মিরপুর টেস্টের প্রথম দিনের সকালের সেশন। নাজমুল হোসেনের আউট, বাংলাদেশের রান ২ উইকেটে ৩৯। ওমন সময় সাকিব আল হাসানকে ব্যাটিংয়ে নামতে দেখে অনেকে একটু অবাকই হলেন। টেস্টে পাঁচ বা ছয়েই ব্যাটিং করে থাকেন সাকিব। সম্প্রতি কিছু টেস্টে ৭ নম্বরেও নেমেছেন।
সেই সাকিব হঠাৎ চারে কেন! তার ওপর তখনো প্রথম সেশন চলছে। বলটা তো নতুনই আছে। সূর্যও উত্তাপ ছড়াতে শুরু করেনি। ভারতীয় বোলারদের কাউকে দ্বিতীয় স্পেলও করতে হয়নি। এমন সময় সাকিবের উইকেটে আসার একটাই কারণ হতে পারে। হয়তো দুই ওপেনারের বিদায়ে বাংলাদেশ ইনিংসের নড়বড়ে শুরুটাকে মেরামত করতে চাইলেন। দলকে নেতৃত্ব দিতে চাইলেন উদাহরণ সৃষ্টি করে।
কিন্তু সাকিব ক্রিজে এসে যা করলেন, তা সম্পূর্ণ উল্টো বার্তাই দিতে শুরু করল। সেই নড়বড়ে মঞ্চে দাঁড়িয়েই তিনি ব্যাট চালাতে লাগলেন অতি আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে। রবিচন্দ্রন অশ্বিন বোলিংয়ে আসতেই বাউন্ডারি মেরে গা গরম করলেন। এরপর ওই ওভারেই মিড উইকেট দিয়ে বিশাল ছক্কা।
কিন্তু এ রকম ব্যাটিংয়ে টাইমিং একটু এদিক-সেদিক হলেই আউটের শঙ্কা থাকে। ভারতীয় ফিল্ডাররাও সেটি জানতেন। ছক্কা খাওয়ার পরও তাই অশ্বিনকে হতাশ মনে হয়নি। স্লিপে দাঁড়ানো বিরাট কোহলি হাততালি দিয়ে যেন আগাম উইকেটেরই উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছিলেন অশ্বিনকে।
সাকিবের ওই ব্যাটিং দেখে গ্যান্ড স্ট্যান্ড গ্যালারির এক নিরাপত্তাকর্মী চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘সাকিব ভাই এখন টি-টোয়েন্টি খেলবে।’ সাকিব এরপর কোনো বাউন্ডারি না পেলেও আসলেই খেলেছেন টি-টোয়েন্টি মেজাজে।
তারপরও মধ্যাহ্নবিরতি পর্যন্ত আর কোনো উইকেট হারায়নি বাংলাদেশ। কিন্তু দ্বিতীয় সেশনে নিজের খেলা প্রথম বলেই সাকিব উমেশ যাদবকে মিড অফ দিয়ে উড়িয়ে মারার চেষ্টা করেন। বলটা ৩০ গজও পার হয়নি। টাইমিংয়ের গড়বড়ে বল গেল ফিল্ডার চেতেশ্বর পূজারার হাতে। উমেশ-পূজারা দুজনের চোখেমুখেই অবিশ্বাস। মধ্যাহ্নবিরতির পর এসে প্রথম বলেই এমন শট!
পুরো স্টেডিয়ামেই কয়েক মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে থাকল। সে নীরবতার মধ্যে দিয়েই মাথা নিচু করে ড্রেসিংরুমে ফিরে যান সাকিব।
মাত্র ১৬ রান করে আউট, অধিনায়ক সাকিব দলকে রেখে রান ৩ উইকেটে ৮২ রানে। ম্যাচের পরিস্থিতি তিনি ব্যাটিংয়ে নামার সময় যেমন ছিল, আউট হওয়ার সময়ও অনেকটা তেমনই। মিরপুরে বাংলাদেশ বিপদে, দাপটে ভারত।
দ্বিতীয় ইনিংসেও সাকিবের ব্যাটিংটা বদলায়নি। সেটাকে অনেকে সমালোচনার চোখে দেখতে পারেন। কিন্তু সাকিব যে আজও এভাবেই খেলবেন, সেটা যেন বাংলাদেশ দলের ড্রেসিংরুম আগে থেকেই জানত। নইলে দ্বিতীয় দিন শেষেই বাংলাদেশ দলের এক সদস্য কেন গর্ব করে বলবেন, ‘সাকিব ভাই কালকেও এভাবেই খেলবেন...।’
আজ বাংলাদেশ দল দ্বিতীয় ইনিংসে যখন ২৬ রান তুলতেই ২ উইকেট হারিয়ে ধুঁকছে, তখন ক্রিজে আসেন সাকিব। বাংলাদেশ ভারতের প্রথম ইনিংস স্কোর থেকে ৬১ রান দূরে। কিন্তু সাকিব সেই দূরত্ব পাড়ি দেওয়ারও ধৈর্য ধরলেন না। ১৩ রান করেই জয়দেব উনাদকাটের বলে কাভারে উড়িয়ে মারতে গিয়ে আউট। প্রথম ইনিংসের মতো বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছে সাকিবের এই আউটটিও।
অবশ্য বিস্ময় তো বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ের পরতে পরতে। দ্বিতীয় ইনিংসে জাকির হোসেনের আউটটার কথাই ধরুন। দলের ব্যাটিং বিপর্যয়ের মধ্যেও স্রোতের বিপরীতে ব্যাটিং করে ফিফটি করে ফেলেছিলেন। উইকেটের সঙ্গে যেভাবে মানিয়ে নিয়েছিলেন, সুযোগ ছিল চট্টগ্রামের মতো এখানেও ইনিংসটাকে এখানেও বড় করার। কিন্তু জাকির কী করলেন?
১৩৫ বলে ৫১ রান করে মুহূর্তের ভুলের খেসারত দিয়ে নিজের উইকেট বিলিয়ে দিয়ে এসেছেন এই বাঁহাতিও। অবশ্য এটা ‘মুহুর্তের ভুল’ নাকি এটাই বাংলাদেশের ব্যাটিং দর্শন, কে জানে! ভারতীয় দল কিন্তু ধরেই নিয়েছে বাংলাদেশের টেস্ট ব্যাটিংটা এমন। মেরে খেলে দ্রুত কিছু রান করেই আউট হয়ে যাবেন ব্যাটসম্যানরা। বাংলাদেশের বিপক্ষে বোলিংয়ের পরিকল্পনা সাজানোও তাই সহজ। মাপা লাইন-লেংথে বল করে গেলেই হয়। দৃষ্টিনন্দন কিছু চার ও ছক্কা হয়তো মেনে নিতে হবে, কিন্তু এরপরই আসবে উইকেটের সুযোগ। মিরপুর টেস্টের প্রথম দিন শেষে ভারতীয় পেসার উমেশ যাদবের কথাটাই মনে করে দেখুন। তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা জানি বাংলাদেশ আগ্রাসী ব্যাটিং করে থাকে। সে জন্য আমরা শুধু ঠিক জায়গায় বল করে গিয়েছি।’
একজন ব্যাটসম্যান আউট হতেই পারে। কিন্তু কীভাবে, কোন সময়ে আউট হচ্ছে, সেসব থেকে বোঝা যায়, ব্যাটসম্যান কী ভাবছে।রাসেল ডমিঙ্গো, কোচ, বাংলাদেশ
বাংলাদেশ দলের ব্যাটসম্যানদের আউট হওয়ার ধরন নিয়ে অসন্তুষ্ট প্রধান কোচ রাসেল ডমিঙ্গোও। চট্টগ্রাম টেস্টে ব্যাটসম্যানদের বাজে শট খেলে আউট হওয়া নিয়ে সেই অসন্তোষ প্রকাশও করে ফেলেছিলেন তিনি, ‘একজন ব্যাটসম্যান আউট হতেই পারে। কিন্তু কীভাবে, কোন সময়ে আউট হচ্ছে, সেসব থেকে বোঝা যায়, ব্যাটসম্যান কী ভাবছে।’
মিরপুর টেস্টের দুই ইনিংসেই সাকিবের প্রায় একই ধরনের আউট তাহলে কী বার্তা দিচ্ছে? রাসেল ডমিঙ্গোর কোচিং ম্যানুয়ালেই–বা কী ব্যাখ্যা সাকিবের এমন টেস্ট ব্যাটিংয়ের?