বাবর আজমদের কল্যাণে উধাও যে আফসোস

বাবর আজমদের ধন্যবাদ না দিয়ে পারছি না। আমার কথা ভেবে কিছুই করেননি। তারপরও ধন্যবাদ কেন? ধন্যবাদ একটা মর্মযাতনা থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য। দুই দিন আগে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ দেখতে আহমেদাবাদ যাওয়ার পরিকল্পনা বাতিল করার পর থেকে যেটি বড় পোড়াচ্ছিল।

চেন্নাই থেকে আহমেদাবাদ অনেক দূর। বিমানেই সোয়া দুই ঘণ্টা। তাতে কী! বিশ্বকাপ ক্রিকেট কাভার করতে আসব আর ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ করব না, এটা হয় নাকি!

দুই দিন আগে দুঃখভারাক্রান্ত মনে সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে এলাম। আহমেদাবাদ থেকে যেসব খবরাখবর পাচ্ছিলাম, তাতে আর সাহসে কুলাল না। উপমহাদেশে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ মানেই ‘যুদ্ধ’। ম্যাচের দিন স্টেডিয়ামে ঢোকাটাও রীতিমতো যুদ্ধ জয় করার মতোই। ম্যাচ শুরু হওয়ার দু–তিন ঘণ্টা আগেই প্রেসবক্সে ঢুকে না যাওয়া মানে অপেশাদারি নিবুর্দ্ধিতা। এরপর আপনি আদৌ সময়মতো ঢুকতে পারবেন কি না, এর যে কোনো নিশ্চয়তা নেই। আহমেদাবাদে এবার নাকি অবস্থা আরও খারাপ।

তার ওপর আগের রাতে বাংলাদেশ-নিউজিল্যান্ড ডে-নাইট ম্যাচ সেরে হোটেলে ফিরতেই একটা বাজবে। তাড়াতাড়ি বিছানায় গেলেও ঘুমাতে ঘুমাতে কমপক্ষে রাত দুইটা। পরদিন আবার তীব্র অপছন্দের ‘আর্লি মর্নিং ফ্লাইট’। জীবনে কোনো দিন আহমেদাবাদে যাইনি। এয়ারপোর্ট থেকে শহর কত দূর, মাঠ কোথায়—কোনো আইডিয়া নেই। হোটেলে চেক ইন করে সময়মতো মাঠে পৌঁছাতে পারব কি না, কে জানে। আকাশচুম্বী হোটেল ভাড়ার কথা আর নাই–বা বললাম।

নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামের প্রবেশমুখে নিরাপত্তা তল্লাশি

আহমেদাবাদ যাওয়ার পরিকল্পনা তাই বাতিল। চেন্নাইয়ের হোটেলে শুয়ে-বসে টেলিভিশনেই না হয় ম্যাচটা দেখি। তারপরও মন কি আর মানে! দুপুরে স্টার স্পোর্টস এই ম্যাচ নিয়ে দামামা বাজাতে শুরু করতেই বড় আফসোস হতে লাগল। না, যাওয়াই উচিত ছিল। ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ হয়তো জীবনে আরও দেখব। কিন্তু বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে কি আর তা দেখা হবে!

এসব ভাবতে ভাবতেই বাবর আজমের চোখজুড়ানো একটা কাভার ড্রাইভ।

রিজওয়ানের সঙ্গে জমে যাওয়া জুটিটা আফসোস আরও বাড়াচ্ছে। দারুণ একটা ম্যাচ হবে বলেই মনে হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত কী হয়েছে, তা তো আপনি জানেনই। পাকিস্তানের ইনিংস শেষে ভারত মাত্র ব্যাটিং করতে নেমেছে, এমন সময় ক্রিকইনফোর বাংলাদেশ প্রতিনিধি মোহাম্মদ ইসামের হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ: আমি আপনার হোটেলের লবিতে। ইসাম এসেছেন বাংলাদেশের প্রবাদপ্রতিম ক্রিকেট সংগঠক সৈয়দ আশরাফুল হকের সঙ্গে দেখা করতে। যিনি সম্পর্কে তাঁর নানা। হোটেল লবির কফি শপে দারুণ আড্ডা দিতে দিতে টেলিভিশনে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ দেখিয়ে ইসামের দুই ভারতীয় সহকর্মীকে বললাম, ‘কী একটা ম্যাচ নিয়ে এমন অকারণ হাইপ! বাংলাদেশ-নেদার‍ল্যান্ডস ম্যাচও তো এর চেয়ে অনেক ভালো হবে।’ আমাকে বিব্রত করে ওরা বিনা দ্বিধায় আমার সঙ্গে একমত হয়ে গেল।

এক লাখ বত্রিশ হাজার আসনের নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামের গ্যালারি ছিল ভরা

বাবর আজমদের ধন্যবাদ দিয়েছিলাম এ কারণেই। পাকিস্তানি ব্যাটিং অমন তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়াতেই না আমার আফসোসটা আর নেই। এমন ঝক্কিঝামেলা করে এই একপেশে ম্যাচ দেখার কোনো অর্থই হতো না। যে ম্যাচের পর মনে হচ্ছে, ভবিষ্যতে বিশ্বকাপে ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা বলতে শুধু ম্যাচ–পূর্ব আবহটাই থাকবে। খেলায় কী হবে, তা তো সবার জানাই।

লেখার শুরুটা একটা ভুল বুঝিয়ে থাকতে পারে। মনে হতেই পারে, বিশ্বকাপ কাভার করতে এসে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ বুঝি এর আগে কখনোই বাদ পড়েনি। পড়েছে, তবে সেটির যৌক্তিক কারণ ছিল। বিশ্বকাপ ক্রিকেট প্রথম কাভার করেছি ১৯৯৬ সালে। বেঙ্গালুরুতে যেদিন ভারত-পাকিস্তান, আমি সেদিন ফয়সালাবাদে শ্রীলঙ্কা-ইংল্যান্ড কোয়ার্টার ফাইনাল কাভার করছি। সেই বিশ্বকাপে বাংলাদেশ ছিল না। আমি তাই আমার ইচ্ছেমতো ম্যাচ বেছে নিতে পেরেছি। কলকাতায় শুধু উদ্বোধনী অনুষ্ঠান কাভার করার পর বাকি বিশ্বকাপ ছিলাম পাকিস্তানে। বিবেচনা ছিল ভেন্যু থেকে ভেন্যুর দূরত্ব। ফাইনাল হবে লাহোরে, এটা তো অবশ্যই।

ধারাভাষ্যকক্ষে শচীন টেন্ডুলকার ও ওয়াকার ইউনিসকে পেয়ে উচ্ছ্বসিত রবি শাস্ত্রী। একই ম্যাচে টেন্ডুলকার ও ওয়াকারের অভিষেকের কথাটাও মনে করিয়ে দিয়েছেন তিনি

আহমেদাবাদে রবি শাস্ত্রীর সঙ্গে কিছুক্ষণ কমেন্ট্রি করলেন শচীন টেন্ডুলকার ও ওয়াকার ইউনিস। ১৯৮৯ সালে একই টেস্টে দুজনের অভিষেক। ম্যাচের চেয়ে দুজনের স্মৃতিচারণার অংশটাই বরং বেশি উপভোগ্য হলো। বিশ্বকাপে ভারত-পাকিস্তান নিয়ে কথায়–কথায় এল ২০০৩ বিশ্বকাপে সেঞ্চুরিয়নে শচীন টেন্ডুলকারের ৯৮ রানের অমর সেই ইনিংস। মাত্র ২৪ কিলোমিটার দূরে থেকেও সেই ইনিংসটা টেলিভিশনে দেখেছিলাম। তা-ও ছাড়া ছাড়াভাবে। সেদিনই যে জোহানেসবার্গে অন্য একটা ম্যাচ কাভার করতে হচ্ছিল। যে ম্যাচে বাংলাদেশ হেরে গিয়েছিল কেনিয়ার কাছে। আমার দুঃখটা যা আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল। টেন্ডুলকারের ওই ইনিংসটা প্রেসবক্সে বসে দেখতে না পারার দুঃখ।

আহমেদাবাদ নিয়ে এমন দুঃখ থাকছে না তো বাবরদের কারণেই। ধন্যবাদ কি আর এমনিই দিচ্ছি!