সাবেক ক্রিকেটার ও ধারাভাষ্যকার আতহার আলী খান
সাবেক ক্রিকেটার ও ধারাভাষ্যকার আতহার আলী খান

বিশ্বকাপে রোমাঞ্চকর কিছু উপহার দিতে পারে রিশাদ

বাংলাদেশের ক্রিকেটের সঙ্গে আছি দীর্ঘদিন। প্রথমে খেলোয়াড় হিসেবে, এরপর তো ধারাভাষ্যকার হয়ে এখনো যেখানেই বাংলাদেশের খেলা, আমি সেখানেই থাকি। এই দীর্ঘ ক্যারিয়ারে আমি এমন কাউকে খুঁজে পাইনি যে বাংলাদেশ ক্রিকেটের ভালো চায় না। সবাই চায় বাংলাদেশ তিন বিভাগেই ভালো খেলুক, দেশকে ভালো ফল এনে দিক। আমাদের সে সামর্থ্য আছেও। যদি সে অনুযায়ী খেলতে পারি, তাহলে আশা করি ভালো একটা ফল এই বিশ্বকাপে দেখতে পাব।

কিন্তু যখন আমাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী পারফরম্যান্স হয় না, তখন যে ধাক্কাটা লাগে, সেটার বহিঃপ্রকাশ কেমন হতে পারে, তা আমরা যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে সিরিজ হারের পর দেখতে পেয়েছি। কিন্তু শেষ ম্যাচটা জেতার পর আবার মনে হচ্ছে, নাহ, আমরা তো কিছুটা হলেও আশাবাদী হতে পারি!

আশাবাদী হতে চাইলে বাংলাদেশের গত এক-দেড় বছরের পারফরম্যান্সের দিকেও তাকাতে পারেন। ২০২২ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ থেকেই বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি খেলার ধরনে একটা পরিবর্তন এসেছে। ২০২২ বিশ্বকাপে তো প্রত্যাশার চেয়েও বেশ ভালো করেছে, দুটি ম্যাচ জিতেছে। পাকিস্তান, ভারতের মতো বড় দলের বিপক্ষে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে। সেখানেই দলটার টি-টোয়েন্টি মানসিকতা বদলের একটা আভাস পাওয়া যাচ্ছিল। 

টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের কয়েক মাস পরই বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করেছে বাংলাদেশ। আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে দুই ম্যাচে আগে ব্যাটিং করে দুই শর বেশি রান করে হারিয়েছে, বাংলাদেশ সিরিজ হারিয়েছে আফগানিস্তানকেও। নিউজিল্যান্ডকে হারিয়েছে তাদের মাঠে। এ বছর যে শ্রীলঙ্কা সিরিজ হলো, সেটাতেও কিন্তু বেশ প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ক্রিকেট হয়েছে। লম্বা সময় ধরে দলের খেলায় একটা ধারাবাহিকতা ছিল। তবে আমি ইংল্যান্ড সিরিজের কথাটা পাঠকদের আলাদা করে মনে করিয়ে দিতে চাই। ওরা বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের ৩-০ ব্যবধানে হারিয়েছে। ওরা নিশ্চয়ই ওই পারফরম্যান্স দিয়ে নিজেদের অনুপ্রাণিত করতে চাইবে।

খেয়াল করে দেখবেন, আমাদের এই দলটা যখন ভালো খেলে, তখন কিন্তু অন্য রকম লাগে। আগে কিন্তু টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে বাংলাদেশের কোনো দলকে এমন মনে হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে শেষ ম্যাচটাই দেখুন, বাংলাদেশ প্রতিপক্ষকে দাঁড়াতেই দেয়নি। গত বছরের অনেকটা সময় বাংলাদেশ দলের ছবিটা এ রকমই ছিল। দলটাকে সাফল্যের জন্য ক্ষুধার্ত মনে হয়েছে। আমি নিশ্চিত, বিশ্বকাপেও সেই চেহারায় ফিরবে বাংলাদেশ।

এ ক্ষেত্রে টিম ম্যানেজমেন্টের কাছে আমার ক্রিকেট স্মার্টনেস দেখার প্রত্যাশা। যুক্তরাষ্ট্রের যে দুটি মাঠে বাংলাদেশ খেলবে, সেখানে কন্ডিশন, মাঠের আকৃতি কেমন হবে, তা বিবেচনায় আনতে হবে। আমি নিশ্চিত, দলের মধ্যে এ নিয়ে আলোচনা হবে।

যুক্তরাষ্ট্রে ড্রপ-ইন উইকেট থাকবে। অতীতে এ ধরনের উইকেটে বেশ স্পোর্টিং আচরণ দেখেছি। আমি মনে করি, খেলোয়াড়দের এক-দুই ওভারের মধ্যেই বুঝে নিতে হবে, খেলাটা কোন দিকে যাবে। যে যত দ্রুত বুঝবে এবং মানিয়ে নেবে, সে তত ভালো করবে। এটাই টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট।

ওয়েস্ট ইন্ডিজের কন্ডিশনেও বাংলাদেশের ভালো স্মৃতি আছে। আমি সবাইকে ২০০৭ ওয়ানডে বিশ্বকাপের কথা মনে করিয়ে দিতে চাই। সে বিশ্বকাপে আমরা বেশ ভালো খেলেছি। ভারত ছিল টুর্নামেন্টের ফেবারিট দল। তাদের হারিয়েছি, দক্ষিণ আফ্রিকার মতো বড় দলকে হারিয়েছি।

আমরা সর্বশেষ ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফর করেছিলাম ২০২২ সালে। সেই সফরেও টি-টোয়েন্টিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়েছি। ২০১৮ সালের সিরিজটাও বেশ ভালো কেটেছে। ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলটাকে তাদের মাটিতে টি-টোয়েন্টি সংস্করণে হারানো কিন্তু সহজ নয়। বাংলাদেশ দুবার সেটা করেছে। ওই কন্ডিশনে অন্য দলের সঙ্গেও ছেলেরা খারাপ করবে না। 

বিশ্বকাপে ফিল্ডিং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে

ফিল্ডিংটা খুব গুরুত্বপূর্ণ হবে। বাংলাদেশ দলটা বেশ তরুণ। আউট ফিল্ডিং ভালো হবে, এ প্রত্যাশা করতেই পারি। শুধু ফিল্ডিংয়ে নয়, অন্য দুই বিভাগেও আমি তরুণদের দিকে তাকিয়ে থাকব। অভিজ্ঞ খেলোয়াড় দলে থাকা দরকার আছে, থাকবে। কিন্তু এখন তরুণদের দলটাকে এগিয়ে নেওয়ার সময় এসেছে। অধিনায়ক নাজমুল তো আছেই, তাওহিদ হৃদয় দারুণ ফর্মে আছে। আশা করি, তার বিশ্বকাপটা ভালো যাবে। ওপেনার তানজিদ হাসানের কথা বলব। ওরা দুজন যদি রান করে, তাহলে বাংলাদেশ দলের কাছ থেকে এবারের বিশ্বকাপে বিশেষ কিছু দেখতে পাবেন। ওদের সঙ্গে সাকিব আছে, বিশ্বের সেরা অলরাউন্ডার। ‘মিস্টার রিলায়েবল’ মাহমুদউল্লাহ আছে। এই দুই অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যানের উপস্থিতি বাকি ব্যাটসম্যানদের আরও আক্রমণাত্মক, আরও সাহসী ক্রিকেট খেলতে সাহায্য করবে।

রিশাদ হোসেনকে নিয়ে আমার বড় আশা। সে স্পেশাল বোলার, দারুণ ফর্মে আছে। দলে একজন লেগ স্পিনারের অনেক দিনের অভাব সে মেটাচ্ছে ধারাবাহিক পারফরম্যান্সে। রিশাদ দলের অন্যতম সেরা ফিল্ডারও, ব্যাট হাতে ছক্কা মারার জন্যও জনপ্রিয়। শ্রীলঙ্কা সিরিজে তার দুটি ইনিংস তো স্মরণীয় হয়ে থাকবে। 

একজন লেগ স্পিনারের অভাব মেটাচ্ছে রিশাদ হোসেন

আমার বিশ্বাস রিশাদ বাংলাদেশকে এই বিশ্বকাপে রোমাঞ্চকর কিছু উপহার দিতে পারে। শুধু রিশাদ নয়, বোলিং আক্রমণে মোস্তাফিজও দারুণ ছন্দে আছে। তাসকিন ফিরলে সে–ও নিশ্চয়ই ভালো করবে। সাকিব ও মেহেদী—দুজনই ওয়েস্ট ইন্ডিজে খেলেছে। আমি নিশ্চিত, ওই কন্ডিশনে এই দুই স্পিনারকে খেলা কঠিন হবে। উইকেট কিছুটা মন্থর হলে প্রতিপক্ষ দলের ব্যাটসম্যানরা তাদের সহজে খেলতে পারবে না। 

তবে দিন শেষে খেলাটা টি-টোয়েন্টি, ব্যাটিংই এখানে শেষ কথা। বিশ্বকাপে ভালো করতে হলে ব্যাটিং ভালো করতে হবে। আর কোনো উপায় নেই। যদি ব্যাটসম্যানরা ১৭০-১৮০ রান করতে পারে, তাহলেই আপনি ম্যাচে থাকবেন। বাংলাদেশ দল আক্রমণাত্মক মানসিকতায় খেললেই এ রান করা সম্ভব। এখন শুধু সেই মানসিকতায় ফেরার অপেক্ষা।

লেখক: জাতীয় দলের সাবেক ক্রিকেটার ও ধারাভাষ্যকার