কামিন্দু মেন্ডিস।
আপনি বাংলাদেশের ক্রিকেটের ভক্ত বা সমর্থক হয়ে থাকলে নামটা ভোলার কথা নয়! হৃদয়ে তৈরি হওয়া ক্ষতের দাগ কি কেউ সহজে ভোলে! তা ছাড়া বেশি দিন তো আর নয়, গত মার্চের কথা। দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজে বাংলাদেশকে শ্রীলঙ্কা যে নাকানিচুবানি খাইয়েছিল, সে তো ওই কামিন্দু মেন্ডিসের হাত ধরেই।
দুটি করে সেঞ্চুরি ও ফিফটিতে দুই ম্যাচের সেই সিরিজে করেছিলেন ৩৬৮ রান, সঙ্গে নেন ৩ উইকেট। বাংলাদেশকে ২–০ ব্যবধানে সিরিজ হারিয়ে কামিন্দুই হয়েছিলেন সিরিজসেরা। সেই সিরিজের পর কামিন্দুর ছিল ইংল্যান্ড–পরীক্ষা। যে পরীক্ষা এখন চলছে। ভিন্ন কন্ডিশন, ভিন্ন খেলোয়াড়দের সামনেও বাংলাদেশ সিরিজের কামিন্দুকেই দেখা যাচ্ছে। প্রতি ম্যাচেই ইংল্যান্ডের বোলারদের গলার কাঁটা হয়ে আটকে থাকছেন।
বাংলাদেশের মতো ইংল্যান্ড সিরিজে ম্যাচের ফল এখন পর্যন্ত শ্রীলঙ্কার পক্ষে আনতে পারেননি। তাতে কী! কামিন্দু তো সেই কামিন্দুই আছেন। মার্ক উড–গাস অ্যাটকিনসন–ক্রিস ওকসদের আগুনঝরা বোলিংয়ের সামনে লড়ে যাচ্ছেন বুক চিতিয়ে।
ওল্ড ট্রাফোর্ডে সিরিজের প্রথম টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে কামিন্দু করেছেন ১১৩ রান। এরপর লর্ডসে প্রথম ইনিংসে ৭৪ রানের পর ওভালে তৃতীয় টেস্টের প্রথম ইনিংসে অপরাজিত আছেন ৫৪ রান নিয়ে। অর্থাৎ ইংল্যান্ড সিরিজের তিন টেস্টেই পঞ্চাশোর্ধ্ব রানের ইনিংস খেললেন।
বাংলাদেশ সিরিজের আগে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে অভিষেক টেস্টেও খেলেছিলেন ৬১ রানের ইনিংস। কামিন্দুর ক্যারিয়ারের প্রথম ৬ টেস্টে পঞ্চাশ বা এর বেশি রানের ইনিংস ৭টি, যা যৌথভাবে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। প্রথম ৬ টেস্টে সমান ৭টি পঞ্চাশ বা তার চেয়ে বেশি রানের ইনিংস আছে বার্ট সাটক্লিফ, হ্যারি ব্রুক ও সৌদ শাকিলের। এই তালিকায় সবার ওপরে সুনীল গাভাস্কার (৯টি)।
অভিষেকের পর টানা পঞ্চাশোর্ধ্ব রানের ইনিংস খেলা ব্যাটসম্যানদের তালিকাতেও কামিন্দু যৌথভাবে দ্বিতীয় (৬)। এই তালিকায় তাঁর সঙ্গে নাম আছে ভারতের সুনীল গাভাস্কার, ওয়েস্ট ইন্ডিজের বাসিল বুচার, পাকিস্তানের সাঈদ আহমেদ ও নিউজিল্যান্ডের বার্ট সাটক্লিফের। আর পাকিস্তানের শাকিল আছেন সবার ওপরে। গত বছরের জুলাইয়ে ক্যারিয়ারের প্রথম সাতটি টেস্টেই ফিফটি করার রেকর্ড গড়েছিলেন এই বাঁহাতি।
এত গেল স্রেফ সংখ্যার কথা। ম্যাচ পরিস্থিতি তো আর সংখ্যা দিয়ে বোঝানো সম্ভব নয়। ২৫ বছর বয়সী এই অলরাউন্ডার মাত্র ৬ টেস্ট আর ১০ ইনিংসের অভিজ্ঞতায় কতটা পরিপক্বতার পরিচয় দিচ্ছেন, সেটা ম্যাচ পরিস্থিতির দিকে তাকালে ধারণা পাওয়া যাবে।
১০ ইনিংসের ক্যারিয়ারে বেশির ভাগ ম্যাচেই দলকে টেনে তুলেছেন এই অলরাউন্ডার। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ওল্ড ট্রাফোর্ডে যখন ক্রিজে এসেছেন, দলের রান ৪ উইকেটে ৯৫। দ্বিতীয় ইনিংসে শ্রীলঙ্কা তখন এগিয়ে ৫ রানে। সেখান থেকে সেঞ্চুরি করে দলকে ২০৫ রানের লিড এনে দেন কামিন্দু। দলকে বাঁচান বড় হারের লজ্জা থেকে। শ্রীলঙ্কার ২০৫ রান চতুর্থ ইনিংসে পেরোতে ৫ উইকেট হারিয়েছিল ইংল্যান্ড।
পরের টেস্টেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। কামিন্দু উইকেটে আসার আগেই শ্রীলঙ্কা বিপদে, ৮৩ রানে নেই ৫ উইকেট। সেখানে দাঁড়িয়ে কখনো লাহিরু কুমারা, কখনো মিলন রত্নানায়েকের সঙ্গে জুটি গড়ে শ্রীলঙ্কাকে টেনে তুলেছেন। দলীয় রান যদিও খুব একটা বেশি হয়নি। ১৯৬ রানের মধ্যে ৭৪ রান করেছিলেন ৭ নম্বরে নামা কামিন্দু, দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ছিল দিনেশ চান্ডিমালের ২৩।
যদিও টেস্ট ক্রিকেট এখনো তাঁর বিশেষ একটি গুণ দেখেনি। কামিন্দু যে সব্যসাচী বোলার! ডান বা বাঁহাতি ব্যাটসম্যান দেখে বোলিংয়ে কামিন্দুও হাত বদল করতে পারেন।
ওভালে কালও শ্রীলঙ্কা যখন ৯৩ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে বিপর্যস্ত, উইকেটে আসেন কামিন্দু। এদিন অবশ্য বোলারদের সঙ্গে নয়, জুটি গড়েছেন অধিনায়ক ধনঞ্জয়া ডি সিলভার সঙ্গে। ধনঞ্জয়ার সঙ্গে ১১৮ রানের অবিচ্ছিন্ন জুটি দিনের খেলা শেষ করেছেন। তাঁর ব্যাটিংয়ে ভর করেই প্রথম ইনিংসে ইংল্যান্ডের করা ৩২৫ রানের জবাব দিচ্ছে শ্রীলঙ্কা। গতকাল দ্বিতীয় দিন শেষে ৫ উইকেটে তাদের রান ২১১।
এর আগে বাংলাদেশের সিরিজের কথাই মনে করুন। সিলেটে সিরিজের প্রথম টেস্টের প্রথম ইনিংসে ৫৭ রানে শ্রীলঙ্কার ৫ উইকেট পড়ে যাওয়ার পর কামিন্দু খেলেন ১০২ রানের ইনিংস।
দ্বিতীয় ইনিংসে ১২৬ রানে ৬ উইকেট হারিয়ে শ্রীলঙ্কা যখন আবার বিপদে পড়ে, সেবারও কামিন্দুর ব্যাট থেকে আসে ১৬৪ রানের ইনিংস। এই টেস্টে প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে সাত বা এর পরে ব্যাটিংয়ে নেমে দুই ইনিংসেই সেঞ্চুরির রেকর্ড গড়েন কামিন্দু। চট্টগ্রামে সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টের প্রথম ইনিংসেও ৯২ রানে অপরাজিত ছিলেন। বিপদের মুহূর্তেও কামিন্দু ইতিবাচক স্ট্রাইক রেটেই ব্যাটিং করেন!
মাত্র ১০ ইনিংস ব্যাটিং করেই কামিন্দু দেখিয়েছেন কীভাবে দলকে টানতে হয়। নিচের দিকের ব্যাটসম্যানদের সঙ্গে ব্যাটিং করে প্রতিপক্ষের সঙ্গে কীভাবে খেলতে হয় মনস্তাত্ত্বিক খেলা। মাঝেমধ্যে ঝুঁকিও নিতে হয়।
যদিও টেস্ট ক্রিকেট এখনো তাঁর বিশেষ একটি গুণ দেখেনি। কামিন্দু যে সব্যসাচী বোলার! ডান বা বাঁহাতি ব্যাটসম্যান দেখে বোলিংয়ে কামিন্দুও হাত বদল করতে পারেন। যার মানে, দুই হাতেই বল করতে অভ্যস্ত কামিন্দু। ব্যাটিংয়ে নিজেকে এরই মধ্যে চিনিয়েছেন, এখন দেখার অপেক্ষা বোলিংয়ে সব্যসাচী এই বোলার ভবিষ্যতে নিজেকে কীভাবে তুলে ধরতে পারেন!