বাংলাদেশ ভারতকে হারালে নিশ্চিতভাবেই খুব খুশি হবেন হাথুরুসিংহে। তবে তাঁর প্রথম চাওয়া, নতুন করে যেন কেউ চোটে না পড়ে।
যতই হোটেলবাস হোক, দেশটা তো তাঁর নিজের। এই কারও সঙ্গে দেখা করতে রুম থেকে বেরিয়ে নিচে নেমে আসছেন, ওই কাউকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছেন। কেউ বন্ধু, কেউবা আত্মীয়। কলম্বোয় বাংলাদেশ দলের হোটেলে গেলে তাই ঘুরেফিরেই দেখা হয়ে যাচ্ছে কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহের সঙ্গে।
বাংলাদেশ থেকে আসা সাংবাদিকেরাও চাইলেই কোচকে হাতের কাছে পাচ্ছেন। সহজে গল্পটল্পও করা যাচ্ছে। কাল যেমন হোটেলের পাশের ক্রিসকেট শপিং মলে দেখা হতেই সংক্ষিপ্ত একটা আড্ডা জমে গেল। ভারতের বিপক্ষে ম্যাচের আগের দিন বাংলাদেশ দলের প্রধান কোচের সঙ্গে বাংলাদেশের সাংবাদিকের আড্ডার বিষয় কী হতে পারে, সেটা নিশ্চয়ই না বললেও চলবে।
আমাদের এখন বৃহত্তর ছবিটা দেখতে হবে। পাকিস্তান এবং এখানে অনেকগুলো চোটের ঘটনা ঘটেছে।চন্ডিকা হাথুরুসিংহে প্রধান কোচ, বাংলাদেশ
তো সেই আড্ডা থেকে প্রেমাদাসা স্টেডিয়ামের আজকের ম্যাচ নিয়ে হাথুরুসিংহের যে মনোভাব বোঝা গেল, তাতে একটা বিষয় পরিষ্কার—তিনি এখন এই ম্যাচ ভালোয় ভালোয় শেষ হলেই বাঁচেন। বাংলাদেশ যদি ম্যাচটা জিতে দেশে ফিরতে পারে, তাহলে নিশ্চিতভাবেই খুশি হবেন।
তবে হারলেও খুব অখুশি হবেন না, যদি এই ম্যাচে নতুন কেউ চোট না পায়। মোটকথা ভারত–ম্যাচে কোচের একটাই চাওয়া—ম্যাচটা ক্রিকেটাররা শেষ করুক চোটমুক্ত থেকে। কালকের (আজ) ম্যাচ নিয়ে কী ভাবছেন প্রশ্নেও তাই তাঁর উত্তর, ‘দলের আর কোনো ক্রিকেটার যেন চোটে না পড়ে, এটাই একমাত্র কামনা।’ যেন ভারত নয়, ঘাপটি মেরে থাকা চোটের শঙ্কাই এই ম্যাচে বড় প্রতিপক্ষ বাংলাদেশের!
অধিনায়ক সাকিব আল হাসান যদিও বলেছেন, ভারতের বিপক্ষে ম্যাচেও চাওয়া–পাওয়ার আছে, আর সেটা হলো জয়; কোচের প্রত্যাশার সীমায় তা খুব বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে বলে মনে হয়নি। তিনি বরং এই ম্যাচ ছাপিয়ে ভবিষ্যতের বৃহত্তর ছবিটাই দেখতে চাচ্ছেন। বিশ্বকাপ সামনে বলেই সেই চাওয়ার পেছনেও কাজ করছে মূলত চোট–আতঙ্ক, ‘আমাদের এখন বৃহত্তর ছবিটা দেখতে হবে। পাকিস্তান এবং এখানে অনেকগুলো চোটের ঘটনা ঘটেছে। এটা দলের জন্য কতটা ক্ষতিকর হতে পারে, আমরা এরই মধ্যে সেটা দেখেছি।’
শুরুটা অবশ্য এশিয়া কাপেরও আগে থেকে। কোমরের চিকিৎসা করাতে তামিম ইকবাল আগেই সরে যান টুর্নামেন্ট থেকে। এশিয়া কাপের ঠিক আগে হাঁটুর চোটে পড়ে ইবাদত হোসেনও। ইংল্যান্ড থেকে অস্ত্রোপচার করিয়ে ফেরা পেসার খেলতে পারবেন না বিশ্বকাপেও।
জ্বরের কারণে লিটন দাস দলের সঙ্গে শুরুতে এশিয়া কাপে আসতে পারেননি। পরে যোগ দিলেও লাহোরে আফগানিস্তান ম্যাচের পর আসে আরেক ধাক্কা। হ্যামস্ট্রিংয়ের চোট দেশে পাঠিয়ে দেয় আফগানিস্তানের বিপক্ষে সেঞ্চুরি করা নাজমুল হোসেনকে। সর্বশেষ মুশফিকুর রহিমও কলম্বো থেকে ফিরে যান দেশে, তবে সেটা চোটে পড়ে নয়; পারিবারিক কারণে।
বিশ্বকাপ সামনে রেখে এশিয়া কাপে কিছু সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছিল বাংলাদেশের। ক্রিকেটারদের পারফরম্যান্স দেখার সঙ্গে প্রতিপক্ষ ও কন্ডিশন বুঝে ব্যাটিং অর্ডার আর সঠিক বোলিং লাইনআপ সম্পর্কে ধারণা পাওয়াও ছিল উদ্দেশ্য। কিন্তু শুরু থেকে বইতে শুরু করা চোটের ঝড় কিছুই মনমতো হতে দেয়নি। পরিস্থিতি এমন হয়ে যায় যে ‘প্ল্যান বি’ বাস্তবায়ন করাও কঠিন হয়ে যাচ্ছিল।
তবে এতে একটা লাভও হয়েছে দলের। বিশ্বকাপের আগেই অনেকের দুর্বলতা জানা হয়ে গেছে। যাঁদের অগ্রাধিকার দিয়ে ভারত বিশ্বকাপের ছক কষা হচ্ছিল, তাঁদের সামর্থ্য সম্পর্কেও একটা ধারণা হয়ে গেছে টিম ম্যানেজমেন্টের। আবার পরিস্থিতির কারণে মেহেদী হাসান মিরাজের ওপরে উঠে আসা ওপেনিং নিয়েও ভিন্ন চিন্তার খোরাক জোগাচ্ছে।
শ্রীলঙ্কা ম্যাচের পর সাকিব যেটাকে বলেছিলেন ‘রিয়েলিটি চেক’, এশিয়া কাপ থেকে কোচ হাথুরুসিংহের উপলব্ধিও বলতে পারেন একই রকম। ক্রিকেটের আড্ডার শেষাংশে তাঁর কথায় খেদ, ‘আমাদের দলে তো ওই গভীরতাই নেই। কেউ চোটে পড়লে কে কার বিকল্প হবে! ব্যাকআপ হিসেবে হয়তো আমার অনেক খেলোয়াড়ই আছে। কিন্তু নিয়মিত খেলোয়াড়দের সঙ্গে তাদের অনেক পার্থক্য।’
শেষ বাক্যটা বলার সময় পার্থক্যের সীমা বোঝাতে একটা হাত ওপরে রেখে আরেকটা হাত অনেক নিচে নামিয়ে ধরলেন কোচ। সর্বোচ্চ সীমা বোঝাতে ওপরের হাতটা যে জায়গায় রাখলেন; সামর্থ্যে, আত্মবিশ্বাসে এবং ভালো করার ক্ষুধায় অতটা উঁচু গ্রাফ বাংলাদেশ দলের খুব কম ক্রিকেটারেরই আছে।
আজ ভারত–ম্যাচে বাংলাদেশ জিতে গেলেও যে হাথুরুসিংহের দুই হাতের ব্যবধান খুব কমে আসবে, তা নয়। সেটা নিয়ে না ভেবে তাই তাঁর একটাই আশা—হারুক, জিতুক; দলটা অন্তত নিরাপদে খেলা শেষ করে আসুক। কোচের ওই হাত দুটোই যেন করজোড়ে প্রার্থনা করছে—আর নয় চোটের আঘাত।