বিশ্বকাপ মানেই সম্ভাবনা, প্রত্যাশা। এবারও টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আগে বাংলাদেশ দলের কাছে প্রত্যাশা থাকবে। এটা শুধু বাংলাদেশ দল নয়, বিসিবি বা দল–সংশ্লিষ্ট যাঁরা আছেন, তাঁদেরও প্রত্যাশা থাকে। সমর্থকদেরও থাকে। সবাই চায় বাংলাদেশ দল বিশ্বকাপে ভালো করুক। বাংলাদেশ দলও একটা লক্ষ্য নিয়ে যায়, সেটা সব সময়ই ইতিবাচক থাকে। তবে বিশ্বকাপের চ্যালেঞ্জটা অন্য রকম এবং সেটা সব সময়ই আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জিং। কারণ, দ্বিপক্ষীয় সিরিজ আর বিশ্বকাপের মধ্যে পার্থক্যটা বিরাট। বাড়তি প্রত্যাশা যোগ হয়, থাকে বাড়তি চাপও। মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন হচ্ছে, এবারের বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দলের কাছে প্রত্যাশা কেমন হওয়া উচিত? তা পূরণ হওয়ার সম্ভাবনাই–বা কতটুকু?
কথাটা শুনতে একটু অন্য রকম শোনালেও আমি বলব, এবারের বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দল সবচেয়ে কম প্রত্যাশা নিয়ে যাবে। প্রতিটি বিশ্বকাপেই একটা আলোচনা থাকে, সম্ভাবনা থাকে, বাংলাদেশ এই দলকে হারাবে, ওই দলকে হারাবে। এবার তেমন কিছু শুনছি না। এটা একদিক থেকে বাংলাদেশ দলকে হয়তো সাহায্যই করবে। একটু যদি পরিষ্কার করি, বাংলাদেশ দল সর্বশেষ যে সিরিজ খেলল জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে, সেখানে দল সিরিজ জিতলেও পারফরম্যান্স প্রত্যাশা মেটাতে পারেনি। মানুষের তো সর্বশেষ স্মৃতিটাই সবচেয়ে বেশি তরতাজা থাকে, দলও সেটা থেকেই আত্মবিশ্বাস নিয়ে থাকে।
আমি নিশ্চিত, জিম্বাবুয়ে সিরিজটা বাংলাদেশ দলকে বাড়তি কোনো আত্মবিশ্বাস দেয়নি। জিম্বাবুয়ে সম্ভবত তাদের দুর্বলতম দল নিয়ে বাংলাদেশ সফরে এসেছে, বিশেষ করে তাদের বোলিং আক্রমণ বেশ অনভিজ্ঞ। কিন্তু এই বোলিং আক্রমণের বিপক্ষে চট্টগ্রামের ভালো উইকেটেও বাংলাদেশ দলের ব্যাটসম্যানরা ভালো করেনি।
সবচেয়ে বড় কথা, যে বোলিং আক্রমণের বিপক্ষে খেলেছি, সেখানে ভালো না করার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। টি-টোয়েন্টিতে এই ব্যাটিংই সব সময় আমাদের দুশ্চিন্তার জায়গা ছিল, এবারও সেই দুশ্চিন্তা নিয়ে বিশ্বকাপে যাচ্ছি। যদিও বিশ্বকাপের আগে যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে আমাদের তিন ম্যাচের একটা সিরিজ আছে। সেখানে যদি ভালো না করি, ব্যাটিং দল হিসেবে বাংলাদেশ দলের বিশ্বকাপটা ভালো যাবে না।
এ ছাড়া মাঠের বাইরের কিছু কারণে বাংলাদেশ দলের জন্য বিশ্বকাপ একটু কঠিন পরীক্ষা হয়ে আসে। এশিয়া কাপের দু-একটি আসর বাদ দিলে আমরা বৈশ্বিক আসরে এলে বাজেভাবে ভেঙে পড়ি। আমাদের ক্রিকেটের সেরা খেলোয়াড়দের নিয়েও যখন খেলেছি, তখনো ব্যর্থ হয়েছি। তাদের ছাড়া যখন খেলেছি, তখনো ব্যর্থ হয়েছি। এবার দলে সাকিব আল হাসান, মাহমুদউল্লাহ, মোস্তাফিজ, তাসকিনদের মতো অভিজ্ঞরা আছে। তাদের পারফরম্যান্স হবে বাংলাদেশের ভালো করা না–করার নিয়ামক।
একটা বিষয় বাংলাদেশ দলের জন্য ইতিবাচক হতে পারে। সেটি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের কন্ডিশন। সেখানকার উইকেট একটু মন্থর থাকার কথা। এখন পর্যন্ত সে কথাই শুনছি। যদি তা-ই হয়, তাহলে বাংলাদেশের সম্ভাবনা বেড়ে যাবে।
সাধারণত বিশ্বকাপে ব্যাটিং–সহায়ক ফ্ল্যাট উইকেট হয়। এ ধরনের উইকেটে বাংলাদেশের ভালো করার রেকর্ড তেমন নেই। ফ্ল্যাট উইকেটে অন্য দলগুলোর খেলার ধরনের সঙ্গে বাংলাদেশের খেলার ধরনে আমরা বিরাট পার্থক্য দেখি। অন্য দলগুলো ফ্ল্যাট উইকেটে দুই শর আশপাশে রান নিয়মিতই করতে পারে। আমরা দুই শ নিয়মিত করতে পারি না। আমরা ১৬০-১৭০ রানের দল, সেটাও যদি খুব ভালো খেলি, তাহলে। কিন্তু যেমন উইকেট প্রত্যাশা করছি, তেমন যদি থাকে, বাংলাদেশ কিন্তু খুব ভালো করতে পারে। তাহলে আমরা যে ক্রিকেটটা খেলি, সেটার সঙ্গে মানানসই হবে।
অন্য দলগুলোর ব্যাটসম্যানরা কিন্তু ফ্ল্যাট উইকেটে খেলে অভ্যস্ত। যখন মন্থর উইকেট থাকে, তখন যে ধরনের ব্যাটিং–দক্ষতা দরকার, সেটা বেশির ভাগ আন্তর্জাতিক ব্যাটসম্যানের মধ্যেই খুঁজে পাবেন না। এখন কিন্তু সবাই এক ধরনের ক্রিকেটই খেলে থাকে এবং সেটা আক্রমণাত্মক। তাদের জন্য মন্থর উইকেটে মানিয়ে নেওয়া সহজ হবে না। বাংলাদেশ দলের ব্যাটসম্যানদের যেহেতু এ ধরনের উইকেটে ব্যাটিংটা করতে হয়, সেটার সঙ্গে পরিচিত, তাদেরও ভালো করার যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকতে পারে। অতীতে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ বাংলাদেশ খুব ভালো করেনি। তবে এটা তো কোনো না কোনো সময় শেষ হবে। আশা করি, সেটা এবারই।
আরেকটা চাওয়া থাকবে সবার কাছে। আমি চাইব, বাংলাদেশ দলের প্রতিপক্ষ যেন বাংলাদেশ দল না হয়। শুধু যেন প্রতিপক্ষ দলের সঙ্গেই খেলতে হয়। বিশ্বকাপ দল নিয়ে আমরা অনেক কথা বলি, অনেক আলোচনা করি। অন্য সব ভুলে সব সময় দল ভালো হলো না খারাপ, তা নিয়ে পড়ে থাকি। সবাই মিলে যুদ্ধে নেমে পড়ি। দল হয়তো সবার পছন্দ হবে না। কিন্তু যখন দলটা ঘোষণা করা হবে, তখন ওই দলকেই আমাদের সবার সমর্থন করা উচিত। এটা আমাদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ।
যদি অতীতে ফিরে তাকাই, প্রতিটি বিশ্বকাপেই আমরা খেলা বাদ দিয়ে কোনো না কোনো সিলেকশন নিয়ে সারাক্ষণ পড়ে থেকেছি। সেটা বিশ্বকাপের খেলা শুরুর আগপর্যন্ত। পেশাদার ক্রিকেটার হিসেবে খেলোয়াড়দের ওপরে এর কোনো প্রভাব পড়া উচিত নয়। যদিও কোনো না কোনোভাবে এর প্রভাব পড়েছে। সর্বশেষ ওয়ানডে বিশ্বকাপে তো বড় প্রভাব পড়েছে। আশা করছি এবার যেন তা না হয়। আমরাই যেন আমাদের প্রতিপক্ষ না হই। সব সময়ই তো দলটাকে সাহায্য না করে দলের পেছনে লেগে থাকি। এবার নাহয় একটু নতুন কিছু করি।
লেখক: বাংলাদেশ দলের সাবেক অধিনায়ক ও নির্বাচক