বাংলাদেশকে হারিয়ে প্রথমবার টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে ওঠার পর আফগানদের বাঁধনহারা উচ্ছ্বাস
বাংলাদেশকে হারিয়ে প্রথমবার টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে ওঠার পর আফগানদের বাঁধনহারা উচ্ছ্বাস

টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ২০২৪

সেমিফাইনালে আফগানিস্তানই একমাত্র চমক

আজ থেকে ১৫ দিন আগেও যে চার দলকে আপনি টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সেমিফইনালে জায়গা দিয়েছিলেন, তা কি মিলে গেছে?

শক্তি–সামর্থ্যের বিচারে ভারত ও ইংল্যান্ডকে বেশির ভাগ মানুষই হয়তো রেখেছিলেন। দক্ষিণ আফ্রিকাকেও আগেভাগেই বাদ দিয়ে দেওয়ার কোনো কারণ নেই। কিন্তু আফগানিস্তানকে নিয়ে এত দূর ভেবেছেন, এমন লোক হয়তো খুব বেশি নেই।

বিশ্বমঞ্চে বড় কিছুর আভাস গত বছরই দিয়ে রেখেছিল আফগানিস্তান। ওয়ানডে বিশ্বকাপে হারিয়েছে ইংল্যান্ড, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কার মতো দলকে। গ্লেন ম্যাক্সওয়েল ২০১ রানের অতিমানবীয় ইনিংসটা না খেললে সেবারই সেমিফাইনালের দৌড়ে ভালোভাবে টিকে থাকত। ৭ মাস আগের আক্ষেপ ভুলে এবারের টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ঠিকই শেষ চারে জায়গা করে নিল আফগানরা।

অথচ সুপার এইটে নিজেদের প্রথম ম্যাচে ভারতের কাছে আফগানিস্তান বড় ব্যবধানে হেরেছিল। বিশ্বকাপের সহ–আয়োজক ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে হার আরও বাজেভাবে। তবে এর আগেই তারা হেসেখেলে শেষ আটে উঠে গিয়েছিল। উগান্ডা ও পাপুয়া নিউগিনির বিপক্ষে বড় ব্যবধানে জয় প্রত্যাশিতই ছিল।

নিউজিল্যান্ডকে বড় ব্যবধানে হারিয়ে এবারের বিশ্বকাপে বড় কিছুর আভাস দিয়ে রেখেছিল আফগানিস্তান

কিন্তু সব ধরনের বিশ্বকাপ মিলিয়ে গত ৬ আসরের প্রতিটিতে সেমিফাইনালে খেলা নিউজিল্যান্ডকে মাত্র ৭৫ রানে গুটিয়ে দিয়ে ৮৪ রানের জয়টা ক্রিকেট বিশ্লেষকের নড়েচড়ে বসতে বাধ্য করে।

গ্রুপ পর্বের বাধা পেরোনোর পথে কিউইবধ আর সুপার এইটের বাধা টপকানোর পথে অস্ট্রেলিয়াবধ, আরেকটি আফগান–রূপকথা লিখতে রশিদ খানের দল হয়তো তাসমান সাগরপারের দুই প্রতিবেশীকে ‘টার্গেট’ করে রেখেছিল!

সব ম্যাচ জিতে সেমিফাইনালে ওঠা একমাত্র দল হলে কী হবে, দক্ষিণ আফ্রিকার কোনো জয়ই ঠিক স্বাচ্ছন্দ্যময় ছিল না। শুরুতে অনেকে হয়তো ভেবেছিলেন, নিউইয়র্কের মতো ড্রপ ইন পিচে টানা ৩ ম্যাচ খেলতে হয়েছে বলেই ডি কক–রাবাদা–ক্লাসেনরা নিজেদের স্বাভাবিক খেলাটা খেলতে পারেননি।

তবে নিউইয়র্কের বাইরে গিয়েও প্রোটিয়ারা জয়ের ধারা যেমন অব্যাহত রেখেছে, একই সঙ্গে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাও চালিয়ে যেতে হয়েছে। লঙ্কানদের ৭৭ রানে অলআউট করে দিলেও এইডেন মার্করামের দলের জিততে লেগেছে ১৬.২ ওভার। নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষেও ছোট লক্ষ্য তাড়া করতে খেলতে হয়েছে ১৯তম ওভার পর্যন্ত। আম্পায়ারের একাধিক সিদ্ধান্ত পক্ষে না গেলে বাংলাদেশের কাছেই হয়তো হারতে হতো প্রোটিয়াদের। আর নেপালকে অবিশ্বাস্যভাবে ১ রানে হারানো নিয়ে তো এখনো চর্চা হতে পারে। 

দক্ষিণ আফ্রিকা সব ম্যাচ জিতে সেমিফাইনালে উঠেছে

গ্রুপ পর্বে চারে–চারের পর সুপার এইটে তিনে–তিন। শেষ আটে দক্ষিণ আফ্রিকা প্রথম জয় পেয়েছে টুর্নামেন্টের আরেক সহ–আয়োজক ও বিশ্বকাপ আবির্ভাবেই চমকে দেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে। প্রোটিয়াদের পরের জয়টা টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপের বর্তমান চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে।

দারুণ সেই জয়েও অবশ্য ডি কক–ক্লাসেনদের সেমিফাইনালে খেলা নিশ্চিত হয়নি। কারণ, নেট রান রেটে বেশ পিছিয়ে ছিল। ক্যারিবীয়দের বিপক্ষে সর্বশেষ ম্যাচটা তাই হয়ে দাঁড়িয়েছিল অলিখিত ‘কোয়ার্টার ফাইনাল’। বৃষ্টিবিঘ্নিত সেই ম্যাচের শেষ ওভারে জিতে রাসেল–পুরানদের হৃদয় ভাঙে দক্ষিণ আফ্রিকা।

এক দশক ধরে বৈশ্বিক শিরোপা জিততে না পারা ভারতও দক্ষিণ আফ্রিকার মতো ‘চোক’ করে চলেছে। তবে তা নকআউট পর্বে। এর আগের বাধাগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই হেসেখেলে উতরে যায় তারা। তাই রোহিত শর্মার দল সেমিফাইনালে উঠতে না পারলেই বরং তা হতো এবারের বিশ্বকাপের সবচেয়ে বড় অঘটন।

গ্রুপ পর্বে ভারতের যা একটু কষ্ট করতে হয়েছে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানের বিপক্ষে। উল্টোভাবে বললে, পাকিস্তানই জেতা ম্যাচটা ভারতের হাতে তুলে দিয়েছে। পাকিস্তান ম্যাচের আগে ও পরে আয়ারল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে অনায়াস জয়ই পেয়েছে ভারত। ভেজা মাঠের কারণে কানাডার বিপক্ষে ম্যাচটা পরিত্যক্ত হলেও গ্রুপসেরা হয়ে সুপার এইটে ওঠার ক্ষেত্রে কোনো প্রভাব ফেলেনি।

দাপট দেখিয়ে সেমিফাইনালে পৌঁছে ভারত

সুপার এইটের তিন ম্যাচেই আগে ব্যাট করে জিতেছে ভারত। আফগানিস্তান আর বাংলাদেশ রোহিতের দলের বিপক্ষে কোনো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি। যা একটু লড়াই করেছে অস্ট্রেলিয়া। আইসিসির টুর্নামেন্টে ভারতের ‘যম’ হয়ে ওঠা ট্রাভিস হেড পরশুর ম্যাচটিতেও ভয়ংকর হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু এবার আর রোহিত–কোহলিদের নিরাশ করতে পারেননি। যশপ্রীত বুমরার বলে হেডের ‘মুণ্ডুপাত’ হওয়ার পর আর কেউ বলার মতো কিছু করতে না পারলে অপরাজিত থেকে শেষ চারে ওঠা নিশ্চিত হয়েছে ভারতের।

সেই তুলনায় ইংল্যান্ডের সেমিফাইনালে ওঠার গল্পটা সবচেয়ে রোমাঞ্চকর। গত বছর ওয়ানডে বিশ্বকাপ ধরে রাখার অভিযানে গিয়ে ভরাডুবি হয়েছিল ইংলিশদের। প্রতিবেশী স্কটল্যান্ডের সঙ্গে বৃষ্টিতে ম্যাচ পরিত্যক্ত হওয়ার পর চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী অস্ট্রেলিয়ার কাছে এবারও দেয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছিল বাটলার–বেয়ারস্টোদের। অস্ট্রেলিয়া তো ইচ্ছাকৃতভাবে স্কটল্যান্ডের কাছে হেরে ইংল্যান্ডকে গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় করে দেওয়ার রসিকতাসুলভ হুমকিও দিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত তেমন কিছু হয়নি। নিজেরা ওমান ও নামিবিয়ার বিপক্ষে জিতলে এবং স্কটল্যান্ড অস্ট্রেলিয়ার কাছে হারলে সুপার এইটে পৌঁছে যায় ইংল্যান্ড।

আর দুটি বাধা পেরোলেই প্রথম দল হিসাবে টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপের শিরোপা ধরে রাখবে ইংল্যান্ড

এখানেও বাটলাদের গল্পটা রোলার কোস্টারের মতো। শুরুতেই স্বাগতিক ইংল্যান্ডের বিপক্ষে দাপুটে জয়, এরপর দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে হার। শেষ ম্যাচটা ‘করো নয়তো মরোয়’ পরিণত হলেও প্রতিপক্ষের নাম যুক্তরাষ্ট্র বলেই কোনো চাপ ছিল না ইংলিশদের। বল হাতে ক্রিস জর্ডানের হ্যাটট্রিক আর ব্যাট হাতে অধিনায়ক বাটলারের ‘মহাপ্রলয়ে’ খুব সহজেই মার্কিনিদের হারিয়ে টানা চতুর্থবার টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে পৌঁছে যায় ইংল্যান্ড।