যাত এক উদ্বোধনী ব্যাটসম্যানের।
দুই বছর পর টেস্ট অভিষেক, দ্বিতীয় টেস্টেই শতক। সংস্করণ বদলেছে, বলের রং বদলেছে—ওয়ার্নারের ব্যাটিংয়ের ধরন বদলায়নি। শুরুতে নিউ সাউথ ওয়েলসের হয়েই কখনো ইনিংস উদ্বোধনের স্বপ্ন দেখেননি, সেই ওয়ার্নার ১১২ টেস্ট খেলে এসে গতকালও বললেন, এখনো চিমটি কাটতে হয় তাঁর স্বপ্ন না বাস্তব বুঝতে!
ক্যারিয়ারে অবশ্য বিতর্কেও কম জড়াননি। কখনো জো রুটকে ঘুষি মেরেছেন, কখনো হয়ে উঠেছেন ‘স্যান্ডপেপার’-এর অলিখিত ‘নেতা’, অধিনায়কত্বের কোনো ভূমিকা থেকে অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট থেকে আজীবন নিষিদ্ধ হয়েছেন, কখনো কোচের দেওয়া হোমওয়ার্ক না করে ফিরে যেতে হয়েছে সফর থেকে।
কখনোবা তিনি কেন বিদায়ী সংবর্ধনা পাবেন, তা নিয়ে কেউ তুলতে চেয়েছেন ঝড়। তবে ওয়ার্নার ফিরে আসার গল্প লিখেছেন বারবার। আগের সিরিজে ৯৫ রান করার পর ট্রিপল সেঞ্চুরি করে, কখনোবা মাত্র পঞ্চম ব্যাটসম্যান হিসেবে টেস্টের প্রথম সেশনেই শতকের বিরল কীর্তি গড়ে। সর্বশেষ পার্থে সিরিজের প্রথম টেস্টে বড় শতকে জবাব দিয়েছেন সমালোচনার, আরেকবার জানিয়েছেন, চাইলেই আরও কিছুদিন খেলে যেতে পারতেন হয়তো।
সিরিজ আগেই জিতে গেছে অস্ট্রেলিয়া, এবার লক্ষ্য পাকিস্তানকে ধবলধোলাই করা। আর ক্যারিয়ারের শেষ টেস্টে এসেও ওয়ার্নারের চোখ উন্নতিতে, ‘এমনকি আমার শেষ টেস্টেও আমি উন্নতি করতে নিজের সেরাটি দিয়ে চেষ্টা করছি। রান করতে ক্ষুধার্ত, অন্য কোনো ম্যাচের চেয়ে আলাদা নয়। আমি শুধু এ পরম্পরাটা রেখে যেতে চাই, যেভাবে চাও সেভাবেই খেলতে পারো, স্বাধীনতা নিতে খেলতে পারো, যদি চাও তো জো রুটের মতো রিভার্স সুইপ খেলতে পারো। তোমার সেই সামর্থ্য আছে, শুধু নিজের ওপর আস্থা ও বিশ্বাস রাখতে হবে।’
তাঁর জায়গায় কে আসতে পারেন, কদিন আগে এমন প্রশ্নের জবাব দিয়েও পড়েছিলেন সমালোচনায়। এদিন একই ধরনের এক প্রশ্নের জবাবে বললেন, ‘আমাদের অনেক মেধাবী খেলোয়াড় আছে, অনেকে আছে, যারা এই মুহূর্তে তিন সংস্করণে জায়গা নিতে পারে। সব সময়ই পরিবর্তন হয়, সব সময়ই লোকে অবসর নেয়, কেউ ব্যর্থ হয়। অন্যদের সেখানে আসতে হয়।’
তা আসতে হয়, আসবেনও। তবে ওয়ার্নারের মতো কেউ আসবেন কি না, প্রশ্ন সেটিই। ডেভিড অ্যান্ড্রু ওয়ার্নার যে আর দশজন অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটসম্যানের চেয়ে একটু আলাদাই ছিলেন।