বাংলাদেশের ক্রিকেটের পোস্টার বয় থেকে তিনি হয়ে গিয়েছিলেন ‘ভিলেন’। টেস্ট অভিষেকে সর্বকনিষ্ঠ ব্যাটসম্যান হিসেবে সেঞ্চুরি করে বাংলাদেশের ক্রিকেটকে নতুন পরিচয় দেওয়া মোহাম্মদ আশরাফুল তখন পরিত্যাজ্য এক নাম। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে নিষিদ্ধ হন আট বছরের জন্য।
শাস্তি কাটিয়ে সেই আশরাফুল পরে আবার ফিরেছেন মাঠে। কিন্তু নিষিদ্ধ পথে একবার গিয়ে ফিরে এসেও কি আর আগের জায়গাটা পাওয়া যায়! আশরাফুলও পেলেন না। ২০১৩ সালের বিপিএলের স্পট ফিক্সিং-কাণ্ড তাঁর ক্যারিয়ারে যে কালো ছায়া ফেলল, তা থেকে পুরোপুরি আর বের হওয়া হলো না ক্রিকেটার আশরাফুলের।
কিন্তু খেলা ছেড়ে আগামী মৌসুম থেকে কোচদের খাতায় নাম লেখানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া আশরাফুল এবার সেই ঘটনার একটা ইতিবাচক দিকও যে খুঁজে পাচ্ছেন!
সম্প্রতি আবুধাবি থেকে আইসিসি ও আফগানিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের আয়োজনে লেভেল-৩ কোচিং কোর্স করে এসেছেন। সেটি নিয়েই গতকাল প্রথম আলোর নেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আশরাফুলের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, কোচের ভূমিকায় গেলে স্পট ফিক্সিংয়ে জড়ানোর ঘটনা কোনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে কি না।
উত্তরে জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক যা বললেন, তাতে মনে হলো ওই কালো অধ্যায়ের একটা ‘আলোকিত’ দিকও তিনি দেখতে পাচ্ছেন। আশরাফুল বলেছেন, ‘আশা করি কোনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে না। পড়লে ইতিবাচক প্রভাবই পড়ার কথা। কারণ সেই ঘটনাও ক্রিকেটেরই অংশ।’
ক্রিকেটের সেই অংশটার ‘অংশ’ হয়ে যাওয়ায় একটা বাড়তি অভিজ্ঞতা হয়েছে বলেই মনে করেন আশরাফুল, ‘ক্রিকেটাররা আইসিসির দুর্নীতি দমন বিভাগের বিভিন্ন প্রোগ্রামে অংশ নেয়। তারপরও আমরা ভুল করে ফেলি। আমি ভুল করেছি, তা স্বীকার করেছি এবং তার শাস্তিও পেয়েছি। এ ধরনের পরিস্থিতি কীভাবে সামলাতে হয়, সেটা এখন আমার চেয়ে ভালো কেউ বলতে পারবে না।’
সর্বোচ্চ পর্যায়ের কোচিং কোর্স করার পর আশরাফুলের ইচ্ছা, আগামী বছর থেকেই ঘরোয়া ক্রিকেট কোচ হিসেবে কাজ শুরু করবেন। তার আগে অবশ্য প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে পূর্ণ করতে চান ১০ হাজার রান। বর্তমানে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ৯১৯২ রানের মালিক আশরাফুল, সে জন্য পাখির চোখ করছেন আগামী জাতীয় লিগকে।
আশরাফুলের বিশ্বাস, জাতীয় দলকে নেতৃত্ব দেওয়ার অভিজ্ঞতাও কোচের কাজে তাঁকে সাহায্য করবে। তবে এ ক্ষেত্রে একাধিকবার বলেছেন ক্রিকেটার হিসেবে নিজের ক্যারিয়ারের উত্থান-পতনের কথা। ঘরোয়া ক্রিকেট থেকে শুরু করলে আশরাফুলের খেলোয়াড়ি জীবনের অভিজ্ঞতা ২৬-২৭ বছরের।
নতুন জীবনে সে অভিজ্ঞতাই বড় সাহস হবে মনে করছেন তিনি, ‘ক্যারিয়ারের অনেক উত্থান-পতন আমার দেখা। কিসে একজন ক্রিকেটারের ভালো হয়, কিসে খারাপ হয়; এগুলো আমি খুব ভালো বুঝি।’
স্পট ফিক্সিং-কাণ্ডের পর আশরাফুলের সেই বোধ আরও দৃঢ় হয়ে থাকবে। তাঁর নিজের অন্তত সেটিই মনে হচ্ছে, ‘আমি নিজেকে সব সময় একজন ইতিবাচক মানুষ ভাবি। আমার জীবনে যে ঘটনা ঘটেছে, ইতিবাচক মানসিকতা না থাকলে সেখান থেকে ফিরে আসা সহজ হতো না। একটা পর্যায়ে তো মনে হয়েছিল আত্মহত্যা করি। ইতিবাচক চিন্তা করেই সে অবস্থা থেকে ফিরে এসেছি।’
এসব কারণেই আশরাফুলের উপলব্ধি—যেহেতু বাংলাদেশের ক্রিকেট এবং একজন ক্রিকেটারের জীবনের সব অলিগলি তাঁর দেখা হয়ে গেছে, কোচ হিসেবে এ দেশের ক্রিকেটারদের পথ দেখানোর কাজটা তিনি খারাপ করবেন না। আর সাক্ষাৎকারে তো আশরাফুল এমনও বললেন, এই কাজটা তিনি করে আসছেন খেলোয়াড়ি জীবন থেকেই।
এ প্রসঙ্গে ২০০১ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে খেলা চট্টগ্রাম টেস্টের এক ঘটনা মনে পড়ে গেল আশরাফুলের, ‘সুমন ভাইয়ের (হাবিবুল বাশার) ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরির সময় উইকেটে আমি ওনার সঙ্গী ছিলাম। উনি প্রায়ই ৬০-৭০-এর ঘরে আউট হয়ে যেতেন। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ওই টেস্টের আগের টেস্টেও ঢাকায় ৬৫ রানে আউট হয়ে গিয়েছিলেন। চট্টগ্রামে পরের টেস্টের প্রথম ইনিংসে ওনার যখন ৭২ রান, আমি বলেছিলাম, আপনার আর ২৮ রান লাগে (সেঞ্চুরি হতে)। কিন্তু ২৮ চিন্তা না করে আপনি চিন্তা করেন আপনি সাতটা চার মারবেন। আপনি তো চার ভালো মারেন। চার মারেন না…।’
দৌড়ে রান নেওয়ার চেয়ে বাউন্ডারি মারাতেই বেশি স্বচ্ছন্দ ছিলেন হাবিবুল। আশরাফুলেরও মনে হয়েছিল, ওই পথে গেলেই হাবিবুলের জন্য স্নায়ুচাপ এড়িয়ে প্রথম তিন অঙ্কের দেখা পাওয়াটা সহজ হবে, ‘আমি এটা বলেছিলাম কারণ উনি (হাবিবুল) বাউন্ডারি মারতে পছন্দ করতেন। পরে সুমন ভাই একটা করে বাউন্ডারি মারেন, আর আমি বলতে থাকি, ‘এই তো…একটা শেষ। আরেকটা…।’ এরপর এক শ হয়ে যাওয়ার পর উনি এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলতে থাকেন, ‘আমার কাজটা তুই অনেক সহজ করে দিয়েছিস।’
এখন দেখার অপেক্ষা খেলোয়াড়ি জীবনের এসব অভিজ্ঞতা, উত্থান-পতন ‘কোচ’ আশরাফুলের কাজ আসলে কতটা সহজ করে।
* মোহাম্মদ আশরাফুলের পুরো সাক্ষাৎকারটি পড়ুন আজ ৪ জুনের ছাপা সংস্করণে।