ঋষভ পন্তকে সাক্ষী রেখেই সেঞ্চুরি তুলে নেন মুমিনুল
ঋষভ পন্তকে সাক্ষী রেখেই সেঞ্চুরি তুলে নেন মুমিনুল

মুমিনুলকে ‘এইচবিডব্লু’ করা হলো না পন্তের

কানপুর টেস্টের প্রথম দিন। দ্বিতীয় সেশনে ৩৩তম ওভারের প্রথম বল। মুমিনুল হক সুইপ করতে গিয়ে ব্যাটে ঠিকমতো পাননি। ঋষভ পন্ত এলবিডব্লুর আবেদন করেছিলেন। রবিচন্দ্রন অশ্বিন শুধরে দেন পন্তের ভুল। বল ব্যাটে লেগেছিল। কিন্তু পন্ত দমে যাওয়ার পাত্র নন। রসিকতাপ্রিয় পন্তকে যেন হুট করে অস্ট্রেলিয়ান মেজাজ পেয়ে বসল!

তা কেন-ই-বা হবে না, বয়স ২৫ পার হওয়ার আগেই অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে অস্ট্রেলিয়ারই হার না মানা মানসিকতাকে বশ মানিয়ে এসেছেন। আর এ তো বাংলাদেশ; যারা প্রথম টেস্টেই হেরে বসেছে ২৮০ রানে, আর তখন ৯৩ রানে ৩ উইকেট হারিয়ে চাপেও, মুমিনুল নিজেও খুব একটা সুবিধা করতে পারছিলেন না। খোঁচা মারার এটাই তো মোক্ষম সময়!

আর ট্রাভিস হেডও কিছুদিন আগে বলেছেন, ভারতের ক্রিকেটারদের মধ্যে পন্তকেই তাঁর ‘সবচেয়ে বেশি অস্ট্রেলিয়ান’ মনে হয়। পন্তও কথার তির ছুড়লেন উপমহাদেশীয় রসিকতার মোড়কে অস্ট্রেলিয়ান মানসিকতায়। বললেন অশ্বিনকে, কিন্তু গাইডেড মিসাইলের মতো ‘ব্যানানা সুইং’ করে তা বিঁধল মুমিনুলে, ‘আমরা তার হেলমেট (বল লাগিয়ে) থেকে এলবিডব্লু নিতে পারি, ভাই।’

টেন্ডুলকারের উচ্চতা মুমিনুলের চেয়ে ৩ ইঞ্চি বেশি। সুতরাং মুমিনুল সুইপ কিংবা ‘ডাক’ করতে গিয়ে বল তাঁর মাথায় (হেলমেট) লাগলে সেটা তো স্টাম্পের ভেতরেই থাকবে!

মুমিনুলের ৫ ফুট ২ ইঞ্চি উচ্চতা যে পন্তের লক্ষ্যবস্তু, তা পরিষ্কার। সুইপ করতে যেহেতু সমস্যা হচ্ছিল, তাই আবারও সুইপ খেলার সময় যদি বল মাথায় লাগে, তখন এলবিডব্লুটা নেওয়া যাবে—রসিকতার মোড়কে এটাও লক্ষ্য। আবদার নয়, আসলেই। কারণ, ইতিহাসে একদম এভাবে না হলেও তার কাছাকাছি পর্যায়ে গিয়ে আউট হওয়ার নজির আছে।

আজ সেঞ্চুরির পর মুমিনুলের পিঠ চাপড়ে দেন কোহলি

পন্তের জন্মের দুই বছর পর ১৯৯৯ সালে অ্যাডিলেড টেস্টে গ্লেন ম্যাকগ্রার বলে ভারতের দ্বিতীয় ইনিংসে টেন্ডুলকারের সেই মহাবিতর্কিত আউট। বাউন্সার ভেবে ‘ডাক’ করেছিলেন, কিন্তু বল সেভাবে না ওঠায় আঘাত করে তাঁর বাঁ কাঁধে, আম্পায়ার ড্যারিল হার্পার আউট দেন। স্কোরবোর্ডে লেখা হয় ‘এলবিডব্লু’, তবে ক্রিকেটারদের কাছে পরে সেই আউট খ্যাতি পেয়েছে ‘এসবিডব্লু’ মানে ‘শোল্ডার বিফোর উইকেট’!

টেন্ডুলকারের উচ্চতা মুমিনুলের চেয়ে ৩ ইঞ্চি বেশি। সুতরাং মুমিনুল সুইপ কিংবা ‘ডাক’ করতে গিয়ে বল তাঁর মাথায় (হেলমেট) লাগলে সেটা তো স্টাম্পের ভেতরেই থাকবে!

অতএব, মুমিনুলের মাথায় (হেলমেটে) লাগিয়েও এলবিডব্লু নেওয়া সম্ভব।

পন্তের সেই কথার পর প্রথম দিনে খেলা হয়েছে মাত্র ২টি ওভার। ৪০ রানে অপরাজিত থেকে প্রথম দিন শেষ করেন মুমিনুল। বৃষ্টির কারণে সেদিন দেড় সেশনের বেশি সময় খেলা হয়নি। পরের দুটি দিনও ধুয়ে গেছে বৃষ্টিতে। আজ চতুর্থ দিনে এসে মুমিনুল শুরু করলেন সেই ৪০ থেকে। ৩ উইকেটে ১০৭ রানে চতুর্থ দিন শুরু করা বাংলাদেশ প্রথম ইনিংসে ২৩৩ রানে অলআউট হওয়ার পর দেখা গেল মুমিনুলকে ‘এইচবিডব্লু’ (হেড/হেলমেট বিফোর উইকেট) করতে পারেনি ভারত! মুমিনুল তখনও ‘এসবিডব্লু’ মানে ‘স্ট্যান্ডিং বিফোর উইকেট’-বীরদর্পে দাঁড়িয়ে ক্রিজে, অপরাজিত ১০৭ রানে।

মুমিনুলের সেঞ্চুরির পর গিল তাঁর সঙ্গে হাত মেলান

সেটাও পন্তকে কী সুন্দর হতাশ করার ঢঙে! আজ সকালের সেশনে বাংলাদেশ রান তুলেছে ৯৮, উইকেট পড়েছে ৩টি। কিন্তু মুমিনুল এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে অশ্বিন ও রবীন্দ্র জাদেজাকে সুইপ করতে এতটুকু ছাড় দেননি। পেসার আকাশ দীপ, মোহাম্মদ সিরাজ ও যশপ্রীত বুমরাও বল খাটো লেংথে করে তাঁর হেলমেটের টিকিটিও ছুঁতে পারেননি। পেছনের পায়ে দাঁড়িয়ে পুল-হুক খেলেছেন একের পর এক।

প্রথম সেশনে বাংলাদেশের তোলা ৯৮ রানের ৬২-ই মুমিনুলের। চাইলে আরেকটু মনে করিয়ে দেওয়া যায়, ৭৮ থেকে আশির ঘরে পৌঁছেছেন অশ্বিনকে সুইপে চার মেরে। সেঞ্চুরিও সেই একই বোলারের বিপক্ষে একই শটেই চার মেরে; সেই বোলার প্রথম দিনের ৩৩তম ওভারে যিনি বল করার সময় পন্ত ওই কথাটা বলেছিলেন। ভাগ্যের কী লীলা, তাই না!

কিন্তু ভাগ্য সাম্যবাদীও। ৯৩ রানে থাকতে মুমিনুল নিজে পন্তকে সুযোগ দিয়েছেন। ব্যাকফুটে স্টাম্পের কাছাকাছি বল কাট করতে গিয়ে ব্যাটের নিচে লাগিয়েছিলেন, পন্ত পেছন থেকে ক্যাচটি নিতে পারেননি। ৯৫ রানে স্লিপে ক্যাচ দিয়েছিলেন কোহলিকেও। দুটিই ‘হাফ চান্স’। কিন্তু প্রতিপক্ষের হেলমেটে বল লাগিয়ে এলবিডব্লু নেওয়ার আত্মবিশ্বাসূচক রসিকতা করতে পারে যে দল, তারা যদি ‘হাফ চান্স’ কাজে লাগাতে না পারে, তখন ভাগ্যও চলে আপন গতিতে। আর সেই গতি পথের শেষটায় তাঁর মানসিকতায় অস্ট্রেলিয়ান একটা সুবাসও মেলে।

ঘরের বাইরে মনে রাখার মতো এক সেঞ্চুরিই করলেন মুমিনুল

প্রতিপক্ষের খোঁচা, বাউন্সার, স্পিন—এসব সামলে ইটের বদলে পাটকেল (পড়ুন সুইপ) বেশি বেশি মাথা তুলে দাঁড়ায় তো অস্ট্রেলিয়ানরাই! মুমিনুল তাই যতক্ষণ উইকেটে ছিলেন, অস্ট্রেলিয়ানসুলভ মানসিকতা পন্তের নয়, তাঁর মধ্যে ছিল। আর পন্ত তখন তারুণ্যের আবেগে মজা করতে গিয়ে ফেঁসে যাওয়া চুপচাপ ভদ্রলোক, অর্থাৎ ‘ভিবিডব্লু’-‘ভদ্রলোক বিহাইন্ড উইকেট।’

মুমিনুলের বিবেক কাজ করেছে বলেই সম্ভবত তাঁকে মুখে আর কিছু বলতে হয়নি। কারণ, গোটা ইনিংসেই তো মুমিনুলের ‘বিবিডব্লু’—‘ব্যাট বিফোর উইকেট’! অর্থাৎ ব্যাটই কথা বলেছে।