সিনেমার বড় পর্দায় ‘বিরতি’ শব্দটা মনে আছে? অ্যাডিলেড ওভালে আজ ‘পদ্মা–গঙ্গা’ সিনেমায় সেই বিরতির নাম ছিল ‘বৃষ্টি’!
পদ্মা–গঙ্গা নামের বদলে বাংলাদেশ–ভারত বসিয়ে নিন। তাহলেই বুঝে ফেলবেন ‘সিনেমা’র নাম—সুপার টুয়েলভে বাংলাদেশ–ভারত ম্যাচ। আর এই সিনেমার গল্প? কেউ বলবেন, বৃষ্টির আগে ছিল সুখস্বপ্ন, আর বৃষ্টির পর? মর্মান্তিকও বলতে পারেন কেউ কেউ। কিন্তু আসলেও কি তাই?
অ্যাডিলেড ওভালে বৃষ্টিতে খেলা বন্ধ হয়েছে ৭ ওভার শেষে, যখন বাংলাদেশ বিনা উইকেটে ৬৬ রান তুলে ফেলেছে। লক্ষ্য ১৮৫। উইকেটে ২৬ বলে ৫৯ রানে অপরাজিত লিটন দাস, অন্য প্রান্তে ১৬ বলে ৭ রানে দাঁড়িয়ে নাজমুল হোসেন।
ঠিক তখন বাংলাদেশের প্রয়োজন ৭৮ বলে ১১৯ রান। হাতে ১০ উইকেট। ওভারের হিসাবে ১৩ ওভার বা ৭৮ বলে ১১৯। ওভারপ্রতি ৯.১৫ করে রান তুলতে হতো বাংলাদেশকে।
আর বৃষ্টি থামার পর যখন খেলা শুরু হলো? ডাকওয়ার্থ–লুইস নিয়মে বাংলাদেশের নতুন লক্ষ্য ১৬ ওভারে ১৫১ রান। বৃষ্টির আগে যেহেতু ৭ ওভারের খেলা হয়ে গেছে, তাই বাকি ৯ ওভার ব্যাট করার সুযোগ পেল বাংলাদেশ।
৬৬ রান যেহেতু আগেই উঠে গেছে, নতুন লক্ষ্য অনুযায়ী এই ৯ ওভারে ৮৫ রান করতে হতো সাকিবদের। তখনো হাতে ১০ উইকেট। অর্থাৎ ওভারপ্রতি গড়ে ৯.৪৪ রান করে করতে হতো বাংলাদেশকে। এখন প্রশ্ন হলো, কোনটি বেশি কঠিন ছিল? ওভারপ্রতি গড়ে ৯.১৫ নাকি ৯.৪৪?
ক্রিকেটীয় একটা ব্যাখ্যা দেওয়া যায়, তবে সেটা যে মানতেই হবে সেই বাধ্যবাধকতা নেই। খেয়াল করে দেখুন, বৃষ্টি নামার আগে লক্ষ্য ছিল বাকি ১৩ ওভারে গড়ে ৯.১৫ করে তুলতে হবে। ব্যাটিংয়ের জায়গা থেকে ভাবলে এই কাজটাই বেশি কঠিন।
কারণ, টি–টোয়েন্টি কিংবা যেকোনো সংস্করণে ওভারে গড়ে ৯–এর বেশি করে রান টানা তিন–চার ওভার তোলা যায়। তারপর একটু ছেদ পড়বেই কিংবা তার আগেও ছেদ পড়ে রান তোলার ধারাবাহিকতায়। অর্থাৎ টানা ১৩ ওভারে গড়ে ৯–এর বেশি করে রান তোলা সত্যিই খুব কঠিন কাজ।
ভেবে দেখুন, দুই ওপেনার তখন ক্রিজে, পাওয়ার–প্লে ব্যবহার করে তাঁরা ওভারপ্রতি গড়ে ৯.৪৪ করে রানও তুলে ফেলেছিলেন। কিন্তু পাওয়ার–প্লে শেষে রোহিত শর্মা ফিল্ডারদের সীমানায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিয়েছিলেন। তাতে বাউন্ডারি যেমন কমত, তেমনি রানের গতিও কমে আসত। অস্বাভাবিক কিছু না ঘটলে ক্রিকেটে এটাই স্বাভাবিক।
মোটামুটি ১৪–১৫ ওভার পর্যন্ত এভাবে কাটিয়ে উইকেট হাতে রেখে শেষ কয়েক ওভারে ‘অলআউট অ্যাটাক’—এটাই তো বর্তমান টি–টোয়েন্টি। যদিও বাংলাদেশ দলে তেমন পাওয়ার হিটার নেই বললেই চলে। তাই যা করার টপ অর্ডারকেই করতে হতো এবং সেই হিসাব করলে এই লক্ষ্য আরও কঠিন।
কারণ, টি–টোয়েন্টি ইনিংসের মাঝের ওভারগুলোয় গড়ে ৯–এর বেশি করে রান তোলার মতো ব্যাটসম্যান বাংলাদেশ দলে কি আছে? কেউ কেউ বলতে পারেন শুধু লিটন। আফিফের কথাও বলতে পারেন কেউ কেউ। তবে দুজনের কেউই এমন ধারাবাহিক নন যে নিশ্চিন্তে তাঁদের ওপর বাজি ধরা যায়।
এবার বৃষ্টি নামার পরের সমীকরণে তাকানো যাক। খেলা আবার শুরুর পর নতুন লক্ষ্য অনুযায়ী শেষ ৯ ওভারে গড়ে ৯.৪৪ করে তুলতে হতো বাংলাদেশকে। ক্রিকেটীয় ব্যাখ্যায়, এই লক্ষ্য ১৩ ওভারে ৯.১৫ করে তোলার চেয়ে সহজ। আগের ব্যাখ্যা পড়ার পর কারণটা নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন।
যেহেতু ওভারসংখ্যা কম, তাই সময়ও কম—অল্প সময়ে টানা মেরে খেলা যতটা সম্ভব, বেশি সময় ধরে তা সম্ভবই নয় বলা না গেলেও, তুলনামূলকভাবে এটা অনেক কঠিন কাজ। খেয়াল করে দেখবেন, ইনিংসের শেষ ওভারগুলোতে গড়ে ১০/১২ রান এমন বিরলদৃষ্ট নয়।
অর্থাৎ দুই–এক ওভারে কম উঠলেও অন্য ওভারে ১৫–১৬ করে তুলে পুষিয়ে নেওয়া যায়।
এখানেও সেই ব্যাখ্যাই কাজে লাগে—টানা মেরে খেলা যেহেতু সম্ভব নয়, তাই দুই–এক ওভারে দেখে খেলার দম নিতে হয়। কারণ, বোলার বল হাতে তো শুধু ব্যাটসম্যানদের মারার বল দেবেন না! তাঁদের লক্ষ্য ঠিক উল্টোটা।
আর তাই বৃষ্টি নামার পর নতুন লক্ষ্যটাই বাংলাদেশের জন্য তুলনামূলক সহজ ছিল। আরেকটা কারণও যোগ করে নিতে পারেন এর সঙ্গে। টি–টোয়েন্টিতে ১৮০ রানের বেশি তাড়া করে জয়ের চিত্রনাট্য তো খুব কমই লিখতে পেরেছে বাংলাদেশ। পাঁচবার এমন লক্ষ্য পেয়ে জিতেছে মাত্র দুবার—জিম্বাবুয়ে ও শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে।
টি–টোয়েন্টিতে বড় লক্ষ্য তাড়া করে জেতাটা অভ্যাসের ব্যাপার। বাংলাদেশের সেই অভ্যাস নেই, তবে টানা ৬–৭ ওভার মেরে খেলতে কম দেখা যায়নি। আজও তো ইনিংসের শুরুতে সেটাই দেখা গেল।
সব মিলিয়ে বৃষ্টি বাংলাদেশের জন্য কিছুটা হলেও আশীর্বাদ হয়েই এসেছিল বলতে হবে। শেষ পর্যন্ত যে তাতে কাজ হয়নি, সেটি ভিন্ন কথা। কাজটা তুলনামূলক সহজ হয়েছিল হয়তো, কিন্তু জলবৎ তরলং তো আর হয়ে যায়নি।