বাংলাদেশ দলের অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান
বাংলাদেশ দলের অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান

সাকিব তাহলে ওয়ানডেই বা খেলবেন কীভাবে

টেস্ট ক্রিকেটটা সম্ভবত তাঁর আর খেলা হচ্ছে না। খেললেও বড়জোর আর একটি সিরিজ। যদি সুযোগ পান ঘরের মাঠে  দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে মিরপুরে খেলবেন ক্যারিয়ারের শেষ টেস্ট ম্যাচ। আর নয়তো ভারতের বিপক্ষে কানপুর টেস্টই হয়ে থাকবে সাকিব আল হাসানের শেষ টেস্ট। আপাতত সে সম্ভাবনাই বেশি মনে হচ্ছে।

টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট নিয়েও একই কথা বলেছেন সাকিব। আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট আর খেলবেন না। ক্রিকেট বোর্ড যদি তাঁকে দলে প্রয়োজন মনে করে, তাহলে ভবিষ্যতে হয়তো ভেবে দেখবেন। তবে এ ক্ষেত্রে সাকিবের নিজের অবস্থান পরিষ্কার। তিনি বলেছেন, গত বিশ্বকাপেই খেলে ফেলেছেন শেষ আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ম্যাচ।

যে ক্রিকেটারকে আপনি দেশে নিরাপদে খেলতে দিতে পারছেন না, তাঁকে দেশের বাইরের সিরিজেই বা কেন দলে নেবেন? যেসব বিতর্কের কারণে সাকিব দেশের মাটিতে খেলতে পারবেন না, সেসব কারণে তো নীতিগতভাবে তাঁর জাতীয় দলেই খেলতে পারার কথা নয়! আইনের চোখে যে ব্যক্তি ‘আসামি’, তিনি কিভাবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দেশকে প্রতিনিধিত্ব করেন? বিসিবি এবং রাষ্ট্রই বা সেটা কীভাবে হতে দিচ্ছে? বিদেশে যদি তাঁকে দলে রাখা যায়, তাহলে ঘরের মাঠে তাঁর খেলার ব্যবস্থা করতে সমস্যা কোথায়?

সাকিব যে সংস্করণের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট চালিয়ে যাবেন বলে মনস্থির করেছেন, সেটি ওয়ানডে। ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তানে হতে যাওয়া চ্যাম্পিয়নস ট্রফি দিয়েই ওয়ানডে ক্রিকেটকে বিদায় জানানোর ইচ্ছা এই অলরাউন্ডারের। কিন্তু ওয়ানডে সংস্করণ নিয়েই প্রশ্ন—চ্যাম্পিয়নস ট্রফি পর্যন্ত সাকিব কীভাবে খেলাটা খেলে যাবেন?

বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়নস ট্রফির আগে ওয়ানডে ম্যাচ খেলবে ছয়টি। ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজের তিনটি তো পূর্বনির্ধারিতই, ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরের আগে নভেম্বরেই সংযুক্ত আরব আমিরাতের শারজায় আফগানিস্তানের বিপক্ষেও খেলবে তিন ওয়ানডের সিরিজ। প্রশ্ন হলো, সাকিব আফগানিস্তান এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে এই ছয়টি ম্যাচ খেলবেন কোন প্রক্রিয়ায়? নির্বাচক কমিটি তাঁকে দলে নেবে কীভাবে?

সাকিব আল হাসান কি অক্টোবরে দেশে ফিরবেন?

সাকিব যদি বাংলাদেশে না থাকেন বা থাকতে না পারেন, তাহলে দলের সঙ্গে থেকে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও আফগানিস্তান সিরিজের প্রস্তুতি নিতে পারবেন না। ওদিকে বর্তমান বোর্ড সভাপতি ফারুক আহমেদ ও প্রধান নির্বাচক গাজী আশরাফ হোসেনের নীতি কঠোর। দুজনই যাঁর যাঁর পদে দায়িত্ব নিয়ে বলেছিলেন, দলের সঙ্গে প্রস্তুতি না নিলে বা অনুশীলন না করলে জাতীয় দলে কোনো খেলোয়াড়কে বিবেচনা করা হবে না।

আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য হওয়ায় সাকিব বর্তমানে যে জটিল পরিস্থিতির মধ্যে আছেন, তাতে তাঁর পক্ষে দেশে থেকে অনুশীলন করা একটু কঠিনই মনে হচ্ছে। কিংবা বলা ভালো, তিনি মনে করেন আপাতত তাঁর জন্য সে পরিবেশ এখানে নেই। মামলা, আওয়ামী–বিরোধীদের রোষানলে পড়ার শঙ্কা এবং যুক্তরাষ্ট্রে যেতে পারার অনিশ্চয়তা মিলে তাঁর এ রকম মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক।

তা এ দুটি সিরিজ যদি তিনি না খেলেন, চ্যাম্পিয়নস ট্রফিই বা খেলবেন কিভাবে? হুট করে তো আর দলে ঢুকতে পারবেন না সাকিব। তিনি নিজেও সম্ভবত তা চাইবেন না। খেলতে হলে ফিটনেস, ফর্ম এসবও তো লাগে। তাহলে কি এটাই ধরে নিতে হবে যে, সাকিবের ওয়ানডে ক্যারিয়ারটাও এরই মধ্যে শেষ দিগন্ত দেখে ফেলেছে!

সম্প্রতি টি–টোয়েন্টি ও টেস্ট থেকে অবসরের ঘোষণা দিয়েছেন সাকিব আল হাসান

সাকিবের বর্তমান সংকটময় পরিস্থিতির অন্যতম কারণ, তিনি ছিলেন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য এবং তিনি একজন হত্যা মামলার আসামিও। সাকিব আগামী মাসের দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজে ঘরের মাঠে শেষ টেস্ট খেলার ইচ্ছার কথা জানিয়ে দেশে আসার ও দেশ থেকে নির্বিঘ্নে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার নিশ্চয়তা চেয়েছেন।

তবে এ ক্ষেত্রে বিসিবি ও সরকারের এখন পর্যন্ত যে অবস্থান, তাতে এটা অন্তত মনে করার কোনো কারণ নেই যে সাকিবকে খুব আনন্দের সঙ্গে দেশে স্বাগত জানানো হবে। বরং পদে পদে যেন তাঁকে এটাই মনে করিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তিনি এই দেশে আর খুব একটা কাঙ্ক্ষিত নন। তাঁর প্রয়োজন ফুরিয়েছে। যতই নিজের দেশ হোক, এখানে এসে শান্তিতে শেষ টেস্ট খেলতে চাইলে অলিখিত কিছু শর্ত মেনেই আসতে হবে। নয়তো না আসাই ভালো। তার মানে ওয়ানডে ক্রিকেটেও এখনই একরকম জোর করেই অঘোষিত অবসরের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে সাকিবকে!

অতৃপ্তিটা অবশ্য একা সাকিবের হবে না, হবে বাংলাদেশের ক্রিকেটেরও। এই দেশের ক্রিকেটের একটা দুর্নাম, ক্রিকেটাররা এখানে ভালোভাবে অবসর নিতে পারেন না। আগে থেকে অবসরের ঘোষণা দিয়ে সাকিব ব্যতিক্রম হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু লাভ হলো কী? সেই তো বিতর্ক, সমালোচনা।

আর যে ক্রিকেটারকে আপনি দেশে নিরাপদে খেলতে দিতে পারছেন না, তাঁকে দেশের বাইরের সিরিজেই বা কেন দলে নেবেন? যেসব বিতর্কের কারণে সাকিব দেশের মাটিতে খেলতে পারবেন না, সেসব কারণে তো নীতিগতভাবে তাঁর জাতীয় দলেই খেলতে পারার কথা নয়! আইনের চোখে যে ব্যক্তি ‘আসামি’, তিনি কিভাবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দেশকে প্রতিনিধিত্ব করেন? বিসিবি এবং রাষ্ট্রই বা সেটা কীভাবে হতে দিচ্ছে? অন্যভাবে বললে বিদেশে যদি তাঁকে দলে রাখা যায়, তাহলে ঘরের মাঠে তাঁর নিরাপদে খেলার ব্যবস্থা করতে সমস্যা কোথায়?


১৭ বছরের ক্রিকেট ক্যারিয়ারের চেয়ে সাকিবের ৭ থেকে ৮ মাসের রাজনৈতিক পরিচয়ই যদি মুখ্য হয়, সেটা দেশে যা, বিদেশেও তা। তাহলে দেশে অগ্রহণযোগ্য সাকিব বিদেশের মাটিতে কীভাবে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করবেন, এই প্রশ্ন ওঠা খুবই স্বাভাবিক। দুটো চিন্তা পুরোপুরিই সাংঘর্ষিক।

আর যদি সাকিব শেষ ম্যাচটা দেশে খেলেনই এবং খেলায় ভালো কিছু করে বসেন, দলকে জিতিয়ে দেওয়া পারফর্ম করেন, মন খুলে কি উল্লাস করতে পারবে বাংলাদেশ! উল্টো ক্ষেত্রেও হতে পারে অতি প্রতিক্রিয়া। ধরুন, দেশের মাটিতে শেষ ম্যাচে সাকিব ভালো খেললেন না, গুরুত্বপূর্ণ সময়ে আউট হয়ে গেলেন, বোলিংয়ে মার খেলেন; কী পরিস্থিতিতে তাঁকে পড়তে হবে ভাবুন একবার। ক্রিকেটীয় বিবেচনা তখন কারও মধ্যে কাজ করবে বলে মনে হয় না।

দেশে ফিরতে নিরাপত্তা চান সাকিব

এভাবে ভাবলে সাকিব নিজেও তাঁর শেষ টেস্ট খেলতে দেশে আসতে চাইবেন কি না সন্দেহ। সে ক্ষেত্রে হয়তো কানপুরেই তিনি খেলে ফেলছেন তাঁর শেষ টেস্ট ম্যাচ। ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া যদিও বলেছেন, সাকিব নিজের রাজনৈতিক অবস্থান পরিষ্কার করলে হয়তো তাঁর ওপর মানুষের ক্ষোভ কমতে পারে। সে ক্ষেত্রে দেশে এসে খেলাটাও তাঁর জন্য সহজ হবে। কিন্তু এমন স্ববিরোধী আত্মসমর্পণ কি করবেন সাকিব?

ক্যারিয়ারের শেষ টেস্টটা দেশের মাটিতে খেলার যে ব্যগ্রতা সাকিবের মধ্যে আছে, বিশ্ব ক্রিকেটে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় তারকাকে ঘরের মাঠে আড়ম্বড়পূর্ণ পরিবেশে বিদায় দেওয়ার ব্যগ্রতা তো থাকা উচিত এ দেশের ক্রিকেটেরও। অথচ ক্রিকেট পাগল এই জাতি হঠাৎ করেই যেন ক্রিকেটের রীতি–নীতি ভুলতে বসেছে। সাকিবের মতো একজন কিংবদন্তীকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় বলার সুযোগ কি আর পাবে বাংলাদেশের ক্রিকেট!

কেন জানি মনে হচ্ছে, সাকিব হয়তো তিন সংস্করণেই দেশের হয়ে তাঁর শেষ ম্যাচ খেলে ফেলেছেন। সেটি হলে বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা ক্রিকেটারের ১৭ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারেও মিশে থাকবে ছোট গল্পের ‘শেষ হইয়াও হইল না শেষ’–এর অতৃপ্তি।

তবে অতৃপ্তিটা একা সাকিবের হবে না, অতৃপ্ত থেকে যাবে বাংলাদেশের ক্রিকেটই। এই দেশের ক্রিকেটের একটা দুর্নাম, ক্রিকেটাররা এখানে ভালোভাবে অবসর নিতে পারেন না। আগে থেকে অবসরের ঘোষণা দিয়ে সাকিব ব্যতিক্রম হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু লাভ হলো কী? সেই তো বিতর্ক, সমালোচনা।

আসলে সাকিবের মতো বাংলাদেশের ক্রিকেটেরও যেন দুর্ভাগ্য। দেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় কিংবদন্তির বিদায়টা হচ্ছে তিক্ততা দিয়ে। যেটাকে ‘বিদায়’ না বলে ‘বিতাড়ন’ বলাই বোধ হয় যথার্থ হবে।