সময় বদলেছে। মুরালিধরনের জীবনও পাল্টেছে। কিন্তু তাঁর মুখের হাসিটা আজও একইরকম অকৃত্রিম
সময় বদলেছে। মুরালিধরনের জীবনও পাল্টেছে। কিন্তু তাঁর মুখের হাসিটা আজও একইরকম অকৃত্রিম

মুরালিধরনকে ইন্টারভিউ করার ভয়ে পালিয়ে বেড়ানো ও যা বদলায়নি

ছোট গাছ যেমন একদিন মহিরুহতে পরিণত হয়, ক্রিকেটে মুত্তিয়া মুরালিধরনও তা-ই। বিতর্ক, ঝড়ঝাপটা পেছনে ফেলে টেস্ট ক্রিকেটে সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি! সেটাও ৮০০ উইকেটের ‘পর্বত’—সেটি গড়ার পথে ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে কেমন ছিলেন শ্রীলঙ্কান কিংবদন্তি? আজ তাঁর ৫১তম জন্মদিনে উৎপল শুভ্রর কলমে সেই মুরালির অজানা রূপ।

জানি, আজ এ কথা বললে কাউকে বিশ্বাস করানো কঠিন হবে, ইন্টারভিউ দিতে উন্মুখ মুত্তিয়া মুরালিধরনকে সুযোগের বদলে ঝামেলা বলে মনে হয়েছিল আমার। তবে টীকা হিসেবে যদি যোগ করে দিই, ১৯৯৪ সালের কথা বলছি, তাহলে বোধ হয় দাবিটা আর অবিশ্বাস্য থাকবে না। ১৯৯৪ সালে আমি কোন দুঃখে মুরালিধরনের ইন্টারভিউ নিতে যাব, বলুন?

সে বছর শ্রীলঙ্কায় গেছি সিঙ্গার ওয়ার্ল্ড সিরিজ কাভার করতে। এর আগে কলকাতায় সাংবাদিক হিসেবে ‘টেস্ট অভিষেক’ হয়েছে; তবে বড় কোনো আন্তর্জাতিক ক্রিকেট টুর্নামেন্টে সেটিই প্রথম। সে কি উৎসাহ! বৃষ্টিতে টুর্নামেন্ট বরবাদ, আমি খেয়ে না-খেয়ে সারা দিন টিমের হোটেলে পড়ে থাকি, আর যাকে পাই তারই ইন্টারভিউ নিই। ‘যাকে পাই’ লিখলাম বটে, কিন্তু সেটি চার জাতি টুর্নামেন্টের তিনটি দল—পাকিস্তান, ভারত ও অস্ট্রেলিয়ার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য; অন্য দল শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রে নয়। ওই তিন দলের বড় তারকাদের প্রায় সবারই ইন্টারভিউ নিয়ে ফেললাম। কিন্তু শ্রীলঙ্কানদের মধ্যে অর্জুনা রানাতুঙ্গা আর অরবিন্দ ডি সিলভা ছাড়া আর কারও ব্যাপারে বিন্দুমাত্র আগ্রহও বোধ করিনি। ওদের আর কেউ যে তখনো স্বনামে পরিচিতই নন।

ব্রায়ান লারার সঙ্গে মুরালিধরন। শ্রীলঙ্কান কিংবদন্তি তখন কিংবদন্তি হওয়ার পথে

মুরালিধরন তখনো মুরালিধরন হননি, জয়াসুরিয়া জয়াসুরিয়া নন, ভাসের ভাস হতেও অনেক দেরি। অবস্থাটা তখন এমন, ভিনদেশি সাংবাদিক—এমনকি তিনি যদি তখন ক্রিকেটে কূলগোত্রহীন বাংলাদেশের সাংবাদিকও হন—ইন্টারভিউ চাইলে শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটাররা উল্টো গদগদ হয়ে যান। মুরালিধরন তা হননি, কারণ আমি ভুল করেও তাঁর ইন্টারভিউ চাইনি। তিনি যে ওই টুর্নামেন্টের শ্রীলঙ্কা দলেই জায়গা পাননি!

এরপরও তাঁর ইন্টারভিউ নেওয়ার কথাটা কেন উঠল? এর পেছনে একটা গল্প আছে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাধ্যতামূলক প্রেস কনফারেন্সের রীতি তখনো চালু হয়নি। শ্রীলঙ্কার ম্যাচের পর বেশির ভাগ দিনই অধিনায়কের সঙ্গে কথা বলতে আগ্রহী আর কাউকে সঙ্গী পেতাম না। এটাও বোধ হয় এখন বিশ্বাস্য মনে হবে না যে অর্জুনা রানাতুঙ্গা তাঁর প্রতিক্রিয়া জানতে আগ্রহী একমাত্র সাংবাদিককে ড্রেসিংরুমেই ডেকে নিতেন। মাঝেমধ্যে সেখানে একটু অস্বস্তিতেও পড়তে হতো। ক্রিকেটাররা ড্রেসিংরুমে কাপড়চোপড়ের ব্যাপারে বড়ই উদাসীন। কেউ হয়তো শরীরের মধ্যভাগে তোয়ালে জড়ানোর কাজটা স্থগিত রেখেই বেরিয়ে পড়েছেন শাওয়ার থেকে। কারওবা পরনে হয়তো শুধু আন্ডারওয়্যার। এহেন শ্রীলঙ্কান ড্রেসিংরুমেই একদিন এক্সক্লুসিভ ইন্টারভিউয়ের জন্য সময় চাওয়ায় ‘আরে, যাওয়ার আগে আমার ইন্টারভিউ অবশ্যই পাবেন’ বলে রানাতুঙ্গা একটু দূরে বসা মুরালিধরনকে দেখিয়ে বললেন, ‘আপনি বরং এখন ওর ইন্টারভিউ করুন। দারুণ বোলার!’

টেস্ট ক্রিকেটে ৮০০ উইকেট নেওয়ার রেকর্ড গড়ার পর এই হাসি উপহার দিয়েছিলেন মুরালিধরন

মুরালিধরনের তখন ১৪ টেস্টে ৫৩ উইকেট, ১৪টি ওয়ানডেতে ১৩। বোলিংও তখন এমন কিছু নয় যে এ পরিসংখ্যানকে ‘গাধা’ ভেবে তাঁকে দারুণ বোলার হিসেবে মেনে নেব। রানাতুঙ্গার মুখের ওপর তো আর তা বলা যায় না। আমতা আমতা করে বললাম, ‘অবশ্যই, অবশ্যই, আমিও ওর ইন্টারভিউ করব বলে ভেবে রেখেছি।’ বললাম বটে, কিন্তু শ্রীলঙ্কায় পরের ১০ দিন রীতিমতো ভয়ে ভয়ে কাটল। কখন মুরালির সঙ্গে দেখা হয়ে যায়, আর তিনি তাঁর ইন্টারভিউ নেওয়ার প্রতিশ্রুতির কথা মনে করিয়ে দেন।

মুরালিধরন শ্রীলঙ্কা দলেই ছিলেন না বলেছি, তারপরও তিনি ড্রেসিংরুমে কীভাবে এলেন—এ প্রশ্নের উত্তরেও ‘তখন আর এখন’ তুলনাটা আসবে। বলতে গেলে শ্রীলঙ্কা দলের ড্রেসিংরুমের সঙ্গে পাড়ার ক্লাবের ড্রেসিংরুমের তেমন কোনো পার্থক্যই ছিল না তখন। খেলা শেষে দলের বাইরে থাকা খেলোয়াড়েরা আসছেন, আসছেন সাবেকরা, ভিনদেশি সাংবাদিককে আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা তো শুনেছেনই; সব মিলিয়ে শ্রীলঙ্কার ড্রেসিংরুমকে মাঝেমধ্যেই মনে হতো রীতিমতো মাছের বাজার! দলে না থেকেও মুরালি কেন ড্রেসিংরুমে—এ প্রশ্নটা তাই এখন লিখতে গিয়ে মনে জাগছে। তখন এটিকে একটুও অস্বাভাবিক বলে মনে হয়নি।

১৯৯৬ বিশ্বকাপ ট্রফি হাতে সতীর্থদের সঙ্গে মুরালিধরন

সেবার শ্রীলঙ্কায় প্রথমবার। এরপর তো অনেকবারই গেছি। মুরালির সঙ্গেও দেখা হয়েছে। দেখা হয়েছে শ্রীলঙ্কার বাইরেও। ২০০৭ সালে পঞ্চমবারের মতো শ্রীলঙ্কা সফরে গিয়ে বেশ কবারই ইচ্ছে হলো মুরালিধরনকে ১৯৯৪ সালের ওই ঘটনাটা মনে করিয়ে দিই। একদা যাকে ইন্টারভিউ করাটা পণ্ডশ্রম হবে ভেবে এড়িয়ে চলেছি, সেই তিনিই যে এখন ইন্টারভিউ দেবেন বলে শুধু ঘুরিয়েই যাচ্ছেন! একই হোটেলে আছি বলে নিয়মিতই দেখাসাক্ষাৎ হচ্ছে, হাসিমুখে ‘দেব, দিচ্ছি’ বলেও যাচ্ছেন, কিন্তু ব্যাটে-বলে আর হচ্ছে না। মাঠে যাওয়ার সময়টা ছাড়া মুরালির ছায়াসঙ্গী হয়ে থাকেন স্ত্রী মাধিমালার ও ছেলে নারাইন। তা এমন নিবিড় একান্ত ছবির মতো দেখায় যে ইন্টারভিউ তো ইন্টারভিউ, ক্রিকেটের কথা তুলতেই কেমন যেন লাগে!

তারপরও তুলছি, কিন্তু আজ-কাল করতে করতে কলম্বোতে সিরিজের প্রথম পর্ব শেষই করে ফেললেন মুরালি। ক্যান্ডিতে গিয়েও মুরালির প্রতিশ্রুতির আগামাথা না পেয়ে একদিন বলেই ফেললাম, ‘মুরালি, তুই আমার সঙ্গে কথা বলছিস না! আর তোর বাপ আমার সঙ্গে ঠিকই কথা বলে!’ ইংরেজিতে তো আর ‘তুই’ ‘তুমি’ ‘আপনি’ আলাদা হয় না, তাঁকে যে তুই-তোকারি করছি, মুরালিধরন তাই তা একদমই বুঝতে পারেননি। তিনি উল্টো অবাক হয়ে এই দাবির কারণ জানতে চাইলেন। আমি জানালাম, আজ সকালেই ক্যান্ডি শহর থেকে ছয় কিলোমিটার দূরে কুন্ডেসালেতে তাঁদের বাড়ি ঘুরে এসেছি। মুরালির বাবা সিন্নাস্যামি মুত্তিয়ার সঙ্গেও কথা হয়েছে। ক্যান্ডির সবচেয়ে বড় বিস্কুট ফ্যাক্টরি লাকিল্যান্ড বিস্কিটস, যেটিতে মাসে লেনদেন হয় সাত কোটি টাকার ওপরে, সেটির মালিক এমন ‘মাটির মানুষ’ দেখে বিস্ময়ের কথা বললাম। বললাম, আমি তো তিনতলা বিশাল ফ্যাক্টরিতে গিয়ে তোমার বাবার চেম্বারে ঢুকব বলে বসে আছি। ভাবতেই পারিনি, সাধারণ কর্মচারীদের সঙ্গে একই রুমে বসে থাকা লোকটিই এই ফ্যাক্টরির মালিক!

মিশুক এবং হাসিখুশি বলেও খ্যাতি আছে মুরালিধরনের

একদমই মুরালিকে পটানোর জন্য নয়, কথাগুলো আন্তরিকভাবেই বলা। ফ্যাক্টরির পর নিজেদের পুরোনো জরাজীর্ণ কুটিরের পাশেই নতুন ঝকঝকে বাংলো-বাড়ি ঘুরিয়ে দেখানো মুরালির বাবার সারল্যে আসলেই তখনো আচ্ছন্ন আমি। আমার উদ্দেশ্য যা-ই থাকুক, এসব শুনেটুনে প্রথমবারের মতো মুরালিকেও খুব আন্তরিক দেখাল, ‘ইন্টারভিউয়ের জন্য আপনি ম্যানেজারের অনুমতি নিয়েছেন?’ সে তো আমি কবেই নিয়ে রেখেছি, তারপরও ঘটনাচক্রে তখনই সামনে এসে পড়া ম্যানেজারকে জিজ্ঞেস করে নিশ্চিত হওয়ার পর মুরালি প্রথমবারের মতো নির্দিষ্ট দিনক্ষণসহ প্রতিশ্রুতি দিলেন—কাল সকালে প্র্যাকটিসের পর।

পরদিন আসগিরিয়া স্টেডিয়ামে শ্রীলঙ্কান ড্রেসিংরুমের ব্যালকনিতে বসে সেই ইন্টারভিউ নিতে নিতে ১৯৯৪ সালের মুরালিকে যেমন মনে পড়ল, মনে পড়ল ১৯৯৬ সালের মুরালিকেও। ১৯৯৬ বিশ্বকাপের পরপর সিঙ্গাপুরে সিঙ্গার কাপে গিয়ে মুরালিধরনকে প্রথম ইন্টারভিউ করেছিলাম। সেই ইন্টারভিউ ছিল এবারের চেয়েও বেশি সাধ্যসাধনায় পাওয়া। মাত্র কয়েক মাস আগে অস্ট্রেলিয়ায় ড্যারেল হেয়ার চাকিংয়ের অভিযোগে ‘নো’ ডেকেছেন, এ ঘটনায় তখন ক্রিকেট বিশ্বে তোলপাড়। মুরালির ইন্টারভিউকাঙ্ক্ষী সাংবাদিকের সংখ্যাও তাই অনেক। শ্রীলঙ্কান ম্যানেজার দিলীপ মেন্ডিসের সঙ্গে পুরোনো সম্পর্কের কল্যাণে ইন্টারভিউয়ের অনুমতি পাওয়ার পর বাকিদের ঈর্ষার কারণ হয়ে যখন আকাশে উড়ছি, মেন্ডিসই একটা পূর্বশর্ত দিয়ে মাটিতে নামিয়ে আনলেন, ‘চাকিংয়ের ব্যাপারে একটা প্রশ্নও নয়। আইসিসির নিষেধ আছে।’

মুরালিধরনের অ্যাকশনকে অবৈধ সন্দেহে ‘নো’ ডেকেছিলেন আম্পায়ার ড্যারেল হেয়ার

বলে কী! হেয়ার-কাণ্ড নিয়ে কথা বলতে না পারলে মুরালির ইন্টারভিউ করে কী হবে? তখন মুরালিকে ইন্টারভিউ করতে চাওয়ার কারণই তো ওই। সেটিই নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়ে যাওয়াতে ইন্টারভিউ করার আগ্রহ প্রায় শেষ। তারপরও ‘বলে ফেলেছি, এখন কথা না বললে কেমন দেখায়’ ভেবে ইন্টারভিউটা করলাম। এখন বোলিং অ্যাকশন নিয়ে কথা উঠলে মুরালি চ্যাটাং চ্যাটাং কথা শুনিয়ে দেন। তখন তো আর অবস্থাটা এমন ছিল না। বিতর্কে জড়সড় মুরালিধরনের বেশির ভাগ উত্তর এমনই ‘ইয়েস’ ‘নো’ ‘ভেরি গুড’ মার্কা হয়েছিল যে ইন্টারভিউটা পত্রিকার জন্য আর লিখিইনি!

মুরালি যে অমন নিরামিষ সব উত্তর দিয়েছিলেন, এর কারণ বোধ হয় শুধুই বিতর্ক-ভীতি ছিল না। ১৯৯৬ সালের মুত্তিয়া মুরালিধরন লাজুক এক তরুণ। কথায় কথায় হাসেন। পারলে কথার কাজও হাসি দিয়ে সারেন। তাঁকে নিয়ে আলোচনায় সবার মুখেই একটা কথা ‘কমন’ পেয়েছি—এত বিতর্ক, এত ঝড়ঝাপটা, কিন্তু ছেলেটার মুখে হাসিটা ঠিকই অমলিন। পরে সেই শ্রীলঙ্কায় গিয়েই আবার স্থানীয় সাংবাদিকদের মুখে অভিযোগ শুনেছি, ‘মুরালি বেশি বকবক করে। সব ব্যাপারেই ওর মত আছে!’

ক্রিকেট এবং এর সঙ্গে জীবন নাটকীয়-গ্লানিকর-আনন্দময় এত সব অভিজ্ঞতার সঙ্গে মুরালিকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে যে তাঁর পক্ষে ওই লাজুক তরুণটি হয়ে থাকা কোনোভাবেই সম্ভব ছিল না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বোলার মুরালিধরন তো অবশ্যই বদলেছেন। হয়তো মানুষ মুরালিধরনও। শুধু্ একটি জিনিসই বদলায়নি।
মুখের ওই অমলিন হাসিটা।