বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের নতুন কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে
বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের নতুন কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে

উৎপল শুভ্রর লেখা

কোন হাথুরুসিংহে ফিরছেন এবার

রাজনীতিতে নাকি শেষ কথা বলে কিছু নেই। এখন তো দেখা যাচ্ছে, কথাটা ক্রিকেটের ক্ষেত্রেও সত্যি। নইলে কে ভেবেছিলেন, চন্ডিকা হাথুরুসিংহে আবার বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের কোচ হবেন! আপনার কুঁচকে যাওয়া ভুরু দিব্যচক্ষে দেখতে পাচ্ছি। বেশ কিছুদিন ধরেই যেখানে চন্ডিকা হাথুরুসিংহের ফিরে আসার খবর বাতাসে উড়ছিল, শেষ পর্যন্ত সেটিই নিশ্চিত হওয়ার পর তাহলে অবাক হওয়ার কী আছে?

এখন হয়তো নেই। কিন্তু চন্ডিকা হাথুরুসিংহে যেভাবে বাংলাদেশকে আক্ষরিক অর্থেই পরিত্যাগ করে চলে গিয়েছিলেন, তাতে তাঁর ফিরে আসাকে বলতে হবে ক্রিকেট ইতিহাসের চমকপ্রদ গল্পগুলোর একটি। মনে আছে তো, ২০১৭ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে গিয়ে সেখান থেকেই যে তিনি পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দিয়েছিলেন! বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) সঙ্গে চুক্তির তোয়াক্কাও করেননি।

বিসিবির যাতে ক্ষুব্ধ হওয়াটাই ছিল স্বাভাবিক। মজাটা হলো, সেই সময়ে বিসিবির সভাপতি নাজমুল হাসান এখনো সেই পদে বহাল। বোঝাই যাচ্ছে, হাথুরুসিংহের সেই অপেশাদার আচরণ তিনি মনে রাখেননি।

বরং মনে রেখেছেন, হাথুরুসিংহের সময়ে বাংলাদেশের ক্রিকেটের সাফল্যগুলো। তা হাথুরুসিংহের প্রথম মেয়াদে স্মরণীয় বেশ কিছু সাফল্যই পেয়েছিল বাংলাদেশের ক্রিকেট। ২০১৫ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল, এর পরপরই পাকিস্তান, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টানা তিনটি ওয়ানডে সিরিজ জয়, ২০১৭ সালের চ্যাম্পিয়নস ট্রফির সেমিফাইনাল খেলা—ওয়ানডে দল হিসেবে বাংলাদেশের সমীহযোগ্য শক্তি হয়ে ওঠা সেই সময়েই।

টেস্টেও বলার মতো সাফল্য ছিল। মিরপুরে ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়াকে হারানোর পর কলম্বোতে বাংলাদেশের শততম টেস্টে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে জয়। গত বছরের শুরুতে মাউন্ট মঙ্গানুইয়ে নিউজিল্যান্ড জয়ের আগপর্যন্ত যা টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের সেরা তিন সাফল্য হয়ে ছিল। এসবের বিচারে হাথুরুসিংহের প্রথম মেয়াদকে তাই সফলই বলতে হয়।

হাথুরুসিংহের প্রথম মেয়াদে মাশরাফির অধিনায়কত্বে দারুণ কিছু সাফল্য পেয়েছে বাংলাদেশ

তবে এটাও সত্যি যে বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা দলটাকেই পেয়েছিলেন হাথুরুসিংহে। মাশরাফি, সাকিব, তামিম, মুশফিক, মাহমুদউল্লাহদের তখন সেরা সময়। চারপাশ সচকিত করে আবির্ভাব হয়েছে মোস্তাফিজুর রহমানের। আবার অন্যভাবে দেখলে সবার সেরাটা বের করে এনে দলটা গড়ে তোলার কৃতিত্ব কি কোচ কিছুটা হলেও পান না! বিশেষ করে ২০১৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে হাথুরুসিংহের দায়িত্ব নেওয়ার সময়টা মনে রাখলে। বাংলাদেশ দল তখন ঘোর দুঃসময়ে। পরাজয়ের মিছিলে জয় কী জিনিস, সেটিই ভুলে যাওয়ার দশা।

সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়ানোয় অবশ্যই বড় ভূমিকা ছিল হাথুরুসিংহের। তবে সঙ্গে এটাও বলা জরুরি, সাফল্যের জন্য শর্টকাট রাস্তা বেছে নিয়ে বাংলাদেশের ক্রিকেটের কিছু ক্ষতিও তিনি করে গিয়েছিলেন। ভয়াবহ টার্নিং উইকেট বানিয়ে ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে জয় অনুমিতভাবেই টেস্ট ক্রিকেটে দীর্ঘমেয়াদি কোনো ফল দেয়নি। এর চেয়েও বড় ‘ক্ষতি’ যেটা করেছিলেন, তা হলো ক্রিকেটের প্রথাগত সব নিয়মকানুন ভেঙে দেওয়া। জাতীয় দলের দেখভালের দায়িত্বে থাকা ক্রিকেট পরিচালনা কমিটি একরকম অকেজোই হয়ে গিয়েছিল তাঁর সময়ে। নির্বাচকদের স্বাধীনতা খর্ব হওয়ার শুরুও তখন থেকেই। যেটির জের এখনো বয়ে চলেছে বাংলাদেশের ক্রিকেট।

বাংলাদেশের কোচ হিসেবে প্রথম মেয়াদে বিতর্কেও জড়িয়েছেন হাথুরুসিংহে

প্রথম মেয়াদের হাথুরুসিংহে এমনই স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠেছিলেন যে কখনো কখনো মনে হতো, বাংলাদেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে ক্ষমতাবান মানুষ বোধ হয় এই শ্রীলঙ্কানই। দোষটা অবশ্য যতটা না তাঁর, তার চেয়ে বেশি বিসিবির। বিসিবিই তো তাঁকে এমন হয়ে ওঠার সুযোগ করে দিয়েছিল। এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কারণেই হাথুরুসিংহে নিজের দেশ শ্রীলঙ্কার কোচ হিসেবে খুব বেশি দিন টিকতে পারেননি। ওভাবে বাংলাদেশকে ছেড়ে যাওয়ার পরও আবার ফিরতে পেরে দ্বিতীয় মেয়াদের হাথুরুসিংহে আরও স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠেন কি না, এই শঙ্কা তাই থাকছেই।

হাথুরুসিংহের রাশ টেনে ধরাটা যদি বিসিবির চ্যালেঞ্জ হয়, হাথুরুসিংহের নিজেরও চ্যালেঞ্জ আছে। দু–একটা ব্যতিক্রম বাদ দিলে ক্রিকেটে দ্বিতীয় ইনিংস সব সময়ই কঠিনতর হয়। তার ওপর বাংলাদেশ ক্রিকেট যেখানে যাচ্ছে একটা পালাবদলের মধ্য দিয়ে। মাশরাফি নেই। পঞ্চপাণ্ডবের বাকি চারজনেরও এখন ক্যারিয়ারের গোধূলিবেলা। হাথুরুসিংহে ফিরে আসায় তাঁরা যে খুব খুশি হয়েছেন, এমন মনে না করার যথেষ্টই কারণ আছে। হাথুরুসিংহের চ্যালেঞ্জটা যাতে আরও বড় হয়ে যাচ্ছে।

পারবেন হাথুরুসিংহে?