স্বপ্নকে তাড়া করে এতটা উঠে এসেছে আফগানিস্তান
স্বপ্নকে তাড়া করে এতটা উঠে এসেছে আফগানিস্তান

উৎপল শুভ্রর লেখা

আফগানিস্তান কেন পারে, বাংলাদেশ কেন পারে না

একটা দল স্বপ্ন দেখতে জানে। জানে সেই স্বপ্নকে তাড়া করতে। এ জন্য যা যা করতে হয়, সবকিছু করতেও প্রস্তুত। মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে, ‘অসম্ভব’ বলে শব্দটার অস্তিত্ব আছে শুধুই অভিধানে।

আরেকটা দল স্বপ্ন দেখতে ভয় পায়। মুখে এটা-ওটা করার স্বপ্নের কথা বলে বটে, কিন্তু নিজেরাই মন থেকে তা বিশ্বাস করে না। অল্পেই সন্তুষ্ট থেকে তৃপ্তির ঢেকুর তোলে।

এই দুই দল মুখোমুখি হলে প্রতিবারই প্রথম দলটার জেতার কথা। খেলাটা ক্রিকেট বলেই কখনো কখনো দ্বিতীয় দলটাও জিতে যায়। কিন্তু আসল সময়ে ঠিকই পার্থক্য গড়ে দেয় দুই দলের দুই রকম মানসিকতা। আফগানিস্তান বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে উঠে যায়। আর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তাদের অনেক বছরের ‘বড় ভাই’ বাংলাদেশের কাছে তা স্বপ্নই হয়ে থাকে। যে স্বপ্নের কথা সে দেশের ক্রিকেটাররাও কখনো কখনো বলেন, তবে তা যেন বলার জন্যই বলা। সেই স্বপ্ন তাড়া করার সাহস তাদের নেই।

‘তাড়া’ শব্দটা এখানে আক্ষরিকভাবেও নিতে পারেন। এই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে উঠতে তাড়াই তো করতে হতো বাংলাদেশকে। সেটি রান তাড়া। ১২.১ ওভারে ১১৬ রান। আসলে তো একটা স্বপ্নকে তাড়া করা। সেই স্বপ্নের নাম প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল খেলা। আফগানিস্তান এই পরিস্থিতিতে থাকলে কী করত, এ নিয়ে আলোচনারই কোনো প্রয়োজন দেখছি না। হয়তো পারত, হয়তো না। কিন্তু ঠিকই সর্বস্ব দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ত। আগেই হাল ছেড়ে দিত না। কোনো দলই কি তা দিত?

স্বপ্নকে তাড়া করতে পারেনি বাংলাদেশ

১২.১ ওভারের মধ্যে জিততে পারলেই শুধু সেমিফাইনাল। এরপর জিতলেও দেশে ফেরার বিমানে উঠতে হবে, হারলেও উঠতে হবে। এখানে কি আর সিদ্ধান্ত নেওয়ার কিছু থাকে? বাংলাদেশ পুরো ক্রিকেট-বিশ্বকে হতবাক করে জানিয়ে দিয়েছে, থাকে। স্বপ্ন দেখতে ভয় পেলেই শুধু থাকে।

ক্রিকেটের সবচেয়ে রোমান্টিক গল্পের নাম আফগানিস্তান। যুদ্ধবিধ্বস্ত এক দেশ, শরণার্থীশিবিরে ক্রিকেটের সঙ্গে পরিচয়—এসব সবারই জানা। এই আফগানিস্তান দলের প্রায় সব ক্রিকেটারের জীবনের গল্প নিয়েই হয়তো সিনেমা বানানো যায়। সিনেমার সব উপাদানই তো আছে সেখানে। লড়াই, সংগ্রাম, দৃঢ়প্রতিজ্ঞা, জিগীষা—সবকিছু। 

বিশ্ব ক্রিকেটে আফগানিস্তানের উঠে আসা অবিশ্বাস্য এক উত্থানের গল্প। শুধু এ কারণেই আফগানিস্তান এমন রোমান্টিক গল্প নয়। ক্রিকেটটা তারা যেভাবে খেলে, সেটাও একটা কারণ। একটা সময় ক্রিকেট–বিশ্বে প্রায় সবার দ্বিতীয় প্রিয় দলের নাম ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। প্রথমে নিজের দেশ, তারপরই ওয়েস্ট ইন্ডিজ। এখনো হয়তো অনেকের তা-ই আছে। তবে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বদলে আফগানিস্তানের নামটাও কি কেউ কেউ বসিয়ে নেননি!

আফগানিস্তান সেমিফাইনালে ওঠায় শুধু আফগানরাই নন, সবাই তাই খুশি। ও হ্যাঁ, অস্ট্রেলিয়া অবশ্যই খুশি নয়। তবে সেটি তো তারা সেমিফাইনালের আগেই ছিটকে পড়েছে বলে। তবে সে জন্য আফগানিস্তানের ওপর তাদের কোনো রাগ থাকার কথা নয়। রাগ থাকলে তা থাকবে বাংলাদেশের ওপর।

জালালাবাদে বড় পর্দায় আফগানিস্তান–বাংলাদেশ ম্যাচ দেখেন রশিদদের সমর্থকেরা। আফগানিস্তানের উঠে আসার গল্প অবিশ্বাস্য

বিশ্বকাপের আগেই আফগানিস্তানকে সেমিফাইনালে দেখেছিলেন ব্রায়ান লারা। রশিদ খান সে কথা ভোলেননি। বিশ্বকাপের আগে ওয়েলকাম পার্টিতে লারার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর তাঁকে বলেছেন, লারার ভবিষ্যদ্বাণী যেন ভুল প্রমাণিত না হয়, সে জন্য সব করবে তাঁর দল। তা তো করেছেই। সেমিফাইনালে উঠেছে আফগানিস্তান আর ঘটনাচক্রে সেই সেমিফাইনালও কিনা ব্রায়ান লারার দেশ ত্রিনিদাদেই!

সেই সেমিফাইনালে ওঠাটাকেও ফ্লুক বলার কোনো উপায় নেই। বিশ্বকাপে না হোক, আইসিসি টুর্নামেন্টে বাংলাদেশও একটা সেমিফাইনাল খেলেছে। তবে তা ছিল অনেকটাই বৃষ্টির কৃপাধন্য। বড় জয় বলতে এক নিউজিল্যান্ডকে হারানো। যেখানে আফগানিস্তানের সেমিফাইনালে ওঠায় কোনো ‘যদি’-’কিন্তু’র ব্যাপার নেই। বাংলাদেশকে হারানোর আগে হারিয়েছে নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার মতো দলকে। 

গত ওয়ানডে বিশ্বকাপে গ্লেন ম্যাক্সওয়েলের অতিমানবীয় ইনিংসে হার মানতে হয় আফগানিস্তানকে

গত ওয়ানডে বিশ্বকাপের কথাই ধরুন না। সেই বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে প্রায় উঠেই গিয়েছিল আফগানিস্তান। মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়েতে গ্লেন ম্যাক্সওয়েলের ওই অবিশ্বাস্য, প্রায় ভুতুড়ে ওই ইনিংসটাই না উঠতে দেয়নি। এর আগে হারিয়েছে শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, ইংল্যান্ড ও নেদারল্যান্ডসকে। বিশ্বকাপজয়ী তিন দলের সঙ্গে নেদারল্যান্ডসকেও রাখার কারণ তো আছেই। বাংলাদেশ তো ওই নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষেও হেরেছে। ওই বিশ্বকাপ যতই এগিয়েছে, ততই আফগানিস্তানের বিপক্ষে বাংলাদেশের জয়টা অবাস্তব বলে মনে হয়েছে। হয়তো বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচের জড়তাই হয়তো আফগানিস্তানের কাল হয়েছিল সেদিন।

বিশ্বজুড়ে ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগগুলোতে আফগান ক্রিকেটারদের দাপুটে বিচরণও বুঝিয়ে দেয়, টি-টোয়েন্টির পৃথিবীতে বাংলাদেশ এখনো কোথায় পড়ে আছে! টি-টোয়েন্টির কথা যদি বাদও দেন, টেস্ট ক্রিকেটেই–বা কি! প্রথম দেখাতেই কি বাংলাদেশকে হারিয়ে দেয়নি আফগানিস্তান?

খেলোয়াড়ি দক্ষতা অবশ্যই বড় ব্যাপার। তার চেয়েও বড় ব্যাপার সম্ভবত মানসিকতায়। যেখানে আফগানিস্তান যোজন যোজন ব্যবধানে এগিয়ে। আফগানরা স্বপ্ন দেখতে জানে, বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা স্বপ্ন দেখতে ভয় পায়। যে কারণে আফগানিস্তান বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে খেলে। আর বাংলাদেশ কোনোমতে আরেকটা ম্যাচ জিতে দেশে ফিরতে চেয়ে সেটাও পারে না।

উল্টো আরও অনেক প্রশ্ন তুলে দেয়।