শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে আজ টি-টোয়েন্টি সিরিজের জন্য বাংলাদেশ জাতীয় দলে প্রথমবার ডাক পেয়েছেন স্পিনার আলিস আল ইসলাম। ২৭ বছর বয়সী এই ক্রিকেটারের শুরুর গল্পটা গত ২৭ জানুয়ারি প্রথম আলোয় প্রকাশ হয়েছিল। জাতীয় দলে ডাক পাওয়ায় আলিসের সেই গল্প আজ পুনঃ প্রকাশিত হলো।
নাজমুল হোসেনের চোখেমুখে বিস্ময়। বলটা অফ স্পিন হবে—এমন বুঝে অফ সাইডে ব্যাট চালালেন। কিন্তু বল ঢুকল ভেতরে, ইনসুইং!
ঠিকই পড়েছেন। বলটা অফ স্টাম্পের বাইরে থেকে সুইং করে এসেছে বাঁহাতি নাজমুলের প্যাডে। প্রশ্ন হলো, অফ স্পিনারের বল সুইং করে কীভাবে? সুইং তো হয় পেসারদের বলে!
সে রহস্য ভেদ করার আগেই ইয়াসির আলী স্টাম্পড। এবার আলিসের আউটসুইংয়ের ফাঁদ। ইয়াসির ডানহাতি, তাঁর সামনে দিয়ে বলটি বেরিয়ে গেল আর তাতে যে–কেউ বোলারকে নিয়ে ধন্দে পড়তে পারেন।
বলা হচ্ছে আলিস আল ইসলামের কথা। ক্রিকইনফো প্রোফাইলে যাঁর পরিচয় ‘ডানহাতি অফ স্পিনার’। এবারের বিপিএলে তাঁর দল কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ানস। কাল সিলেট স্ট্রাইকার্সের বিপক্ষে ১৭ রানে ৪ উইকেট নিয়ে ম্যাচসেরা ২৭ বছর বয়সী এই স্পিনার।
আলিসকে শুধু স্পিনার বললে তাঁর সামর্থ্যের পুরো ছবিটা পাওয়া যায় না।। আলিসের মতো খেলোয়াড়দের ভারতীয় অফ স্পিনার রবিচন্দ্রন অশ্বিন শুধু ‘বোলার’ হিসেবেই আখ্যা দিতে চান। কারণ, তাঁরা বলটাকে শুধু স্পিন করান না। সুইং, এমনকি সিমও করাতে পারেন। অজন্তা মেন্ডিস, সুনীল নারাইন, মহীশ তিকশানারা এ ঘরানার বোলার।
জিম্বাবুয়ের সিকান্দার রাজাও সম্প্রতি নিজের বোলিং পাল্টে মেন্ডিস বা নারিনদের পথে হাঁটছেন। ক্রিকেটের ভাষায় তাঁরা ‘মিস্ট্রি স্পিনার’, বাংলায় বলতে পারেন রহস্য-স্পিনার। বাংলাদেশে আলিসও সে রকমই একজন। আর টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে তাঁর মতো বোলাররা কতটা কার্যকরী হতে পারে, তা তো গতকালই দেখা গেল।
কুড়ি ওভারের এই খেলার চাহিদাটা বোঝেন কুমিল্লার কোচ মোহাম্মদ সালাউদ্দিন। সে জন্যই তিনি বছরের পর বছর ওয়েস্ট ইন্ডিজের সুনীল নারাইনকে ধরে রাখছেন। অন্য ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগের ব্যস্ততা শেষ হলেই নারাইন বিপিএলে হাজির, আর বিপিএলে নারাইন মানেই কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ানস। এবার অবশ্য সালাউদ্দিনকে দুবার বিশ্বকাপজয়ী ক্যারিবিয়ানের অনুপস্থিতি টের পেতে দিচ্ছেন না আলিস।
সালাউদ্দিনের মুখেই শুনুন, ‘যেহেতু সুনীল আসেনি, তখন আমার মনে হয়েছে যে বোলিং আক্রমণ আছে, একজন মিস্ট্রি বোলার দরকার। যে খেলাটা নিয়ন্ত্রণ করবে অথবা শুরুতে উইকেট নিয়ে দেবে। এখন সুনীল এলে আমরা অবশ্যই আরেকটু শক্তিশালী হব।’
যাঁকে নিয়ে দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটের অন্যতম সফলতম কোচের এত আস্থা, সেই আলিস এখন পর্যন্ত প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলেননি। লিস্ট ‘এ’খেলেছেন মাত্র ৭টি, টি-টোয়েন্টি ২০টি। পেশাদার ক্রিকেটে আলিসের এত কম ম্যাচ খেলার পেছনেও আছে আরেক গল্প। তিনি ২০১৪ সালে ঢাকার দ্বিতীয় বিভাগ ক্রিকেট লিগে কাঁঠালবাগান গ্রিন ক্রিসেন্ট ক্লাবের হয়ে ক্রিকেট খেলা শুরু করেন।
ওল্ড ডিওএইচএসে ২০১৭ সালে খেলেছেন প্রথম বিভাগ ক্রিকেট। সেখান থেকেই একসময়ের বিপিএল ফ্র্যাঞ্চাইজি ঢাকা ডায়নামাইটসের নেট বোলার হন, এরপর দলটির খেলোয়াড় এবং প্রতিপক্ষকে চমকে দেন প্রথম ম্যাচেই। ২০১৯ বিপিএলে রংপুর রাইডার্সের বিপক্ষে তাঁকে খেলান ঢাকার কোচ খালেদ মাহমুদ। অভিষেক ম্যাচেই হ্যাটট্রিকসহ ৪ উইকেট!
কিন্তু দুর্ভাগ্য, পেশাদার ক্রিকেটে প্রথম ম্যাচেই আলিসের বোলিং অ্যাকশন প্রশ্নবিদ্ধ। অ্যাকশন নিয়ে লিখিত অভিযোগও করে প্রতিপক্ষ রংপুর রাইডার্স। অ্যাকশন প্রশ্নবিদ্ধ হলেও বিপিএলে আরও ২১ দিন খেলার সুযোগ ছিল আলিসের। কিন্তু নিজের চতুর্থ ম্যাচে হাঁটুর চোটে ছিটকে গেলেন।
নিয়ম অনুযায়ী, ১৪ দিনের মধ্যে বোলিং অ্যাকশন পরীক্ষা দেওয়ার কথা থাকলেও চোটের কারণে সেটা হয়নি। উল্টো দীর্ঘ সময় মাঠের বাইরে থাকতে হয়, করাতে হয় অস্ত্রোপচারও। চোট ও বোলিং অ্যাকশন শুধরে আলিসের খেলায় ফিরতে লেগেছে দুই বছর।
নিয়মিত ঘরোয়া পর্যায়ে ম্যাচ পাচ্ছিলেন না আলিস। সর্বশেষ ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে কোচ সালাউদ্দিনের দল প্রাইম ব্যাংকে ৬ ম্যাচ খেলার সুযোগ পেয়েছেন। এবার সুযোগ হয়ে গেল বিপিএলেও। এবারও আলিসকে শুরু করতে হয় শূন্য থেকে, কুমিল্লার নেট বোলার হিসেবে। নেটে আলিসের বোলিং দেখে কুমিল্লার অভিজ্ঞরাও আলিসকে দলে চেয়েছেন।
সে প্রক্রিয়াটা শুনুন সালাউদ্দিনের মুখে, ‘সে আমাদের সঙ্গে অনুশীলন করেছে, ম্যাচ খেলেছে। আমাদের দলের ক্রিকেটাররাই আমাকে বলেছে, “স্যার, একে নেন!” এটা ওদের কাছ থেকে আসলে অনেক ভালো। কারণ, আমি কাউকে হঠাৎ করে নিয়ে এলে যে–কেউ বলতে পারে, “স্যার তো মনে হয় সুবিধা দিয়ে নিয়ে এসেছে।” আমি এগুলো চাই না। সে ওই সুযোগটা কাজে লাগিয়েছে এবং ভালো করেছে।’
শুধু ম্যাচ খেলার সুযোগ দেওয়া নয়, আলিসের বোলিং অ্যাকশন সমস্যার সমাধানও করেছেন সালাউদ্দিন, ‘আমার সঙ্গেই ছিল প্রাইম ব্যাংকে। ইনজুরির কারণে অনেক দিন ভুগেছে। হাঁটুতে সমস্যা ছিল। তার আগে চাকিংয়ের সমস্যা ছিল। এই ধরনের ছেলেদের আমি সহায়তা করি কেন, কারণ, তারা কখনো খেলাটা ছেড়ে দেয় না। একটা ছেলে যদি চেষ্টা করে, তাহলে আমি যত বড় কোচই হই না কেন, ওই ছেলেকে সাহায্য করা আমার দায়িত্ব। ছেলেটা মনেপ্রাণে চেষ্টা করছে। সারাটা বছর চেষ্টা করছে। তার উন্নতি আমি দেখছি। তাকে সাহায্য করা আমার নৈতিক দায়িত্ব।’
বাংলাদেশ জাতীয় দলও যে এমন একজন বোলার খুঁজছে, তা তো সবার জানা। সালাউদ্দিনও তা মনে করিয়ে দিলেন, ‘আমাদের দেশে আসলে মিস্ট্রি বোলার খুব কম। ছেলেটা অনেক আগে শুরু করেছিল, অনেক ভালো করছিল। এর মধ্যে চাকিংয়ের কারণে অনেক দূরে ছিল। তারপর ওর ফেরাটা খুব কঠিন ছিল। আমরা ওর ওপর বিশ্বাস রেখেছি। ও আমার কাছে অনুশীলন করায় হয়তো আমাদের জন্য একটা সুবিধা ছিল (বিশ্বাস রাখতে)। কারণ, ওকে কাছ থেকে দেখার সুযোগটা হয়েছে। ওর বলে অনেক বৈচিত্র্য আছে। এই ধরনের বোলার আমরা অনেক দিন ধরেই খুঁজছি।’
এমন সুযোগের অপেক্ষায় অনেকটা সময় কেটে গেছে আলিসের। ৫ বছর আগে অভিষিক্ত এই বোলার এর মধ্যে পেশাদার ম্যাচ খেলেছেন মাত্র ২৭টি। তবে আশা হারাননি। বৈচিত্র্যময় বোলিংয়ে একসময় ক্যারিয়ার আলো খুঁজে পাবেই, সে আশা থেকেই আলিসের লড়াই। এখন তাঁর চাওয়া ধারাবাহিকভাবে সুযোগ পাওয়া, ‘যারা একটু আনঅর্থোডক্স, যাদের বোলিংয়ে একটু ভিন্নতা আছে, তাদের যদি সুযোগ দেওয়া হয়, তাহলে আশা করি আমরা ভালো করব।’
আলিসকে সে সুযোগটা করে দিয়েছেন সালাউদ্দিন ও কুমিল্লা, ‘আপনি তো জানেন যে সালাউদ্দিন স্যার বাংলাদেশের এক নম্বর কোচ। তিনি বিশ্বাস করেন যে আমি পারব। তিনি আমাকে দুই বছর ধরে তৈরি করেছেন।’
এ দুই বছরে আলিসকে লড়তে হয়েছে চোটের সঙ্গে, বোলিং অ্যাকশন ভেঙে গড়তে হয়েছে নতুন করে। ক্রিকেট নিয়ে স্বপ্নগুলোও দেখেছে ভাঙাগড়ার খেলা। এখন আবার নতুন করে বড় স্বপ্ন দেখছেন আলিস, সেই বিপিএলের মঞ্চে, যেখান থেকে তাঁর শুরু।