দর্শকদের সঙ্গে জয়ের আনন্দ ভাগাভাগি মুজিব–রশিদদের
দর্শকদের সঙ্গে জয়ের আনন্দ ভাগাভাগি মুজিব–রশিদদের

এক দেশ, দুই পতাকার আফগান-ক্রিকেটগাথা

জোনাথন ট্রটকে বলা যায় ‘নির্বাসিত কোচ’।

জোরপূর্বক নির্বাসন নয়, স্বেচ্ছা নির্বাসন। ইংল্যান্ডের সাবেক এই ক্রিকেটার দেড় বছরের বেশি সময় ধরে আফগানিস্তান দলের প্রধান কোচ। অথচ এখন পর্যন্ত দেশটিতে তাঁর পা পড়েনি। আফগানিস্তান দল যে দেশে খেলতে যায়, ট্রটও সেখানে যান। রশিদ খান-মোহাম্মদ নবীরা কোথাও ক্যাম্প করলেও ছোটেন সেখানেও। কিন্তু দেশটির ক্রিকেট কাঠামো ঠিক কেমন, কোন পরিবেশ থেকে খেলোয়াড় উঠে আসে, সেটা তাঁর অদেখা। এমনকি চুক্তি সই করতেও কাবুলে যাননি। বিশ্বকাপে যে ১০টি দল খেলেছে, তাদের মধ্যে জোনাথন ট্রটই একমাত্র ‘নির্বাসিত কোচ’।

শুধু কোচ নয়, এবারের বিশ্বকাপে আফগানিস্তান দলের সঙ্গী এমন আরও অনেক কিছু, যেটা আর কোনো দলের নেই। মাঠে ফলের কথা তো সবারই জানা। আগের দুই বিশ্বকাপ মিলে যাদের জয় ছিল মাত্র একটি, এবার সেই আফগানিস্তান প্রথম পাঁচ ম্যাচে তুলে নিয়েছে দুটি জয়। বর্তমান চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৬৯ রানে আর সাবেক চ্যাম্পিয়ন পাকিস্তানের বিপক্ষে ৮ উইকেটে। তবে জয়ের সংখ্যা, প্রতিপক্ষ বা জয়ের ধরন নয়, এই আফগানিস্তানের আসল বিস্ময় পথে পথে ছড়ানো নানা প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে আসায়, বাধা হয়ে সামনে আসতে থাকা একেকটা পাথরকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যাওয়ায়, আর আগুন-কাষ্ঠে দাঁড়িয়েও মুখে হাসি ফুটিয়ে তোলায়। যে হাসি শুধু একটি দলের নয়, নানা ঝড়ঝাপটায় ক্ষতবিক্ষত হয়ে থাকা গোটা জাতির।

আফগানিস্তানে ‘নির্বাসিত কোচ প্রথা’ অবশ্য অনেক দিন ধরেই চলছে। বাইরের, বিশেষ করে ইউরোপের কোচেরা প্রতিনিয়ত অস্থিরতা–অনিশ্চয়তায় থাকা এশিয়ান দেশটিতে যেতে ঝুঁকিবোধ করেন। যেটা ২০২১ সালের আগস্টে তালেবান গোষ্ঠী ক্ষমতা দখলের পর কয়েকগুণ বেড়েছে। ট্রটের মতো কোচদের পাওয়া যাবে শুধু বিদেশের মাটিতে— এমনটা রশিদ খানরা হয়তো এত দিনে মেনে নিয়েছেন। তবে দিনে দিনে লড়াইয়ের ময়দানে যুক্ত হয়েছে নতুন নতুন ফ্রন্ট— নিষেধাজ্ঞার শঙ্কা, অর্থপ্রাপ্তিতে বাধা, সরকারের সঙ্গে মতবিরোধ, প্রতিবেশীদের সঙ্গে দূরত্ব, ক্রিকেটাঙ্গনে কোণঠাসা হয়ে যাওয়া ...।

যুদ্ধে যার শুরু

আফগান জনজীবনে ক্রিকেট এখন বহুল জনপ্রিয়

আফগানিস্তানে ক্রিকেটের শুরু আর উত্থানই অবশ্য যুদ্ধের সঙ্গে জড়িত। উনিশ শতকের প্রথমার্ধে অ্যাংলো-আফগান যুদ্ধের সময়ই ব্রিটিশদের মাধ্যমে ক্রিকেটের প্রচলন হয়েছিল কাবুলে। তবে ব্রিটিশদের খেলাটি দেশটিতে সাধারণ পর্যায়ে পৌঁছায়নি। গত শতাব্দীর শেষ দিকে সোভিয়েত হামলায় আফগানিস্তানের বিপুলসংখ্যক মানুষ পাকিস্তানে শরণার্থী হন। ওই শরণার্থী জীবনে পাকিস্তানের জনপ্রিয় খেলা ক্রিকেটে মজে তারা। গড়ে ওঠে ক্রিকেট দল। ১৯৯৫ সালে সেখানেই প্রতিষ্ঠিত হয় আফগানিস্তান ক্রিকেট বোর্ড। ২০০১ সালে পেয়ে যায় ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিলের (আইসিসি) অ্যাফিলিয়েট সদস্যপদ।

ওই বছরই শরণার্থীরা আফগানিস্তানে ফিরে এলে দেশটিতে ক্রিকেটের চর্চা ও জনপ্রিয়তা বাড়তে শুরু করে। যুদ্ধবিধ্বস্ত ও নানা মানবিক সংকটে থাকা দেশটি ক্রিকেট অবকাঠামোর অপ্রতুলতার মধ্যেও ঘুরে দাঁড়ায় দ্রুত সময়ে। ২০০৮ সালেও আইসিসির পঞ্চম ডিভিশনে খেলা দলটি ২০১২ সালে খেলে ফেলে কোনো টেস্ট দলের বিপক্ষে প্রথম ওয়ানডে। এর পর প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ খেলে ২০১৫ সালে।

পাকিস্তানের পর ভারত

আফগান ক্রিকেটের পুনরুজ্জীবনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পাকিস্তানের। মোহাম্মদ নবী, রশিদ খানদের ক্রিকেট-প্রেম বা হাতেখড়ি পেশোয়ারের শরণার্থী জীবনে। পরবর্তী সময়ে পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড (পিসিবি) অবকাঠামো সহযোগিতা দিয়েও আফগানিস্তানের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়। লাহোরে অবস্থিত পাকিস্তানের ন্যাশনাল ক্রিকেট একাডেমি ব্যবহার করতে দেওয়া হয় আফগানদের। সুযোগ দেওয়া হয় পাকিস্তানের ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলারও।

আফগানিস্তানের ক্রিকেট আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিয়মিত হয়ে যাওয়ার পর ‘বন্ধু’ হিসেবে পায় ভারতকেও। দিল্লি থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত শহীদ বিজয় সিং পথিক স্পোর্টস কমপ্লেক্সকে আফগানদের ‘হোম গ্রাউন্ড’ হিসেবে ব্যবহারের সুযোগ দেয় বিসিসিআই। গ্রেটার নয়ডার এ মাঠেই ‘অ্যাওয়ে’ ম্যাচের প্রস্তুতি ক্যাম্প ও ‘হোম’ ম্যাচ খেলতে শুরু করে আফগানিস্তান। কিছু সিরিজ আয়োজিত হয় সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং শ্রীলঙ্কার মাটিতেও।

টানা তৃতীয় বিশ্বকাপ খেলছে আফগানিস্তান

তালেবান-ধাক্কায় আমিরাতে উদ্ধার

২০২১ সালে তালেবান গোষ্ঠী ক্ষমতা পুনর্দখল করলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রায় একঘরে হয়ে পড়ে আফগানিস্তান। যার ছাপ পড়ে ক্রিকেটেও। প্রথম ধাক্কাটা ছিল ভিসা প্রাপ্তিতে। সমাধানে হাত বাড়িয়ে দেয় সংযুক্ত আরব আমিরাত। যে কোনো সফরের আগে ২৫ জনের মতো ক্রিকেটারকে আমিরাতের রেসিডেন্সি ভিসা করিয়ে রাখা হয়। তারপর দুবাই হয়ে যাতায়াত করা হয় গন্তব্যে। আমিরাত সহযোগী হয়ে ওঠে ক্রিকেট অবকাঠামো ব্যবহারেও।

২০১৮ সালে আইসিসির পূর্ণাঙ্গ সদস্যের মর্যাদা পেলেও আফগানিস্তান এখন পর্যন্ত কোনো নিজের দেশে কোনো ম্যাচ খেলতে পারেনি। কোনো দেশই কাবুলে তাদের দল পাঠাতে রাজি নয়। এমন অবস্থায় একটা স্থির হোম গ্রাউন্ড দরকার হয় আফগানদের। ২০২২ সালের নভেম্বরে এমিরেটস ক্রিকেট বোর্ডের (ইসিবি) সঙ্গে আফগান বোর্ডের (এসিবি) একটি চুক্তি হয়। যার আওতায় পরবর্তী পাঁচ বছর আমিরাতকে হোম গ্রাউন্ড হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে আফগানিস্তান। এসিবিকে ভিসা সহযোগিতা এবং কার্যালয় স্থাপনের সুবিধাও দেয় আমিরাত। বিনিময়ে প্রতিবছর আমিরাতের বিপক্ষে একটি করে তিন ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজ খেলতে হবে আফগানদের।

আর্থিক নিষেধাজ্ঞার ‘যন্ত্রণা’

তালেবানের কারণে আফগানিস্তানের ওপর পশ্চিমা বিশ্ব যেসব নিষেধাজ্ঞা দেয়, তার মধ্যে অন্যতম ছিল অর্থ স্থানান্তরে। আর এ কারণে আইসিসি থেকে প্রাপ্য বাৎসরিক লভ্যাংশ আফগানিস্তান সরাসরি পায় না। আইসিসির পূর্ণাঙ্গ সদস্য হিসেবে ২০২১-২৩–এর দিকে বছরে ৪৮ লাখ মার্কিন ডলার (সংশ্লিষ্ট চক্রে প্রাক্কলিত আয় অনুসারে) পাওয়ার কথা আফগানিস্তান বোর্ডের। আইসিসি সদস্য দেশগুলোকে অর্থ পাঠিয়ে থাকে বছরে দুইবার—জানুয়ারি ও জুলাইয়ে।

তালেবান ক্ষমতায় আসার পর ২০২২ সালের জানুয়ারি এবং জুলাইয়ে আফগান বোর্ড অর্থ গ্রহণ করতে পারেনি (খুব সম্ভবত ২০২৩ সালেও নয়, যদিও নিশ্চিত হওয়া যায়নি)। যে কারণে ক্রিকেট দলের সফর, হোম সিরিজ আয়োজন এবং বিদেশি স্টাফদের বেতনভাতা প্রদানে সংকটে পড়ে এসিবি। এর সমাধান হিসেবে আফগানিস্তানে নিবন্ধিত কোনো বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে অর্থ স্থানান্তরের কথা ভাবা হয়েছিল। যদিও তা সম্ভব হয়নি। শেষ পর্যন্ত আইসিসিই এসিবির হয়ে অর্থ প্রদান শুরু করে। খেলোয়াড় ও কোচিং স্টাফদের বেতন, সিরিজ আয়োজনে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষ ও রশিদ-নবীদের বিদেশ সফরে অর্থ পরিশোধ করে আইসিসি, যা এসিবিকে প্রদেয় অর্থ থেকে কেটে সমন্বয় করা হয়।

হাশমতউল্লাহ শহিদীদের প্রতিটি জয়ে মিশে থাকে বিরুদ্ধতাকে হারিয়ে দেওয়ার উচ্ছ্বাস

পটপরিবর্তনের পরপর আফগানিস্তান ক্রিকেট দলের কয়েকটি পৃষ্ঠপোষক প্রতিষ্ঠান সরে গিয়েছিল। যে কারণে বোর্ডে কর্মরতদের বেতন প্রদানেও সমস্যায় পড়তে হয়েছিল। ২০২২ সালের অক্টোবরে ক্রিকইনফোর খবরে বলা হয়, আফগানিস্তানে কর্মরত বোর্ডের সব পর্যায়ের স্টাফদের ৩০ শতাংশ বেতন দেওয়ার মতো অর্থ হাতে আছে। পরবর্তী সময়ে কিছু পৃষ্ঠপোষক ফিরে আসায় এবং দেশের সার্বিক আর্থিক অবস্থা কিছুটা ভালো হওয়ার পর এই সমস্যা মিটে যায়।

নিষেধাজ্ঞার শঙ্কা

তালেবান তাদের অনুসৃত নীতি অনুসারে মেয়েদের ঘরের বাইরের কর্মকাণ্ডে নানা বিধিনিষেধ আরোপ করে। যে কারণে থেমে যায় আফগানিস্তান নারী ক্রিকেট দলের কার্যক্রম। বেশ কয়েকজন নারী ক্রিকেটার দেশ ছেড়ে অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নেন। ২০২১ সালের শেষ দিকে অস্ট্রেলিয়ার পুরুষ দলের আফগানদের বিপক্ষে টেস্ট খেলার কথা ছিল। এ বছর দুই দলের টি-টোয়েন্টি সিরিজ ছিল আমিরাতে। দুটিই স্থগিত করে দেয় ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া (সিএ)। স্পষ্টতই জানিয়ে দেয়, নারী ক্রিকেট বন্ধ করে দেওয়া এর মূল কারণ। এ ঘটনায় রশিদ-নবীরা বেশ হতাশা প্রকাশ করেন। অস্ট্রেলিয়ার বিগ ব্যাশ লিগের নিয়মিত মুখ রশিদ ‘রাজনীতির সঙ্গে ক্রিকেট না মেলানো’র অনুরোধ জানিয়ে বিগ ব্যাশে না খেলার প্রচ্ছন্ন হুমকিও দেন।

নারী ক্রিকেট চালু না রাখায় আইসিসি থেকে আফগানিস্তানকে নিষিদ্ধ করার দাবি জানায় হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। এ নিয়ে আফগান কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলতে একটি কমিটি করে আইসিসি। সর্বশেষ কয়েক দিন আগে মুম্বাইয়ে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির (আইওসি) সংবাদ সম্মেলনেও আফগানিস্তানের ক্রিকেট প্রসঙ্গ উঠে আসে। ২০২৮ লস অ্যাঞ্জেলেস অলিম্পিকে পুরুষ ও নারীদের ক্রিকেট যুক্ত করা হয়েছে। আফগানিস্তান নারী দল গঠন না করায় শুধু পুরুষ দলকে অলিম্পিকে খেলার অনুমতি দেওয়া হবে কি না জিজ্ঞাসা করলে আইওসির প্রেসিডেন্ট থমাস বাখ জানান, সামনের দিনগুলোতে এ বিষয়ে কী করা হচ্ছে বা না হচ্ছে, সেটি তারা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করবেন।

দুই পতাকা

শুধু বাইরেই নয়, আফগানিস্তান ক্রিকেট দলের ‘শীতল লড়াই’ আছে নিজের দেশের ক্ষমতাকাঠামোর সঙ্গেও। তালেবান এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত আফগানিস্তানের পতাকা আলাদা। তালেবানের পতাকা সাদা রঙের, যেখানে কালেমা খচিত। আর বৈশ্বিকভাবে স্বীকৃত পতাকা হচ্ছে তিন রঙের—কালো, লাল ও সবুজের মিশেলে। তালেবান সরকার দেশটিতে সাদা পতাকা ব্যবহার করলেও আফগানিস্তান ক্রিকেট দল খেলায় অংশ নিচ্ছে পুরোনো তেরঙা পতাকা নিয়ে। গ্যালারিতে দর্শকও হাজির হচ্ছেন আগের পতাকা নিয়ে। পাশাপাশি ম্যাচ শুরুর আগে মাইকে বাজানোও হচ্ছে পুরোনো জাতীয় সংগীত, যেটি থেকে মিউজিক বাদ দিতে বলেছে তালেবান। তবে এখন পর্যন্ত এ নিয়ে দৃশ্যমান কোনো বিরোধে জড়ায়নি আফগান বোর্ড ও সরকার। অবশ্য বোর্ডের প্রধানও তালেবান নিয়োগকৃত।

দুই পতাকা, যেকোনো সময় আইসিসির নিষেধাজ্ঞার চাপ, অর্থ প্রাপ্তিতে নানা ঝঞ্ঝাট আর ভিনদেশে ‘হোম’ বানানো আফগানিস্তান দলই এখন বিশ্বকাপে অন্যতম সফল দল। অধিনায়ক হাশমতউল্লাহ শহীদি তো শ্রীলঙ্কা ম্যাচের আগেই বলেই দিলেন, এটিই আফগান ইতিহাসের সেরা বিশ্বকাপ।