আবারও বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের কোচ হিসেবে ফিরেছেন চন্ডিকা হাথুরুসিংহে। এর আগে বাংলাদেশ থেকে যাঁর বিদায়টা মোটেই প্রীতিকর ছিল না। তা ভুলে গিয়ে হাথুরুসিংহেকে ফিরিয়ে আনায় সবচেয়ে বড় ভূমিকা বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসানের। তাঁর কাছে সেটির কারণ জানতে চেয়েছিলেন উৎপল শুভ্র।
উৎপল শুভ্র: চন্ডিকা হাথুরুসিংহেকে আবারও বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের কোচ হিসেবে ফিরিয়ে আনাটা মূলত আপনার সিদ্ধান্ত বলেই জানি। কারণটা কী বলা যায়?
নাজমুল হাসান: প্রথম কারণ, হাথুরুকে পুরো সময় পাওয়া যাবে। আর যাঁরা ভালো কোচ আছেন, তাঁরা কেউই নিরবচ্ছিন্ন সময় দিতে পারবেন না। বিভিন্ন ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগের জন্য তাঁদের ছেড়ে দিতে হবে। আমাদের পছন্দের তালিকায় যাঁরা ছিলেন, তাঁদের অনেকে আবার বর্তমান চাকরিতে ২০২৪ পর্যন্ত চুক্তিবদ্ধ। ২০২৪ সালের আগে আসবেন না। কিন্তু আমাদের তো সামনেই বিশ্বকাপ। এখনই কোচ লাগবে।
শুভ্র: আর কী কী কারণ আছে?
নাজমুল: আরেকটা বড় কারণ, হাথুরুসিংহে আমাদের সম্পর্কে জানে। আমাদের ছেলেদের চেনে। বিদেশি কোচ এলে বেশ কিছুদিন ‘এটা এমন কেন’, ‘ওটা এমন কেন’—এসব প্রশ্ন শুনতে হয়। হাথুরুর ক্ষেত্রে সেই সমস্যা নেই। ও আমাদের সম্পর্কে সব জানে। নতুন দু–একজন ছাড়া বাকি সব প্লেয়ারকেও খুব ভালোভাবে চেনে। ওর প্রথমবারে যে দুজন প্লেয়ারকে সবচেয়ে বেশি সুযোগ দিয়েছিল, তারা হলো লিটন ও সৌম্য। এর মধ্যে লিটন তো এখন দলে প্রতিষ্ঠিতই। সৌম্য অবশ্য কোথাও নেই। এর বাইরে ও হয়তো নতুন পাবে শান্ত (নাজমুল হোসেন), তৌহিদ হৃদয় আর জাকিরকে। বাকি সবাই তো ওর সময়েরই।
শুভ্র: আর কিছু?
নাজমুল: হ্যাঁ, প্লেয়ারদের সঙ্গেও কথা বলেছি। বিশেষ করে সিনিয়র প্লেয়ার। এখন তো লিটন–মিরাজরাও সিনিয়র হয়ে গেছে। আমি কয়েকজন কোচের একটা লিস্ট করেও ওদের দেখিয়েছি। প্রায় সবাই হাথুরুসিংহের কথাই বলেছে। দু–একজন অবশ্য বলেছে, ‘আপনি যা ভালো মনে করেন’। মাঝখানে আমাদের অবস্থা যখন বেশ খারাপ ছিল, তখন মাশরাফিও একদিন বলেছিল, ‘হাথুরুকে নিয়ে আসেন’, যা শুনে আমি একটু অবাকই হয়েছিলাম। আমি তো মনে করেছিলাম, হাথুরুর সঙ্গে ওর মনোমালিন্য আছে। তামিমও বলেছে, ‘হাথুরুসিংহেকে নিয়ে আসেন।’
এবার আমাকে ও পাবেই না। আমি কাজ ভাগ করে দিয়েছি। যার বিভাগের কাজ, সে দেখবে। কোনো সমস্যা হলে শুধু আমাকে জানাবে। আমি আর আগের মতো সব ব্যাপারে থাকতে চাই না।নাজমুল হাসান, বিসিবি সভাপতি
শুভ্র: কোচ হাথুরুসিংহের কোনো বিশেষ দিক, যা আপনার পছন্দ?
নাজমুল: ও প্রতিপক্ষের দুর্বলতাগুলো খুব ভালো বের করতে পারে। প্ল্যানিংও খুব ভালো। কে কত নম্বরে ব্যাটিং করবে, কে কখন বোলিং করবে, ফিল্ড প্লেসিং কী হবে—সব ঠিক করে দেয়। ওর আগে অন্য কোনো কোচ এমন করেছে বলে মনে হয় না। তবে আমাদের এখনকার ক্যাপ্টেনরা অনেক ম্যাচিউরড, এখন হয়তো আর অমন হবে না। ওরা নিশ্চয়ই নিজেদের যুক্তি দেবে, তর্ক করবে।
শুভ্র: আচ্ছা, একটা কথা জানতে ইচ্ছা করছে। চুক্তির মেয়াদ বাকি থাকতেই হাথুরুসিংহে যেভাবে চলে গিয়েছিলেন, শুনেছি আপনার ফোনও ধরেননি, মেসেজের উত্তর দেননি। আবার ফিরিয়ে আনার কথাবার্তার সময় আপনি জিজ্ঞেস করেননি, এভাবে চলে গিয়েছিলেন কেন?
নাজমুল: না, করিনি। তবে ও চলে যাওয়ার পর ওর সঙ্গে আমার আর কোনো যোগাযোগ ছিল না। আমি একটা ‘হ্যালো’–ও বলিনি। বাংলাদেশের যাঁরা কোচ ছিলেন, তাঁদের সঙ্গে কিন্তু আমার যোগাযোগ আছে। এই তো একটু আগে রাসেল (ডমিঙ্গো) মেসেজ পাঠানোর পর ফোনে ওর সঙ্গে কথা বললাম। তবে হাথুরু চলে যাওয়ার আগেই আমি অনুমান করেছিলাম, যেকোনো সময় ও চলে যেতে পারে। টিমেও কিছু ঘটনা ছিল।
শুভ্র: এবার কি হাথুরুসিংহে নির্বাচক কমিটিতে থাকবেন?
নাজমুল: না। নির্বাচকেরা ১৫–১৬ জনের টিম দেবে, প্লেয়িং ইলেভেন ক্যাপ্টেন ঠিক করবে। হাথু থাকতে এটা হাথুই ঠিক করত। ও চলে যাওয়ার পর এটা ক্যাপ্টেনরাই করে। রাসেল ডমিঙ্গো যখন ছিল, বা শ্রীরাম, একাদশ তো সাকিবই ঠিক করেছে। তামিমও যদি বলে, এটা আমার টিম, এরপর কি তা চেঞ্জ করা যাবে? বললাম না, আমাদের ক্যাপ্টেনরা এখন অনেক ম্যাচিউরড।
আগেরবার হাথু থাকার সময় যেটা হতো, ও আমাকে একটা টিম পাঠাত, সিলেক্টররাও টিম দিত। তা নিয়ে আমি কথা বলতাম। হ্যাঁ, দুবার আমি একাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।নাজমুল হাসান, বিসিবি সভাপতি
শুভ্র: ম্যাচের একাদশ তো টিম ম্যানেজমেন্ট মানে কোচ–অধিনায়ক মিলেই ঠিক করার কথা। প্রশ্নটা এর আগের অংশ নিয়ে। তিন নির্বাচকের সঙ্গে ক্রিকেট পরিচালনা কমিটির চেয়ারম্যান, খালেদ মাহমুদ ও আরও কাকে কাকে যোগ করায় নির্বাচনী প্রক্রিয়াটা তো একটা জগাখিচুড়ি হয়ে আছে। এটা কি এমনই থাকবে?
নাজমুল: কোনোভাবেই না। তিন নির্বাচকই টিম করবেন। এর আগে তাঁরা নিশ্চয়ই কোচ–ক্যাপ্টেনের সঙ্গে কথা বলবেন। এই যে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে দুই ওয়ানডের জন্য দল দেওয়া হলো, তাতে তো নাসুমের থাকার কথা। নাসুম নাই দেখে আমি জিজ্ঞেস করলাম, নাসুম নাই কেন? আমাকে বলা হলো, ক্যাপ্টেন তাইজুলকে চেয়েছে। ঠিক আছে, চাইতেই পারে।
শুভ্র: আমি আবার একটু কনফার্ম করি, আপনি বলছেন, সারা বিশ্বে যেমন হয়, বাংলাদেশেও আগে যেমন হতো, নির্বাচক কমিটির তিনজনই এখন দল নির্বাচন করবে। ক্রিকেট অপারেশনসের চেয়ারম্যান বা টিম ডিরেক্টরের দল নির্বাচনে কোনো ভূমিকা থাকবে না। ঠিক বুঝেছি তো?
নাজমুল: হানড্রেড পারসেন্ট।
আরেকটা কেস মোস্তাফিজ। হাথু নাকি ওর ১১টা বল দেখেছিল, দেখেই বলল, ‘ওকে দলে চাই’। তখন ফারুক চিফ সিলেক্টর। ও বলল, ‘আমি দেব না, প্রশ্নই ওঠে না।’নাজমুল হাসান, বিসিবি সভাপতি
শুভ্র: তাহলে তো ভালো। তবে এমন অভিযোগও তো আছে, দল নির্বাচনে আপনি সরাসরি হস্তক্ষেপ করেন। এ ব্যাপারে কী বলবেন?
নাজমুল: অনেস্টলি বলি, আগে করতাম। এবার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে আর করি না। দু–একবার সরাসরি হস্তক্ষেপ করেছি, যা করা ঠিক হয়নি। আগেরবার হাথু থাকার সময় যেটা হতো, ও আমাকে একটা টিম পাঠাত, সিলেক্টররাও টিম দিত। তা নিয়ে আমি কথা বলতাম। হ্যাঁ, দুবার আমি একাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ২০১৮ সালের এশিয়া কাপে নির্বাচক বা আর কারও সঙ্গে কথা না বলেই আমি বলে দিয়েছি, ইমরুল আর সৌম্যকে পাঠাও (বদলি হিসেবে গিয়েছিলেন দুজন)। আরেকটা কেস মোস্তাফিজ। হাথু নাকি ওর ১১টা বল দেখেছিল, দেখেই বলল, ‘ওকে দলে চাই’। তখন ফারুক চিফ সিলেক্টর। ও বলল, ‘আমি দেব না, প্রশ্নই ওঠে না।’ আমি তো তখন মোস্তাফিজকে চিনিই না। তারপরও হাথুর দাবি মেনে মোস্তাফিজকে দলে নিতে বলেছিলাম।
শুভ্র: নিয়ম অনুযায়ী জাতীয় দলের কোচ থাকবেন ক্রিকেট পরিচালনা কমিটির অধীনে। কিন্তু আগেরবার হাথুরুসিংহে এই নিয়মকে থোড়াই কেয়ার করেছেন, নির্বাচকদেরও খুব একটা পাত্তা দিতেন না। তাঁর এই ক্ষমতার উৎস ছিল আপনার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ। এবারও কি এমনই হবে?
নাজমুল: এবার আমাকে ও পাবেই না। আমি কাজ ভাগ করে দিয়েছি। যার বিভাগের কাজ, সে দেখবে। কোনো সমস্যা হলে শুধু আমাকে জানাবে। আমি আর আগের মতো সব ব্যাপারে থাকতে চাই না। এবার বিপিএলে দেখলেন না, শুধু ফাইনাল ম্যাচে আমি মাঠে গিয়েছি। হাথু এবার আমাকে পাবেই না।