৭ অক্টোবর ২০২১
মাহমুদউল্লাহ সংবাদ সম্মেলনে এলেন, হতাশাক্লিষ্ট মুখে স্কটল্যান্ডের কাছে হৃদয় মোচড়ানো হারের ব্যাখ্যা দিতে লাগলেন। যাদের কাছে হেরে ২০২১ বিশ্বকাপে বাংলাদেশ অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহর বিশ্বকাপ শুরু হলো, সেই স্কটিশরাই মাহমুদউল্লাহকে থামিয়ে করলেন জয়োৎসব।
গালে হাত দিয়ে স্কটিশ-উৎসব থামার অপেক্ষায় থাকা মাহমুদউল্লাহর ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ট্রলও হয়েছিল। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে মাহমুদউল্লাহর অতলে ডুবতে চলার শুরু তো এটাই...!
সেই শুরু চূড়ান্ত রূপ পায় ২০২২ সালে, সংযুক্ত আরব আমিরাতে হওয়া এশিয়া কাপে। যে টুর্নামেন্টের পর থেকে মাহমুদউল্লাহ দল থেকে বাদ পড়েন। ২০২২ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও যে জায়গা হয় না বাংলাদেশের ক্রিকেটের এই ‘ম্যাটাডোর’–এর।
৩১ জানুয়ারি ২০২৪
এবার মাহমুদউল্লাহ কিছুই বলেননি। তবে কাজ করেছেন। মানে ক্রিকেটার ম্যাটাডোরদের যেটা করতে হয়, সেটি করেছেন। দুর্দান্ত পারফরম্যান্সে ‘কবর’ দিয়েছেন তাঁকে নিয়ে হওয়া সমালোচনার। তাঁর পারফরম্যান্স দেখে বিসিবির ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগেরে প্রধান জালাল ইউনুস সরাসরিই বলেছিলেন, টি-টোয়েন্টি দলে মাহমুদউল্লাহকে নিয়ে দ্বিতীয়বার ভাববার সুযোগ নেই। অর্থাৎ তিনি এখন দলের অটো চয়েজ।
২০২১ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ৭ অক্টোবর দিনটি যদি হয় ম্যাটাডোর মাহমুদউল্লাহর ‘মরে’ যাওয়ার, তাহলে ২০২৪ সালের ৩১ জানুয়ারি তাঁর ‘পুনর্জীবন’ লাভের। এটা অবশ্য টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে। ওয়ানডেতে নতুন শুরু মাহমুদউল্লাহর হয়েছে সর্বশেষ ওয়ানডে বিশ্বকাপেই।
অষ্টম টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলতে যাওয়া মাহমুদউল্লাহ যখন টি-টোয়েন্টি দল থেকে বাদ পড়েন, তখন তাঁর বয়স ৩৭ ছুঁই ছুঁই। এই বয়সে অনেকে এমনিতেই ক্রিকেট ছেড়ে বিশ্রামের জীবন বেছে নেন। তাই স্বাভাবিকভাবেই মাহমুদউল্লাহর ক্যারিয়ারের এপিটাফ অনেকেই লিখে ফেলেছিলেন। কিন্তু সাধারণ ক্রিকেটপ্রেমীরা অমন ভাবলে কী হবে, মাহমুদউল্লাহ যে বিশুদ্ধ এক ক্রিকেট ম্যাটাডোর! একজন যোদ্ধা কি কখনো নিজের শেষ কখনো দেখেন! তাই তো মুশফিকুর রহিম আর তামিম ইকবাল টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটকে বিদায় বলে দিলেও মাহমুদউল্লাহ ছিলেন ‘সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে’ আবার লড়াই করার অপেক্ষায়।
টি–টোয়েন্টি ক্রিকেটে মাহমুদউল্লাহ বাংলাদেশ দলে যত দিন ‘ব্রাত্য’ ছিলেন, সেই সময়ে বাংলাদেশ দল খেলেছে ২৫টি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ। এতটা সময় পর যে তিনি আবার টি–টোয়েন্টি ফিরলেন, তার ভিত মাহমুদউল্লাহ গড়ে রেখেছিলেন নিজের কাছে থাকা ‘অস্ত্র’ দিয়ে। সেই অস্ত্র আর কিছু নয়, ওয়ানডে ক্রিকেট। ২০২৩ বিশ্বকাপ দলে সুযোগ পেয়েছিলেন, বাংলাদেশ ব্যর্থ হলেও মাহমুদউল্লাহ ছিলেন দলের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক। ৭ ইনিংসে ৫৪.৬৬ গড়ে করেছেন ৩২৮ রান। মানে, সুযোগ পেয়েই স্বরূটা ফিরে পান বাংলাদেশের ক্রিকেটের ‘যোদ্ধা’।
এরপরও একটি প্রশ্ন থেকে গিয়েছিল অনেকের কাছে—ওয়ানডেতে পেরেছেন, টি-টোয়েন্টিতে পারবেন তো? এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মঞ্চ হিসেবে মাহমুদউল্লাহ বেছে নেন বিপিএলকে। ফরচুন বরিশালের হয়ে ১৩ ইনিংসে প্রায় ৩০ গড়ে করেছেন ২৩৭ রান, স্ট্রাইক রেট ১৩৪.৬৫। রান, গড় বা স্ট্রাইক রেট—তিনটির কোনোটিই হয়তো মুগ্ধ করবে না অনেককে। কিন্তু এর মধ্যে অনেকগুলো ইনিংস যে ছিল দলের জন্য খুব কার্যকর। বিপিএলের পারফরম্যান্সর পরই তাঁর টি-টোয়েন্টি দলে ফেরা অনেকটা নিশ্চিত হয়ে যায়। বিসিবির কর্তাদের মুখে মাহমুদউল্লাহ ‘অটো চয়েজ’ শব্দটি আবার উঠে আসে।
এরপর আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে মাহমুদউল্লাহ ফেরেন গত মার্চে, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সিরিজ দিয়ে। অভিজ্ঞ এই ক্রিকেটারের ফেরাটাও হয় নায়কোচিত—প্রথম বলে অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুসকে ছক্কা মেরে। সেদিন বাংলাদেশকে জেতাতে না পারলেও তিনি ফিফটি করেন ২৭ বলে।
৪ ছক্কার সেই ইনিংসে একটি বল তো স্কয়ার লেগের ওপর দিয়ে গ্যালারির ছাদে পাঠিয়েছিলেন। যে বল আর মাঠে ফেরেনি। টি-টোয়েন্টিতে এর পর থেকেই একটা বিষয় নিয়মিত মাহমুদউল্লাহর ব্যাটিংয়ে দেখা যাচ্ছে—ইন্টেন্ট। এই যেমন জিম্বাবুয়ে সিরিজে পঞ্চম ম্যাচ। পাওয়ারপ্লেতে ১৫ রানে ৩ উইকেট নেই—এমন অবস্থায় উইকেটে এসেও রানের জন্য খেলেছেন, করেছিলেন ৩৬ বলে ফিফটি।
একটা সময়ে অটো চয়েজ থাকা, এর পর দল থেকে বাদ পড়া, ফিরে আবার অটো চয়েজ হওয়া—সন্দেহ নেই মাহমুদউল্লাহ এর জন্য পরিশ্রম করেছেন। তবে এখানে তাঁর বিশেষত্ব আছে। নিজের বাদ পড়া বা ফেরা নিয়ে অভাব–অভিযোগ করেননি কিংবা জবাব পাল্টা জবাবের খই ফোটাননি। নীরবে শুধু নিজের কাজটা করে গেছেন। যখন দল থেকে বাদ পড়েছিলেন, তাঁর ফিটনেস নিয়ে নানা কথা হয়েছে।
অথচ ৩৮ বছর ১০০ দিন বয়সেও দুর্দান্ত ফিটনেসই তাঁর বড় পুঁজি। মাহমুদউল্লাহকে তাহলে নীরবে লড়ে যাওয়া হার না মানা এক ক্রিকেট–যোদ্ধা তো বলাই যায়! এ কারণেই তো তাঁর ক্রিকেট জীবন নিয়ে লিখতে গেল সবার আগে যে বাক্য মনে পড়বে, সেটা হতে পারে এ রকম—মাহমুদউল্লাহ মানেই যোদ্ধা, মাহমুদউল্লাহ মানেই ফিরে আসার গল্প।