জাকের আলী বিপিএলে খেলছেন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ানসের হয়ে
জাকের আলী বিপিএলে খেলছেন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ানসের হয়ে

বিপিএল: জাকের আলী যেভাবে ‘পাওয়ার হিটার’ হয়ে উঠলেন

টি-টোয়েন্টি ম্যাচে কোথায় ব্যাটিং করতে চাইবেন? প্রশ্নটা এ যুগের যে কোনো ব্যাটসম্যানকে জিজ্ঞেস করলে উত্তর আসবে— টপ অর্ডার। ব্যাটিং পাওয়ার প্লে’র সুবিধাটা কে না নিতে চাইবেন!

মাত্র দুজন ফিল্ডার বাইরে থাকা অবস্থায় বাউন্ডারি মারার কাজটা যতটা সহজ, মাঝের ওভারে পাঁচ ফিল্ডারকে ফাঁকি দেওয়া ততটা নয়। বলও তখন অতটা নতুন নয়। কিছুটা পুরোনো বল বাউন্ডারির ওপারে আছড়ে ফেলার চেয়ে নতুন বলে মারা তুলনামূলক সহজ। সে জন্যই ২০ ওভারের খেলায় আন্দ্রে রাসেলের মতো বিস্ফোরক ফিনিশারের এত কদর। পুরোনো বলে ফিল্ডারের মাথার ওপর দিয়ে ছক্কা মারতে যে হিটিং টেকনিক ও শক্তি দরকার, তা রাসেলের মতো ফিনিশারদের আছে।

বাংলাদেশে সেরকম পাওয়ার হিটার খুঁজতে গেলে বেশির ভাগ সময় হতাশই হতে হয়। তবে এবারের বিপিএলে এই আলোচনায় জাকের আলীর নামটা সবার আগে আসবে। এই মৌসুমে জাকেরকে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ানসের ‘ক্রাইসিস ম্যান’ বলা যায়। মাঝের ওভারে তিনি দলের বিপদে জুটি গড়েছেন বেশ কয়েকবার। কিন্তু দরকারের সময় জাকের ইনিংসের মধ্যেই বদলে ফেলছেন স্টান্স, ‘ব্যাক লিফট’ বদলে হয়ে যাচ্ছেন গলফার কিংবা বেসবল ব্যাটারদের মতো। টি-টোয়েন্টির ভাষায় যাকে বলে ‘পাওয়ার বেস’। সেই শক্তিশালী ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে ১৩ ম্যাচে ৯ ইনিংসে ব্যাট করে জাকের নট আউট ৭ ইনিংসে, ৮৯.৫ গড় ও ১৫১ স্ট্রাইক রেটে রান করেছেন ১৭৯।

২০১৬ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের হয়ে খেলা এই জাকেরকে যারা আগে দেখেছেন, তাদের কাছে সংখ্যাগুলো চোখ কপালে তোলার মতো। তার চেয়েও বেশি অবাক করবে জাকেরের ব্যাটিং ধরন। জাকেরের মুখেই শুনুন পেছনের গল্পটা, ‘এই সেট আপ পুরোটাই স্যার (মোহাম্মদ সালাউদ্দিন) চেঞ্জ করে দিয়েছেন। গত বছরই করেছিলেন। এক বছর ধরে এটা নিয়ে কাজ করছিলাম। এটা যে আগের তুলনায় অনেক ভালো, তা তো ম্যাচেই বোঝা যাচ্ছে।’

২৬ বছর বয়সী এই উইকেটকিপার ব্যাটসম্যানের কাছে টি-টোয়েন্টি মানেই ছিল ক্রিজে নড়াচড়া করা, বোলারের লাইন-লেংথের ধারাবাহিকতা নষ্ট করা। কিন্তু আধুনিক টি-টোয়েন্টি হিটিং তা নয়। মাথার অবস্থান স্থির থেকে এক ডাউন সুইংয়ে ব্যাট চালানোয় ব্যাটসম্যানরা পাচ্ছেন বেশি সাফল্য। কুমিল্লার কোচ সালাউদ্দিনের দেখিয়ে দেওয়া সেই কৌশল রপ্ত করতে অবশ্য ‘ট্রায়াল অ্যান্ড এরর’ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে জাকেরকে।

যার শুরু বিপিএলের নবম আসরের আগে কুমিল্লার প্রস্তুতি ম্যাচে। মাসকো একাডেমিতে ব্যাটিংয়ের মাঝপথেই সালাউদ্দিনের দেখিয়ে দেওয়া কৌশলে ব্যাটিং করে বিশাল ছক্কা মারেন জাকের। ঠিক তখনই জাকেরের উপলব্ধি, খেলোয়াড় হিসেবে পরের ধাপে যেতে হলে মারতে হবে ‘পাওয়ার বেস’ থেকে, ‘প্রথমে আমি মানিয়ে নিতে পারছিলাম না। মাসকোতে গত বছর বিপিএলের আগে প্র্যাকটিস ম্যাচ খেলেছিলাম আমরা। একটা ম্যাচে আমি আমার মতোই খেলছিলাম। অলমোস্ট ফিফটির কাছাকাছি যাওয়ার পর আমার মনে হচ্ছিল, ওকে, স্যারের স্টাইলে একটা মেরে দেখি কী অবস্থা। একটা ছয় মারলাম পরে আমি বুঝতে পারলাম যে নাহ, দিস ইজ দ্য বেস, যেটা আমাকে নেক্সট লেভেলে নিয়ে যেতে পারে। তখনই আমার মাথায় আসছে।’

জাকের আলীর ব্যাটিং–ধরনে বদলের ক্ষেত্রে কোচ সালাউদ্দিনের বিশেষ ভূমিকা আছে

পরের ধাপের চ্যালেঞ্জটা জাকের এবার উতরে গেছেন ভালোভাবেই। অন্য দলের বিদেশি ডেথ বোলারদের বিপক্ষে জাকেরের পাওয়ার হিটিং দেখলেই তা বুঝতে পারবেন। জাকেরের অবশ্য কৌশল বদলানোর আরেকটা ব্যাখ্যা আছে, ‘পাওয়ার হিটিংয়ে বেশি নড়াচড়া করলে কী হয়…আমি আগে একটু বেশিই নড়াচড়া করতাম, স্টাম্পের ওপর উঠতাম, এদিক-ওদিক যেতাম। কিন্তু বেশি নড়াচড়া করলে বেশি গতির যে বলগুলো আসে, ইয়র্কার বা ১৩৫+ গতির যে বলগুলো আসে, সেগুলো কানেক্ট করা যায় না, স্লোয়ার বলগুলোও। আপনি যদি একটা স্ট্যাবল পজিশনে না থাকেন…তখন এসব শট কানেক্ট করা কঠিন। যখন আপনি একটা স্ট্যাবল পজিশনে থাকবেন, পাওয়ার পজিশনে থাকবেন, তখন বলটা পিক করা সহজ হয়। আপনি যদি পিক নাও করেন, ব্যালেন্স ঠিক থাকায় মিস টাইমিংয়েও বল পার হয়ে যায়।’

মজার ব্যাপার হচ্ছে, জাকের নতুন কৌশলে ব্যাটিং করেন ম্যাচের অবস্থা বুঝে। যখন এক-দুই রানের জন্য খেলা দরকার, তখন জাকেরের স্টান্সে বড় কোনো পরিবর্তন দেখা যায় না। কিন্তু চাহিদা যখন চার-ছক্কার, তখন বেরিয়ে আসে জাকেরের ভিন্ন রূপ। আর একই ইনিংসে ঘুরেফিরে দুই ধরনের কৌশলে ব্যাটিং করতে সমস্যা হয় না তাঁর, ‘হ্যাঁ, আমি পারি (দুই ধরনের কৌশলে খেলতে)। কারণ প্রথম থেকেই তো আপনি মারতে পারবেন না। আপনি আন্দ্রে রাসেলকে দেখেন, সেও কিন্তু প্রথম দুই-তিনটা বল একদম নরমাল খেলে। সেই প্রসেস আমিও ফলো করি। ১৭-১৮ ওভারে নামলে এক হিসাব। এর আগে নামলে অবশ্যই দেখতে হবে। যদি ১৮ নম্বর ওভারে ঢুকি, তখন তো অবশ্যই গিয়েই মারতে হবে।’

বিপিএলে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ানসের ‘ক্রাইসিস ম্যান’ হয়ে উঠেছেন জাকের আলী

জাকেরের এই মানিয়ে নেওয়ার দক্ষতাটা এসেছে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট থেকে। জাতীয় ক্রিকেট লিগ কিংবা বাংলাদেশ ক্রিকেট লিগ, বাংলাদেশ এই দুই প্রথম শ্রেণির প্রতিযোগিতায় গত তিন বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে বড় ইনিংস খেলছেন তিনি। সেখানেও ম্যাচের অবস্থা বুঝে মেরে খেলার ক্ষেত্রে পাওয়ার বেস ব্যবহার করেন জাকের, ‘লঙ্গার ভার্সনেও তো মারতে হয় মাঝেমধ্যে। ওয়ানডেতেও মারতে হয়। তখন আমি এই বেসেই মেরেছি। এবারের বিপিএলের আগে প্রস্তুতিও ভালো হয়েছে। তাই হয়তো বিপিএলটা ভালো গেল।’

চার দিনের ম্যাচের পর ২০ ওভারের ম্যাচে মানিয়ে নেওয়া সহজ নয়। জাকেরের অবশ্য এই মানিয়ে নেওয়াতেই আনন্দ, ‘এটা অবশ্যই ভালো। লঙ্গার ভার্সন ভালো খেলা, সঙ্গে টি-টোয়েন্টিও। এটা সহজ কাজ নয়। এই জিনিসটা আমি উপভোগ করি। আমার ভাবতে ভালো লাগে যে আমি সব ফরম্যাটে ভালো করছি। লঙ্গার ভার্সনের স্লো খেলা থেকে টি-টোয়েন্টিতে কুইক খেলা, এটা আসলে বোঝানো যাবে না যে কত ভালো লাগা কাজ করে। আর এই দুইটা ফরম্যাট আমার খুবই পছন্দ। ফোর ডে আর টি-টোয়েন্টি। কারণ টেস্টে আপনার মাইন্ড একদম ক্লিয়ার, আমি বল ছাড়ব। টি-টোয়েন্টিতেও ক্লিয়ার মাইন্ড, আমি মারব। ব্যাটিংয়ে যাওয়ার আগেও আমি কোচের সঙ্গে কথা বলি, জিজ্ঞেস করি যেন আমাকে ক্লিয়ার প্ল্যান দেওয়া হয়।’

পাওয়ার হিটার হিসেবে নামডাক আছে যাঁর, সেই আন্দ্রে রাসেলের সঙ্গে জাকের আলী

আর ৫০ ওভারের খেলা? প্রশ্নটা শেষ করার আগেই জাকেরের চটজলদি উত্তর, ‘প্রিমিয়ার লিগে (বাংলাদেশের একমাত্র লিস্ট এ টুর্নামেন্ট) আমার পরিসংখ্যান এতটা বাড়েনি। কারণ আমার কোনো স্ট্যাবল পজিশন নেই। আমি একদিন ওপেন করি, আবার কখনো সাতে, চারে। আমি দলের জন্য খেলি। দলের যেখানে দরকার সেখানে খেলি। এ জন্য আমার মনে হয় দলগুলোও সব সময় আমাকে চায়। এটাই আমার অর্জন।’

জাকেরের মতো ব্যাটসম্যানদের পরিসংখ্যান দেখে বিচার করা একটু কঠিন। এ ধরনের খেলোয়াড়দের বুঝতে হলে পরিসংখ্যানের বাইরে যেতে হয়। ম্যাচের অবস্থার সঙ্গে তাঁরা কীভাবে মানিয়ে নেয়, সেটিই বরং আদর্শ মানদণ্ড।

জাকের যে দলের হয়ে এই বিপিএলে খেলছেন, সে দলেরই কোচ সালাউদ্দিন এ কথাটা বোঝাতে গিয়ে মাহমুদউল্লাহর পর বাংলাদেশের সেরা মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান হিসেবে জাকেরের নামটা উল্লেখ করেছিলেন। স্পিন ও পেসে তাঁর ব্যাটিং সামর্থ্য একটা কারণ। সঙ্গে ম্যাচের অবস্থা বুঝে খেলা তো আছেই। আজ ফরচুন বরিশালের বিপক্ষে সেই জাকেরই আরও একবার হয়ে উঠতে পারেন কুমিল্লার ‘ক্রাইসিস ম্যান’।