সবাই পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী মানুষ হতে পারেন না। দীনেশ লাড মনে করেন তাঁর সেই সম্ভাবনা আছে। তবে তাঁর ‘পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী মানুষ’ হওয়ার পথটা একটু অন্য রকম। আরেকজনের সফলতা দেখে নিজেকে ধনসম্পদে পরিপূর্ণ বলে মনে হবে তাঁর! সেই ব্যক্তিটি কে? রোহিত শর্মা!
আহমেদাবাদের নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামে ১৯ নভেম্বর রোহিত যদি বিশ্বকাপ উঁচিয়ে ধরতে পারেন, তাহলে দীনেশ লাডের মনে হবে, তিনিই পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী মানুষ।
দীনেশ রোহিতের শৈশবের কোচ। ক্রিকেটের ‘অ আ...ক খ’ শিখেছেন তাঁর কাছে। দীনেশ এ জন্য কখনো অর্থ নেননি তাঁর কাছ থেকে। শুধু রোহিত কেন, ক্রিকেট শেখানোর জন্য কখনোই কারও কাছ থেকে অর্থ নেননি দীনেশ। পেশায় রেলওয়ের সাবেক এই কর্মচারী ক্রিকেটারও ছিলেন। খেলা ছাড়ার পর ৩০ বছরের কোচিং ক্যারিয়ারে অনেককেই ক্রিকেটার বানিয়েছেন দীনেশ। ভারত জাতীয় দলের রোহিত শর্মা ও শার্দুল ঠাকুর তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
মুম্বাইয়ের উত্তর–পশ্চিমাঞ্চলের শহর বোরিভালিতে স্বামী বিবেকানন্দ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের কোচ হিসেবে অনেককেই ক্রিকেটার বানিয়েছেন দীনেশ। তাঁর সব ‘ছাত্র’ তো আর জাতীয় দলে সুযোগ পাননি। বিভিন্ন পর্যায়ের ক্রিকেট খেলছেন। কিন্তু সবার জন্যই এক রকম নীতি মেনেছেন দীনেশ, ‘(ক্রিকেটের জন্য) আমি কখনো কারও কাছ থেকে টাকা নিইনি। কোনো মা–বাবার কাছ থেকে টাকা নিইনি।’
দীনেশ লাড এই কথা বলেছেন গতকাল স্কুলে সংবাদ সংস্থা এএফপিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে।
বিশ্বকাপে বুধবার মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে সেমিফাইনালে নিউজিল্যান্ডের মুখোমুখি হবে ভারত। রোহিতের অধিনায়কত্বে লিগ পর্বে সব ম্যাচ (৯) জিতে সেমিফাইনালে উঠেছে ভারত। দীনেশের সে জন্য খুশির অন্ত নেই। নিজেকে তাঁর ‘পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ’ মনে হচ্ছে! আর সেমিফাইনাল জিতে ভারত যদি পরে চ্যাম্পিয়ন হয়, তাহলে? দীনেশের মুখেই শুনুন, ‘যদি তার (রোহিত) হাতে ট্রফি দেখি, তখন নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী মানুষ মনে হবে।’
বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ পাঁচ রান সংগ্রাহকের তালিকায় আছেন রোহিত। ৯ ম্যাচে ৫৫.৮৮ গড়ে ১ শতকসহ করেছেন ৫০৩ রান। একমাত্র ক্রিকেটার হিসেবে ওয়ানডেতে তিনটি দ্বিশতকের কীর্তিও তাঁর। মজার ব্যাপার, রোহিতের শৈশবে তাঁর ব্যাটিং নয়, বোলিং মনে ধরেছিল দীনেশের।
১৯৯৯ সালে এক গ্রীষ্মকালীন ক্যাম্পে দীনেশের স্কুলের বিপক্ষে বোলিং করেছিলেন রোহিত, মুগ্ধ হয়েছিলেন সেই বোলিং দেখেই, ‘ম্যাচটা ছিল ১০ ওভারের। ওদের (রোহিতদের) দল ১০ ওভারে ৬৭ রান তুলেছিল। আমরা ৭–৮ ওভারে তাড়া করে জিতে যাই। কিন্তু ম্যাচে রোহিতের অফ স্পিন দেখেছিলাম—ব্যাটিং না—সে যেভাবে বোলিং করল...মাত্র ২ ওভারে ৫–৬ রান দিয়ে ১টি উইকেটও পেয়েছিল।’
রোহিতে মুগ্ধ দীনেশ লাড তাঁকে নিজের স্কুলে নিয়ে আসতে চাইলেন। রোহিত তখন থাকতেন তাঁর আঙ্কেলের সঙ্গে। দীনেশ স্কুলের পরিচালকের (হেডমাস্টার) সঙ্গে এ নিয়ে কথাও বললেন। সে সময় রোহিতের আঙ্কেলকে দীনেশ বলেছিলেন, ‘আপনার ভাতিজা ক্রিকেটে খুব ভালো।’ কিন্তু একটা সমস্যা ছিল। দীনেশের মুখেই শুনুন, ‘ওর (রোহিতের) আঙ্কেল ফি জানতে চাইল, যেটা মাসে ২৭৫ রুপি করে। তিনি বললেন, “এটা দেওয়ার মতো সামর্থ্য নেই।”’
দীনেশ এরপর নিজের স্কুলের পরিচালকের সঙ্গে কথা বলেন। তাঁর ভাষায়, ‘আমি পরিচালকের সঙ্গে দেখা করে তাকে বলি, স্যার, ছেলেটা খুব গরিব হলেও ভীষণ প্রতিভাবান। দয়া করে তাকে একটি বৃত্তি দিন। এরপর রোহিত আমাদের স্কুলে যোগ দেয়।’
কয়েক বছর পর দীনেশ বুঝতে পারেন, রোহিত নামের ছেলেটির মধ্যে আসলে বোলার নয়, ব্যাটসম্যানের সত্তা লুকিয়ে! দীনেশ স্মৃতিচারণা করেন, ‘একদিন অনুশীলন শুরুর আগে গেটে দেখি, একটি ছেলে সোজা ব্যাটে ব্যাট করছে। ভাবলাম ছেলেটি কে? গিয়ে দেখি রোহিত।’ দীনেশ এরপর আর দেরি করেননি। ভারত জাতীয় দলে দীনেশ এখন যে পজিশনে খেলেন, সেই ওপেনিং পজিশনেই তুলে আনেন রোহিতকে। দীনেশ বলে যান, ‘একটি ম্যাচে সে ১৪০ করেছিল। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। সে সহজাত ব্যাটসম্যান, কিছুই শেখাতে হয়নি।’
দীনেশ সে সময় রোহিতের মধ্যে একটি ব্যাপার খেয়াল করেছিলেন, যেটি বাকিদের চেয়ে তাঁকে আলাদা করে তুলেছিল, ‘আমরা ২৪০ রান তাড়া করতে নেমে ৩০ রানে ৪ উইকেট হারাই। তাঁকে বার্তা পাঠাই, “তোমাকে ব্যাটিং করে যেতে হবে নইলে আমরা টুর্নামেন্ট থেকে বাদ পড়ে যাব।” সে দ্বাদশ খেলোয়াড়ের মাধ্যমে ফিরতি বার্তায় বলেছিল, “স্যারকে বলো দুশ্চিন্তা না করতে। আমরা ম্যাচটা জিতব।” সে খুবই আত্মবিশ্বাসী।’
এক বন্ধুর মাধ্যমে ১৯৯৩ সালে ক্রিকেট কোচিংয়ে জড়ান দীনেশ। মুম্বাইয়ের বয়সভিত্তিকে বিভিন্ন পর্যায়ে এবং রঞ্জি ট্রফি মিলিয়ে ৯০ ক্রিকেটারকে কোচিং করিয়েছেন দীনেশ। এই তালিকায় তাঁর ছেলে সিধেশও আছেন, তিনি গোয়ার ব্যাটসম্যান। ভারত জাতীয় দলের পেসার শার্দুলের কাছে দীনেশ হলেন ‘আমার অভিভাবক’।
ক্রিকেটার থাকতে দীনেশ ভারতের খ্যাতিমান কোচ রমাকান্ত আচেরকারের সংস্পর্শে এসেছিলেন। ভারতের কিংবদন্তি শচীন টেন্ডুলকারের কোচ ছিলেন আচেরকার। তাঁর মতো দীনেশও খেলাধুলায় কোচিংয়ে অবদানের জন্য জাতীয় পুরস্কার ‘দ্রোণাচার্য অ্যাওয়ার্ড’ পেয়েছেন (২০২২)। এখন তো দীনেশের খ্যাতি ভারতের সীমানা ছাড়িয়ে গেছে। দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক পেসার মাখায়া এনটিনি যেমন দীনেশকে ধন্যবাদ জানিয়ে একটি ভিডিও বার্তা পাঠিয়েছেন তাঁকে।
এনটিনির ছেলে থান্ডোও পেসার এবং খেলছেন দক্ষিণ আফ্রিকার ঘরোয়া ক্রিকেটে। দীনেশ থান্ডোকেও কোচিং করিয়েছেন। ছেলের ব্যাটিং ও বোলিংয়ে উন্নতির জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে ভিডিও বার্তায় এনটিনির বলা কথাগুলো যেন দীনেশের জীবনেরই প্রতিচ্ছবি—‘আমার সন্তানকে তুমি যে ভালোবাসা দিয়েছ, সেটির প্রতিফলন দেখতে পাওয়া আমার জন্য ভীষণ সম্মানের। তুমি কোচ হিসেবে এসব করোনি, এসব করেছ খেলাটির প্রতি ভালোবাসা থেকে।’