অজিঙ্কা রাহানে নাকি আন্দ্রে রাসেল? ধরুন, আপনি টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে একাদশ গড়বেন, ব্যাটিং পারফরম্যান্সের ভিত্তিতে কাকে দলে নেবেন?
প্রশ্নকর্তাকে পাগলও ভাবতে পারেন। এটা কোনো প্রশ্ন হলো! রাসেল যেখানে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের ‘ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর’, রাহানে তো এই সংস্করণের ‘উপাদান’ই নন!
রাহানের টুকটুক ব্যাটিং টি-টোয়েন্টির সঙ্গে যায় নাকি! জবাবটা পুরোপুরি উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। কারণ, গত বছরের আগপর্যন্ত রাহানের ব্যাটিংয়ে টি-টোয়েন্টির ঝাঁজ কমই ছিল।
তবে ২০২৩ আইপিএল দেখলে রাহানেকে নিয়ে ভাবনার পরিবর্তন হতে বাধ্য। টুকটুক ব্যাটিংয়ের জন্য টি-টোয়েন্টিতে ব্রাত্য হয়ে পড়া রাহানে গত আইপিএলে কত স্ট্রাইকরেটে ব্যাটিং করেছেন, জানেন? ১৭২.৪৯। কলকাতার রাসেল কত? ১৪৫.৫১।
বলতে পারেন, এক আসরের পারফরম্যান্সেই রাহানে রাসেলের বিকল্প হয়ে ওঠেননি। তবে এই যে রাহানে নিজেকে ভেঙেচুরে স্ট্রাইকরেটের বিবেচনায় রাসেলের সঙ্গে তুলনায় এসেছেন, সেটাই বা কম কিসে!
রাহানের নিজেকে ভেঙেচুরে নতুন করে গড়ার গল্পের মাহাত্ম্য বুঝতে হলে তাঁর আইপিএল ক্যারিয়ারের স্ট্রাইকরেটে চোখ দিতে হবে। সব মিলিয়ে আইপিএলে রাহানের ব্যাটিং স্ট্রাইকরেট ১২৩.৫২।
২০২৩ সালে ১৪ ম্যাচ খেলা রাহানে এর আগের দুই মৌসুম মিলিয়ে খেলেছিলেন মাত্র ৯ ম্যাচ। দিল্লি ও কলকাতার একাদশে তাঁর জায়গাই হতো না। সেই রাহানে গত মৌসুমে চেন্নাইয়ে এসে বদলে গেলেন। বলে রাখা ভালো, তাকে কেনা হয়েছিল ভিত্তিমূল্যে। অর্থাৎ কোনো দলের আগ্রহ তাঁর প্রতি ছিল না। তাঁর বদলে যাওয়ার গল্পের মূল নায়ক রাহানে নিজে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে পেছন থেকে ভূমিকা রেখেছেন আরও একজন—তিনি মহেন্দ্র সিং ধোনি। কীভাবে?
হার্শা ভোগলে শুনিয়েছিলেন সেই গল্প। রাহানেকে দলে নেওয়ার পর ধোনি তাকে বলেছিলেন, ‘তোমার ভূমিকা এমন, কীভাবে করবে সেটা বলব না। কারণ, সেটা বোঝার মতো অভিজ্ঞতা ও সামর্থ্য তোমার আছে।’ ব্যস, এটুকুই! এরপর রাহানে এমন পরিষ্কার বার্তা পেয়ে ব্যাটকে রীতিমতো তলোয়ারে পরিণত করেন।
এ তো গেল রাহানের বদলে যাওয়ার গল্প। চেন্নাইয়ে গিয়ে বদলে যাওয়ার গল্প আছে আরও। শিভাম দুবের কথাই ধরুন না। পাওয়ার হিটার হিসেবে ভারতের ঘরোয়া ক্রিকেটে নামডাক আছে তাঁর। তবে নিজের প্রতিভার বিস্ফোরণ দেখাতে শেষ পর্যন্ত তাকে চেন্নাইয়েই আসতে হয়েছে।
২০১৯ সালে প্রথমবার আইপিএল খেলা দুবে ধোনির দলের হয়ে প্রথমবার খেলেন ২০২২ সালে। চেন্নাইয়ের হয়ে প্রথম মৌসুমে মাঠে নামার আগে তাঁর সর্বোচ্চ স্ট্রাইকরেট ছিল ২০২০ সালে বেঙ্গালুরু হয়ে—১২২.৪৬। সামর্থ্য নিয়ে প্রশ্ন ওঠা দুবে চেন্নাইয়ে এসে প্রথম মৌসুমেই রান তোলেন ১৫৬.২২ স্ট্রাইকরেটে। গত মৌসুমে যা আরও বেড়েছে—১৫৮.৩৩। মাঝের ওভারে (৭-১৫) তো তাঁর সামনে স্পিনাররা বল করতেই আতঙ্কে থাকেন। ২০২২ ও ২০২৩ আসরে মিডল ওভারে স্পিনারদের বিপক্ষে দুবের স্ট্রাইকরেট ১৫৯.৭৯।
পেসার দীপক চাহার, শার্দুল ঠাকুররা চেন্নাই ছাড়া অন্য যেকোনো দলের হয়ে খেললেই হয়ে ওঠেন রান মেশিন। অথচ চেন্নাইয়ের জার্সিতে তাদের অন্য রূপে দেখা যায়। এই যে চেন্নাইয়ে এসে বদলে যাওয়া, এর কারণ মনে করা হয় দলটির সংস্কৃতি। ধোনির চেন্নাইয়ে এলে ক্রিকেটাররা পরিষ্কার ভূমিকা পান। সেই দায়িত্ব পালনে যথেষ্ট সুযোগও পান।
বদলে যাওয়ার গল্পের তালিকায় বাংলাদেশি সমর্থকেরা নতুন একটি পাতা যোগ করতে চাইবেন। বিশেষ করে মোস্তাফিজুর রহমান গত পরশু ৪ উইকেট নিয়ে ম্যাচসেরা হওয়ার পর। তাঁরও যে বদলে যাওয়া খুবই দরকার। জাতীয় দল কিংবা ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ, কোনো জায়গাতেই মোস্তাফিজের বোলিংয়ে পুরোনো ধার নেই। এই যেমন সর্বশেষ শ্রীলঙ্কা সিরিজে ৩ ম্যাচ খেলেছেন, উইকেট নিয়েছেন মাত্র দুটি, রান দিয়েছেন ওভারপ্রতি ১০.৯১ রান করে। সর্বশেষ ১০ আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে তাঁর উইকেটসংখ্যা মাত্র ৭টি। এর আগে বিপিএলেও নিজের ছায়া হয়েই ছিলেন। ১০ ম্যাচে উইকেট নিয়েছেন ১৩টি, তবে ওভারপ্রতি খরচ করেছেন ৯.৩৩ রান।
আইপিএলে তো মোস্তাফিজ বেঞ্চ গরম করাকে অভ্যাস বানিয়ে ফেলেছেন। গত পরশু যে চেন্নাইয়ের হয়ে ম্যাচ পেয়েছেন সেটাও মাতিশা পাতিরানার চোটের কারণে। অথচ কী দারুণভাবেই না একসময় আইপিএল শুরু করেছিলেন তিনি। প্রথম মৌসুমে (২০১৬) ১৬ ম্যাচ খেলে ১৭ উইকেট নেওয়ার পথে ওভারপ্রতি রান খরচ ছিল মাত্র ৬.৯০। সেবার হায়দরাবাদের শিরোপা জয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল মোস্তাফিজের বোলিংয়ের। আইপিএলের সেরা উদীয়মান খেলোয়াড়ের পুরস্কারটাও উঠেছিল তাঁর হাতে।
এরপর আর কোনো মৌসুমে সেই পুরোনো মোস্তাফিজকে দেখা যায়নি। ২০২৩ সালে দিল্লি ক্যাপিটালসে মাত্র ২টি ম্যাচই খেলার সুযোগ পান মোস্তাফিজ, দুটির পারফরম্যান্সই ভুলে যাওয়ার মতো—৭ ওভারে ৭৯ রান দিয়ে ১টিই উইকেট। মোস্তাফিজের পারফরম্যান্সের গ্রাফ এমন নিচের দিকে যাওয়ার কারণ কী, সেটা এককথায় বলার সুযোগ নেই। তবে ধারণা করা হয়, তাঁর স্লোয়ার-কাটার ধরন-ধারণ ব্যাটসম্যানদের মুখস্থ হয়ে গেছে।
এবারের আইপিএলে মোস্তাফিজ অন্য কোনো দলে খেললে হয়তো তাঁর বদলের প্রত্যাশা কেউ করতেন না। তবে উইকেটের পেছনে ধোনি আছেন বলে প্রত্যাশাটা বেড়েছে। সেটা ধোনি অধিনায়ক না থাকলেও। কাটার আর স্লোয়ারে অনুমেয় হয়ে যাওয়া মোস্তাফিজ ধোনি-বাহিনীর সাহচর্যে হয়তো বদলে যেতে পারেন। কখন কোন বোলিং করতে হবে, অভিজ্ঞ ধোনি সেই কৌশল বাতলে দিতে পারেন। মোস্তাফিজের নিজের অভিজ্ঞতাও কম নয়। চেন্নাইয়ের বোলিং কোচ ড্যারেন ব্রাভো, যিনি আবার স্লোয়ারের জন্য বিখ্যাত ছিলেন, তাঁর পরামর্শও মোস্তাফিজের স্লোয়ারকে আরও কার্যকরী করে তুলতে পারে।
চেন্নাইয়ে কাজটাও হয় অনেকটা সিনেমার স্ক্রিপ্টের মতো। একেকজনের ভূমিকা একেক রকম। এই যেমন চাহার সামলান নতুন বল, পাতিরানা পুরোনো বল। খুব বেশি পরিবর্তনে তারা বিশ্বাসী নয়। চেন্নাইয়ে মোস্তাফিজও যদি নিজের তেমন ভূমিকা খুঁজে নিতে পারেন, তাহলে আখেরে লাভ বাংলাদেশেরই। তবে সে জন্য তাঁকে পর্যাপ্ত সুযোগ পেতে হবে। পাতিরানার চোটে মোস্তাফিজ সেটা পেতেও পারেন। মোস্তাফিজ কি তা পারবেন?