হেন কোনো ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ নেই, যেখান থেকে ডাক আসেনি তাঁর জন্য। আইপিএল থেকে দুবার, মুলতান সুলতানস প্রস্তাব দিয়েছিল শেষ পিএসএলে খেলতে, এরপর ডাম্বুলা অরা থেকে ডাক আসে এলপিএলের জন্য। সবাইকেই ‘না’ বলা তাসকিন আহমেদ মাঝখানে ইয়র্কশায়ার কাউন্টি ক্লাবে খেলার প্রস্তাবেও একই উত্তর দিয়েছেন—‘না’।
বার বার ‘না’ বলতে বলতে তাসকিন এখন হেসে হেসেও ‘না’ বলতে শিখে গেছেন। সেই হাসি তাঁর আসে আসলে একটা আশা থেকে; এবার তো ‘না’ বলছি, পরেরবার নিশ্চয়ই ‘হ্যাঁ’ বলতে পারব। এবার নাহয় বিসিবি অনাপত্তিপত্র দেয়নি, পরেরবার দেশের খেলা না থাকলে দেবে না কেন! এখন তো ১ টাকার প্রস্তাব ফেরাচ্ছি, পরেরবার নিশ্চয়ই সেটা ১০ টাকার হয়ে ফিরবে।
বিসিবি অনাপত্তিপত্র না দেওয়ায় একটার পর একটা ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগকে ‘না’ বলা তাসকিন গতকাল বিকেলে দেশে ফিরেছেন বিদেশের মাটিতে জীবনের প্রথম ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ খেলে। খেলে না বলে ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগের রোমাঞ্চ গায়ে মেখে বলাই ভালো।
হারারেতে বুলাওয়ে ব্রেভসের হয়ে জিম আফ্রো টি-১০ টুর্নামেন্টে খেলেছেন তাসকিন। ১০ ওভারের খেলা, একজন বোলারের ভাগে সর্বোচ্চ ২ ওভার। এই খেলা তো শুরুর আগেই শেষ! তবে বিপিএলের বাইরে আর কোনো ফ্র্যাঞ্চাইজি টি-টোয়েন্টিও না খেলা তাসকিন জীবনের প্রথম টি-টেন ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগেই বাজিমাত করে এসেছেন। ৭ ম্যাচ খেলে ১১ উইকেট, টুর্নামেন্টের লিগ পর্বে এর বেশি উইকেট পাননি আর কোনো বোলারই।
সব মিলিয়ে তাসকিনের কাছে এ এক অন্য রকম অভিজ্ঞতা। কাল বিকেলে বিমানবন্দর থেকে বাসায় যাওয়ার পথে মুঠোফোনে জানালেন সে কথাই, ‘বিদেশে প্রথম ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ খেললাম। তার ওপর টি-টেন, এটাও প্রথম। ১০ ওভারের খেলা কখনো খেলিনি। পুরো ভিন্ন অভিজ্ঞতা। টি-টেনের মতো খেলায় কঠিন পরিস্থিতিতে বোলিং করেছি। একটা ভালো অভিজ্ঞতা হয়েছে।’
সেই অভিজ্ঞতা তাসকিনকে এখন এই আত্মবিশ্বাসও দিচ্ছে যে ‘নিজের সামর্থ্য পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারলে টি-টেন বলেন বা টেস্ট, যেকোনো সংস্করণেই ভালো করা সম্ভব। নিজেকে কাজে লাগাতে পারলে বিশ্বের যেকোনো জায়গায় যে কারও আমার বল খেলতে কষ্ট করতে হবে।’
কম ওভারের খেলায় চাপও বেশি। তার ওপর আপনি যদি বিদেশি খেলোয়াড় কোটায় খেলেন, তাহলে প্রত্যাশার ভার আরও বেশি বইতে হয়। সেই চাপ যে সহজেই কাটিয়ে উঠতে পেরেছেন, তাসকিন তার জন্য বিশেষভাবে ধন্যবাদ দিয়েছেন বুলাওয়ে ব্রেভসের টিম ম্যানেজমেন্টকে, ‘বুলাওয়ে ব্রেভসের টিম ম্যানেজমেন্ট অনেক ভালো। আমি একটা ম্যাচ কম খেলেছি। তিন ম্যাচ খেলার পর বলেছি, আমি ছোটখাটো কিছু সমস্যা বোধ করছি। ওরা বলল, “কোনো সমস্যা নেই। বিশ্রাম নাও।”’
অধিনায়ক সিকান্দার রাজার প্রসঙ্গও তাঁর কথায় এসেছে আলাদা করে, ‘সিকান্দার রাজা অনেক সাহায্য করেছেন আমাকে। ওখানে হালাল খাবারের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন, মানসিক সমর্থন দিয়েছেন।’
এই একটা ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ খেলেই তাসকিনের উপলব্ধি, বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা যদি বছরে দুই-তিনটি এ রকম লিগে খেলার সুযোগ পান, বিদেশি খেলোয়াড় হিসেবে খেলার মানসিক চাপটা তাঁরা নিতে পারেন, সেটা তাঁদের আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আরও বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠতে সাহায্য করবে।
কিন্তু তাসকিনের নিজের বেলায় ব্যাপারটা কী দাঁড়াচ্ছে? দুই-তিনটা দূরে থাক, বছরে একটা ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ খেলারও তো সুযোগ পান না! এ নিয়ে তাঁর মন খারাপ আছে, কিন্তু কোনো অভিযোগ নেই। তাসকিন এটা ভালো করেই বোঝেন যে বিসিবি এখন খেলোয়াড়দের জন্য যে ‘ওয়ার্ক লোড ম্যানেজমেন্ট’ নীতি নিয়েছে, সে কারণেই তাঁর পক্ষে সম্ভব নয় সব ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগের আহ্বানে সাড়া দেওয়া, ‘এখন ম্যানেজমেন্ট চেষ্টা করে, সবাইকে ঘুরিয়ে–ফিরিয়ে খেলাতে। এশিয়া কাপ, বিশ্বকাপের মতো বড় ইভেন্টে আমি নিজেই চাইব সব ম্যাচ খেলতে। সামনে বড় টুর্নামেন্ট আছে, ওয়ার্ক লোড বেশি। এসব কারণেই মূলত আমাকে এনওসি না দেওয়া।’
বিসিবি অবশ্য তার জন্য কিছু ক্ষতিপূরণও দিয়েছে ক্রিকেটারদের, এ রকম পরিস্থিতিতে ভবিষ্যতেও দেবে। তবে তাসকিনকে আশা দেখাচ্ছে একটা প্রতিশ্রুতি, ‘আমি আশাবাদী যে সামনে আমাকে অনেক খেলায়ই এনওসি দেবে, বোর্ড থেকে এটা আমাকে বলেছে। আশা করি সামনে আমার চাহিদাও আরও বাড়বে। যখন খেলা কম থাকবে, বিসিবি হয়তো আমাকে এনওসি (অনাপত্তিপত্র) দিয়েও দেবে।’
ভবিষ্যতের আশায় তাসকিন খারাপ লাগাটাকে মনে বেশি জায়গা দিতে চান না। এর মধ্য থেকেই বরং খুঁজে নেন ইতিবাচক দিক। ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ যেহেতু অর্থেরই হাতছানিই আসলে, ডাক পেয়েও তাতে না খেলা মানে মোটা অঙ্কের টাকা হাতছাড়া হয়ে যাওয়া। তাতে মন যদি খারাপ হয়ও, মনকে তিনি এই বলে ‘ক্ষতিপূরণ’ দেন যে, ‘এখন তো ১ টাকা দিয়ে ডাকছে, সামনে যেন ১০ টাকা দিয়ে ডাকে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আরও ভালো খেলব, তখন আরও বেশি টাকা দেবে।’
ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের অন্য অর্থই হলো টাকা। তাসকিনের উদাহরণটাও তাই টাকার অঙ্কেই এল। তবে তাঁর আসল টি-১০ শিক্ষা তো ওটাই—সামর্থ্যের অনুবাদ যদি হয় পারফরম্যান্স, টি-১০ কি টেস্ট; সবই এক।