শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে কাল প্রচণ্ড গরমের মধ্যে অনুশীলন করেছেন জাতীয় দলের ক্রিকেটাররা। দৌড়াচ্ছেন মেহেদী হাসান মিরাজ ও মুশফিকুর রহিম
শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে কাল প্রচণ্ড গরমের মধ্যে অনুশীলন করেছেন জাতীয় দলের ক্রিকেটাররা। দৌড়াচ্ছেন মেহেদী হাসান মিরাজ ও মুশফিকুর রহিম

অস্থির গরমে তামিম-মুশফিকদের সুস্থির ক্রিকেটের লড়াই

দেখে ভুল বোঝাটাই ছিল স্বাভাবিক। যেন কোনো অ্যাথলেটই দৌড়াচ্ছেন। খালি গায়ে বুক চিতিয়ে দৌড়, শরীরী ভাষায় ১০০ মিটার স্প্রিন্টের ভাব। আসলে অত গতিতে নয়, তবে বেশ জোরেই দৌড়াচ্ছিলেন ক্রিকেটার নাজমুল হাসান।

একটু পর চোখ পড়ল মোস্তাফিজুর রহমানের ওপর। দৌড়াতে দৌড়াতে হঠাৎ গতি বাড়িয়ে দিলেন। যেন ‘ফিনিশ লাইন’টা তখনই চোখে পড়ল। আর একটু দৌড়ালেই সোনার পদক!

দুটো দৃশ্যই কাল বিকেলে মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের। এর আগে দুপুরে যখন অনুশীলন শুরু হলো, তখনো দৌড়ের ওপরই ছিলেন ক্রিকেটাররা। তামিম ইকবাল, তাইজুল ইসলাম, শরীফুল ইসলাম, ইবাদত হোসেন...সঙ্গে আরও অনেকে। দৌড় এক ড্রেসিংরুমের সামনে থেকে শুরু হয়ে শেষ হচ্ছে আরেক ড্রেসিংরুমের সামনে গিয়ে। একটু থেমে সেখান থেকে আবার এদিকে দৌড়। পরে জানা গেছে, ওই সময় তাঁরা দৌড়াচ্ছিলেন একেকজন ২০০০ মিটার করে। আর বিকেলের পর্বে দৌড় ছিল ১৫০০ মিটার এবং দুবারই বিরতিহীন দৌড়।

গরমের মধ্যে অনুশীলনের ফাঁকে পানি খেয়ে পিপাসা মেটালেন তাসকিন

তা ক্রিকেটারদের অনুশীলনে এত দৌড়াদৌড়ি কেন? অনুশীলনের আগে সাধারণত দৌড় বা ‘রানিং’ বলতে যেটাকে বোঝায়, সেটা মূলত গা গরমের জন্যই হয়। কিন্তু কাল সবাই যেভাবে এবং যত সময় নিয়ে টানা দৌড়ালেন, তাতে তো গা গরম হয়ে তা থেকে আগুনই বের হয়ে আসার কথা! সেই দৌড় মাথার ওপর থেকে ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস (ওই সময় তাই ছিল) তাপমাত্রা ছড়ানো গনগনে সূর্য রেখে।

চলমান দাবদাহের মধ্যে মিরপুরে বাংলাদেশ দলের যে অনুশীলন এখন চলছে, চামড়া পুড়িয়ে আর ঘেমেনেয়ে হলেও সেটা দেখা একটা বিশেষ অভিজ্ঞতাই বটে। আগুনে গরমের আঁচ থেকে বাঁচিয়ে খেলোয়াড়দের শরীর ঠিক রাখতে অনুশীলনের জন্য কোচ-ফিজিও-ট্রেনাররা যে নানা কৌশল অবলম্বন করছেন, দূরত্ব মেপে দিয়ে এই টানা দৌড় সেসবেরই একটা।

বেলা দুইটায় শুরু হয়ে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত চলা গতকালের অনুশীলনটাকে কোনোভাবেই স্বাভাবিক বলার উপায় নেই। স্বাভাবিক সময়ের অনুশীলন মানে হলো খেলোয়াড়েরা মাঠে এসে স্ট্রেচিং-ওয়ার্মআপ করবেন। এরপর হালকা দৌড়াদৌড়ি শেষে ভাগে ভাগে ব্যাটিং, বোলিং, ফিল্ডিং অনুশীলন।

কিন্তু কাল দেখা গেল অন্য সবকিছুর চেয়ে ক্রিকেটাররা দৌড়াচ্ছেনই বেশি। প্রচণ্ড রোদের মধ্যে এই দৌড়াদৌড়ি মনে করিয়ে দিল পুরোনো দিনের অনুশীলনের কথা, যখন অনুশীলনের আগে পুরো মাঠ ঘুরে খেলোয়াড়েরা বৃত্তাকারে দু-তিন চক্কর দিতেন। ইদানীং সেটা বলতে গেলে দেখাই যায় না।

বাংলাদেশ দলের কোচিং স্টাফের এক সদস্যের সঙ্গে কথা বলে যা বোঝা গেল, তাতে গরমের মধ্যে লম্বা সময় ধরে দৌড়ানোর মূল উদ্দেশ্য খেলোয়াড়দের শরীরের সহনশীলতা (অ্যান্ডুরেন্স) এবং অক্সিজেন নেওয়ার ক্ষমতা বাড়ানো। অনেক পানি-ড্রিংকস ইত্যাদি পান করেও এই গরমে শরীরে পানিশূন্যতা সৃষ্টি হতে পারে। আর রক্তে পানি কমে যাওয়া মানে মস্তিষ্কে অক্সিজেন প্রবাহ কমে আসা। তখনই ক্লান্তি-অবসন্নতা আসে, হাঁপিয়ে যেতে হয়; পরিণতিতে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।

শরীরের সহনশীলতা বাড়াতে দৌড়েছেন ক্রিকেটাররা

আফগানিস্তানের বিপক্ষে মিরপুরে ১৪ জুন শুরু টেস্ট ম্যাচটা যেহেতু এ রকম গরমের মধ্যেই হওয়ার সম্ভাবনা, স্কিল ট্রেনিংয়ের পাশাপাশি মাঠে অক্লান্তভাবে চার থেকে পাঁচ দিন কাটানোর শারীরিক সক্ষমতা বাড়ানোটাকেও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে টিম ম্যানেজমেন্টের কাছে।

স্কিল ট্রেনিং, মানে ব্যাটিং-বোলিং অনুশীলনও হয়েছে কাল। তবে স্বাভাবিক সময়ের সঙ্গে ভিন্নতা সেখানেও। যেটা আগেই বলা হলো, স্বাভাবিক সময়ে ওয়ার্মআপ করেই ব্যাটিং-বোলিং অনুশীলন শুরু হয়ে যায়। যেদিন জিম সেশন থাকে, সেদিন শুধু সেটাই। খুব জরুরি হলে কেউ কেউ হয়তো অনুশীলনের পরে জিমে যান। কিন্তু কাল দেখা গেল, যে যাঁর ১৫০০ বা ২০০০ মিটার দৌড় শেষ করে জিমে চলে যাচ্ছেন। জিম সেশনে শরীরের ওপর আরও খানিক চাপ নিয়ে তারপর যাচ্ছেন নেটে।

দিনের পুরো অনুশীলনকে একটা সরলরেখায় ফেলা হলে ব্যাপারটা দাঁড়ায় এ রকম—দীর্ঘ সময় ধরে গরমের মধ্যে দৌড়ানো, জিমে বাড়তি পরিশ্রম; এভাবে শরীরটাকে পুরোপুরি নিংড়ে ফেলার পর দেখে নেওয়া শরীর কতটা টিকে থাকার শক্তি রাখে, ব্যাটিং-বোলিংয়ে কতটা মনোযোগ ধরে রাখা যায়। এ রকম পরিশ্রমের চাপ নিয়েও যদি নেট অনুশীলনে সেরাটা দেওয়া যায়, অবধারিতভাবেই সেই অভ্যস্ততা কাজে দেবে ম্যাচে।

অতিমারি করোনাভাইরাস ক্রিকেটকে অনেকটাই বদলে দিয়েছিল। করোনাকালের পর সে পরিস্থিতি আগের মতো হয়ে গেছে প্রায়। কিন্তু বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন যে ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দিচ্ছে, সারা দিনের খেলা ক্রিকেটে সেটা স্থায়ী প্রভাব ফেললে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। গরমকে হারাতে বাংলাদেশ দলের কৌশল বদলানো অনুশীলন ভবিষ্যতে সেটারই ‘প্রোমো’ হয়ে উঠবে কি না কে জানে!

অনুশীলনের ফাঁকে মুখে ঠান্ডা পানি ছিটিয়ে নিলেন নাজমুল

গত এপ্রিলে টানা ১৮ থেকে ২০ দিন তীব্র দাবদাহে পুড়েছে দেশ। এ সময় ৫৮ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা সহ্য করেছে বাংলাদেশ। এখনো অনেকটা সে রকমই পরিস্থিতি। বৈশ্বিকভাবেই জলবায়ুর যে পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে, তাতে ভবিষ্যতে ক্রিকেট খেলাটা আরও বেশি চ্যালেঞ্জিং হয়ে ওঠার শঙ্কা থাকছেই।

ক্রিকেট আর বাংলাদেশের কৃষির মধ্যে একটা বড় মিল—দুটোই আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। তবে ক্রিকেটের সঙ্গে আবহাওয়ার রেষারেষি মূলত বৃষ্টির কারণে। বৃষ্টিবিঘ্নিত ম্যাচের জন্য ক্রিকেটের নীতিনির্ধারকদের বৃষ্টি আইনও করতে হয়েছে। কিন্তু পরিস্থিতি যা, তাতে ক্রিকেট বনাম আবহাওয়ার খেলাটায় আগামী দিনে আবহাওয়ার হয়ে প্রতিনিধিত্ব করতে পারে অতি উষ্ণতাও। ওয়ানডে, টি-টোয়েন্টি না হয় সন্ধ্যায় বা রাতে ফ্লাড লাইট জ্বালিয়ে খেলা যাবে, টেস্ট ম্যাচও কি তখন দিবারাত্রিরই হবে!

এখনই সেই চিন্তা করা হয়তো একটু বাড়াবাড়ি। তবে বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়াটাও যে খেলাটার জন্য বড় এক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেটা বাংলাদেশ দলের অনুশীলনেই ফুটে উঠছে। যে অস্থির গরমে মানুষ এসি রুম অথবা নিদেনপক্ষে ছায়া খুঁজে নেন, সেই গরমে সারা দিনের জন্য খেলতে নামাটা তো অনেকটা যুদ্ধে নামার মতোই। বিপদ আছে সামনে, তবু লড়াই করে যেতে হবে।

গরমের মধ্যেই নেটে অনুশীলন করেন তামিম

কাল শেষবেলায় সেই লড়াইয়েরই একটা খণ্ডাংশ দেখা গেল মুশফিকুর রহিম আর তামিম ইকবালের ব্যাটিং অনুশীলনে। সারা দিনের তাপ শুষে নিয়ে বিকেলের দিকে শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের মাটি উষ্ণ ভাপে সেই তাপ আবার ফিরিয়ে দিচ্ছিল বায়ুমণ্ডলে। তার মধ্যেই ঘাম ঝরানো, গলা শুকানো দৌড়ের ধকল কাটিয়ে মূল মাঠে চলছিল মুশফিক আর ইনডোরের বাইরের নেটে তামিমের উইকেটে পড়ে থাকার সুস্থির অনুশীলন।

দেখে মনে হচ্ছিল, বৈশ্বিক উষ্ণতার বিরুদ্ধে একটা চরমতম লড়াই-ই যেন ঘোষণা করে দিয়েছেন ক্রিকেটাররা!