সবার আগে নামগুলো দেখুন—কাইল জেমিসন, টিম সাউদি, ট্রেন্ট বোল্ট, নিল ওয়াগনার।
এই চার পেসারে সাজানো নিউজিল্যান্ডের বোলিং আক্রমণকে দলটির বোলিং কোচ শেন জার্গেনসন তুলনা করেছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের সেই বিখ্যাত পেস চতুষ্টয়ের সঙ্গে। চারজন মিলে নিয়েছেন ১০০০-এর বেশি টেস্ট উইকেট।
তাঁদের বিপক্ষেই গত বছরের জানুয়ারিতে ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় টেস্ট খেলতে নেমেছিলেন মাহমুদুল হাসান। মাউন্ট মঙ্গানুইর সেই টেস্টে মাহমুদুল ক্রিজে ছিলেন ২৯২ মিনিট, বল খেলেছিলেন ২২৮টি এবং রান করেছিলেন ৭৮।
টেস্ট ক্রিকেটে তরুণ মাহমুদুলের পরের ইনিংসটি ছিল দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ডারবানে, সেখানে ৪৪২ মিনিট ক্রিজে থেকে খেলেছিলেন ৩২৬ বল এবং রান করেছিলেন ১৩৭। মাহমুদুলের ১১ টেস্টের ছোট্ট ক্যারিয়ারে ক্রিজে লম্বা সময় পড়ে থাকার এমন আরও উদাহরণ আছে। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে চট্টগ্রামে, ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে অ্যান্টিগায়ও প্রতিপক্ষের বোলারদের ক্লান্ত বানিয়েছিলেন তিনি। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সিলেট টেস্টেও তাঁর ব্যাট থেকে আসে ৮৬ রান।
টেস্টসুলভ ব্যাটিংটা যাঁর সহজাত, সেই মাহমুদুলকে আজ মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে খুঁজে পাওয়া গেল না। ফরওয়ার্ড ডিফেন্স, ব্যাকফুট ডিফেন্স কীভাবে করতে হয়, যেন বেমালুম ভুলে গেছেন! ৪০ বল খেলা মাহমুদুল ২ চারে রান করেছেন ১৪।
বাংলাদেশ দলের ব্যাটিং অর্ডারে বাকিদেরও একই অবস্থা। তাঁদের চোখের সামনে নরম মাটির উইকেট, যেখানে নিউজিল্যান্ডের দুই পেসার কাইল জেমিসন ও টিম সাউদি ৫ ওভার বোলিংয়ের পরই এবড়োখেবড়ো অবস্থা। কিছু বল টার্ন করে বেরিয়ে যাচ্ছিল, কিছু একই জায়গা থেকে সোজা প্যাডে ধেয়ে আসছিল। প্রথাগত ফরওয়ার্ড ডিফেন্স, ব্যাকফুট ডিফেন্সে যা সামলানো কঠিন। এমন উইকেটে ব্যাটসম্যানরা উপায় না দেখে মেরে খেলার পথটা বেছে নেন। কখনো সেটা কাজে দেবে, কখনো নয়। কাজে দিলে সেটাও বেশিক্ষণের জন্য নয়। একটা না একটা বলে হার মানতেই হবে।
তাহলে করণীয় কী? উত্তর একটাই—মেরে খেলা। কোনো রকমে ২০০ রান হলেই হলো। এরপর স্পিন দিয়ে নিউজিল্যান্ডকে উড়িয়ে দেওয়া যাবে। মারতে গেলে আউট হলেও কোনো দায় নেই।
প্রশ্ন হচ্ছে, তারুণ্যে ঠাসা বাংলাদেশ দলের ব্যাটিং অর্ডারকে এই দায় এড়ানোর শিক্ষা দেওয়ার কারণ কী? তারাই তো কদিন আগে একই বোলিং আক্রমণের বিপক্ষে সিলেটে উইকেটে রান করেছে। মাউন্ট মঙ্গানুইয়ে রান করেছে। সাকিব-তামিমের প্রজন্ম তো টেস্ট ক্রিকেট থেকে যায় যায় অবস্থা, নতুনদেরও কেন সেই একই এলোপাতাড়ি ব্যাটিংয়ের পাঠ দেওয়া হচ্ছে? কোথায় তরুণ ব্যাটসম্যানদের ভালো উইকেটে বড় রানের সুযোগ করে দেওয়া হবে, তা না করে তাঁদের পাঠানো হচ্ছে ‘মাইনফিল্ডে’।
এ ধরনের প্রশ্নের সহজ উত্তরটা কী হতে পারে তা অনুমান করা যায়। আজ যেমন বাংলাদেশ দলের প্রতিনিধি হিসেবে সংবাদ সম্মেলনে এসে মেহেদী হাসান মিরাজ সে রকম একটা কথা বলে গেলেন, ‘সিলেটের উইকেটও স্লো ছিল, ব্যাটসম্যানরা সহায়তা পেয়েছে, পরে আবার স্পিনাররা সহায়তা পেয়েছে। আমরা তো মিরপুরে খেলে অভ্যস্ত। আমরা বাইরে গেলে প্রতিটি দলই হোম অ্যাডভান্টেজ নিতে চায়। আমরাও একটু হোম অ্যাডভান্টেজ নেওয়ার চেষ্টা করছি। যেহেতু টেস্ট ক্রিকেট, যেহেতু সিরিজে এগিয়ে আছি, জিততে পারলে পয়েন্ট টেবিলে এগিয়ে থাকব। এটা টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের খেলা। দুটি ম্যাচই জিতলে দলের অবস্থান অনেক ওপরে চলে যাবে। যতটুকু অ্যাডভান্টেজ আছে নেওয়ার চেষ্টা করছি।’
কিন্তু নিউজিল্যান্ডকে ঘরের মাঠে হারাতে হলে এ ধরনের উইকেট তৈরি করতে হবে, সে ধারণা ভুল প্রমাণ করার জন্য সিলেট টেস্ট তো আছেই। দুই ইনিংসের বাংলাদেশ দল ৩০০-এর বেশি রান করেছে। নিউজিল্যান্ড দলও সিলেটের উইকেটের সুষম আচরণের প্রশংসা করেছে। কিউইদের সিলেটে ১৫০ রানে হারানোর পর মিরপুরে এমন স্পিন-বিষাক্ত উইকেট কি খুব দরকার ছিল? ভালো উইকেট তৈরি করে ব্যাটসম্যানদের রান করার দায়িত্ব দেওয়া যেত। ভালো উইকেটে বোলারদেরও উইকেট নেওয়ার পরীক্ষা হতো।
যে পরীক্ষায় কয়েক বছর ধরে দারুণ সফল তাইজুল-মিরাজরা। উপমহাদেশের বাইরের দলকে ঘরের মাঠে অলআউট করতে উইকেটের এতটা সাহায্য দরকার হয় না। দুজনই রান থামিয়ে চাপ বাড়ানোর দক্ষতায় বিশ্বমান অর্জন করেছেন। গতির বৈচিত্র্য তাঁদের বড় শক্তি। দুজনই গতি কমিয়ে–বাড়িয়ে ব্যাটসম্যানের মতো দ্বিধা সৃষ্টি করতে পারেন। নাঈম হাসানও গত কয়েক বছরে অনেক উন্নতি করেছেন। তাঁরা কেউই এখন আর উইকেটের ওপর নির্ভরশীল স্পিনার নন। ভালো উইকেটে প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানদের আউট করে গর্বিত হতে পারেন।
জয়ের দোহাই দিয়ে টেস্ট ক্রিকেটের সুষম প্রতিযোগিতা থেকে সরে গেলে দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতি যে বাংলাদেশের হবে, সেটি আলাদা করে বলার প্রয়োজন নেই। এই ধারা চলতে থাকলে আরও একদল টেস্ট ব্যাটসম্যান গড়ে উঠবেন, যাঁরা টেস্টের শেষ সেশনে দলের বিপদে মেরে খেলতে গিয়ে আউট হবেন এবং বলবেন, ‘আমি এভাবেই খেলি। এটাই আমার সহজাত খেলা।’
আর বাংলাদেশ দলের পেস বোলিং আক্রমণের কী হবে? যে মিরপুরে আফগানিস্তানের বিপক্ষে সর্বশেষ টেস্টে ইবাদত হোসেন ৪ উইকেট নিয়েছেন, তাসকিন আহমেদ ৪ উইকেট নিয়েছেন, সেখানে আজ বাংলাদেশ দলের একমাত্র পেসার শরীফুল ইসলাম নতুন বলে ১ ওভার করে বিশ্রামে গেছেন।
ম্যাচের আগে দলের সমন্বয় নিয়ে প্রধান কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে বলেছিলেন, দল সাজানো হয় প্রতিপক্ষের দুর্বলতা ও আমাদের শক্তিমত্তা চিন্তা করে। স্পিন শক্তিতে বলীয়ান এই বাংলাদেশই তো নিউজিল্যান্ডকে মাউন্ট মঙ্গানুইয়ে পেস দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছিল।
বাংলাদেশ দলের ম্যানেজমেন্ট কি তা ভুলে বসেছে? মিরাজের কথা শুনে মনে হলো সেই স্মৃতিতে ধুলো জমেছে, ‘আমরা যদি প্রতিপক্ষকে অলআউটই না করতে পারি তাহলে তো জিততে পারব না। ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে অনেকটা এ রকম উইকেটে আমরা জিতেছি। আমাদের স্পিন আক্রমণ ভালো। ফলে সুযোগ অবশ্যই থাকে।’
অন্য এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয় উইকেট আরেকটু ভালো হলে ব্যাটসম্যানদের জন্য ভালো হয়। এমন উইকেটে ব্যাটসম্যানরা অনেক সংগ্রাম করে। আমার মনে হয়, এটা টিম ম্যানেজমেন্টের পরিকল্পনা। আমরা সিরিজে এগিয়ে আছি, অবশ্যই আমরা এই সুবিধা নিতে চাইব।’
কিন্তু সাময়িক সুবিধা নিতে গিয়ে যে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি হচ্ছে, তা দেখবে কে!