অ্যাশেজের বাইরে একুশ শতকে সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত টেস্ট সিরিজ কোনটি?
ধারে–ভারে, অর্থ–বিত্তে কিংবা শৌর্য–বীর্যে অবশ্যই বোর্ডার–গাভাস্কার ট্রফি। ছেলেদের টেস্ট র্যাঙ্কিংয়ে শীর্ষ দুই দলের লড়াই। একের অস্ট্রেলিয়া, দুইয়ের ভারত। জিতবে কে?
ড্র না হলে অবশ্যই যেকোনো একটি দল! রসিকতা নয়, আসলে দুই দলের শক্তি ও ঐতিহ্য বিচারে এই সিরিজ নিয়ে আগাম কিছু বলে রাখা বোকামি। তার চেয়ে উপভোগই শ্রেয় এবং সবাই তা করে বলেই সম্ভবত ১৯৯১–৯২–এর পর এই প্রথম বোর্ডার–গাভাস্কার ট্রফিতে দেখা যাবে ৫ টেস্টের সিরিজ।
গত বছর জুনে ভারতকে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনালে হারানো অস্ট্রেলিয়া এই সিরিজ জিততে মরিয়া থাকবে বেশ কিছু কারণে। গত বছর ফেব্রুয়ারি–মার্চে ভারতের মাটিতে সর্বশেষ বোর্ডার–গাভাস্কার ট্রফিতে অস্ট্রেলিয়া হেরেছে। শুধু ভারতে নয়, অস্ট্রেলিয়া নিজেদের মাঠে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ (২০১৮–১৯, ২০২০–২১) দুটি সিরিজেও হেরেছে। সব মিলিয়ে ১০ বছর হতে চলল বোর্ডার–গাভাস্কার ট্রফি জিততে পারছে না অস্ট্রেলিয়া।
অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে আগের দুটি সিরিজ জেতায় ভারত স্বাভাবিকভাবেই মানসিকভাবে এগিয়ে। তবে পিছিয়ে থাকার জায়গাও কম নয়। চলতি মাসের শুরুতে ঘরের মাঠে নিউজিল্যান্ডের কাছে তিন ম্যাচের টেস্ট সিরিজে ধবলধোলাই হয়েছে রোহিত শর্মার দল। বিব্রতকর এই হারকে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে জিদ হিসেবে কাজে লাগাতে মরিয়া থাকবে ভারত।
পার্থে আগামীকাল থেকে শুরু হচ্ছে এই সিরিজ। আইসিসির ওয়েবসাইটে এই সিরিজের পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে, যা ঠিক করে দিতে পারে সিরিজের ভাগ্যও। দেখুন তো, আপনার ভাবনার সঙ্গে মেলে কি না—
অস্ট্রেলিয়ান কন্ডিশন ও পিচে নতুন বলের ব্যবহার ও মোকাবিলা সব সময়ই গুরুত্বপূর্ণ। মাত্র ১৪ টেস্টের অভিজ্ঞতালব্ধ বিশ্বমানের প্রতিভা যশস্বী জয়সোয়াল নিশ্চয়ই তা জানেন। অস্ট্রেলিয়ার সর্বজয়ী পেস আক্রমণ সামলানোর চ্যালেঞ্জ নিতে বাঁহাতি এ ওপেনার প্রথমবারের মতো মিচেল স্টার্কদের দেশে পা রেখেছেন।
জয়সোয়াল অবশ্য আইপিএলেই অস্ট্রেলিয়ার বাঁহাতি এই পেসারের মুখোমুখি হয়েছেন। কিন্তু টি–টোয়েন্টির সেই মুখোমুখিকে পুঁজি করে টেস্টে তাঁদের মধ্যে সম্ভাব্য দ্বৈরথের ব্যাপারে কোনো ভবিষ্যদ্বাণী করা যায় না। তবে এক বছর আগে ভারতের দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে তাকিয়ে আন্দাজ করে নেওয়া যায়, জয়সোয়ালের মাথাব্যথার কারণ কেউ হতে পারলে স্টার্কই হবেন।
সেই সফরে সেঞ্চুরিয়নে প্রথম টেস্টের দুই ইনিংসেই প্রোটিয়া বাঁহাতি পেসার নান্দ্রে বার্গারের বলে আউট হয়েছিলেন জয়সোয়াল। দ্বিতীয় টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসেও দেখা গেছে একই চিত্র। সেঞ্চুরিয়নে প্রথম ইনিংসে আউট হন সুইং করে বেরিয়ে যাওয়া বলে স্লিপে ক্যাচ দিয়ে। দ্বিতীয় ইনিংসে একটু পেছনের লেংথ থেকে ওঠা অতিরিক্ত বাউন্স সামলাতে না পেরে উইকেটকিপারকে ক্যাচ দিয়ে।
অস্ট্রেলিয়ার পেসবান্ধব কন্ডিশন এমনিতেই অচেনা জয়সোয়ালের। সাধারণ মানের পেসাররাই অসাধারণ হয়ে ওঠেন। সেখানে স্টার্কের মতো অভিজ্ঞ ও আক্রমণাত্মক ফাস্ট বোলারকে সামলানো জয়সোয়ালের ক্যারিয়ারে সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জ হতে পারে।
জানুয়ারিতে ডেভিড ওয়ার্নার অবসর নেওয়ার পর অস্ট্রেলিয়ার ওপেনিং জুটিতে উসমান খাজার সঙ্গী খুঁজেছে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া (সিএ)। স্যাম কনস্তাস, মার্কাস হ্যারিস ও ক্যামেরন ব্যানক্রফটকে পেছনে ফেলে শেষ পর্যন্ত খাজার সঙ্গী হওয়ার টিকিট পেয়েছেন নাথান ম্যাকসুয়েনি। তবে ভারতের প্রধান পেসার যশপ্রীত বুমরাকে সামলানোর মতো যথেষ্ট অভিজ্ঞতা খুব কমই আছে ২৫ বছর বয়সী এ অলরাউন্ডারের।
যদিও টেস্ট অভিষেকের আগে ম্যাকসুয়েনি এই ব্যাপারটাকে অজুহাত বানাতে চান না। স্কোয়াডে ডাক পাওয়ার পর বলেছিলেন, ‘কীভাবে খেলব, সেটা মনে মনে ভাবার চেষ্টা করছি। নতুন একজন বোলারের মুখোমুখি হয়ে তাঁর অ্যাকশন ধরতে পারা চ্যালেঞ্জের। কিন্তু তার ক্ষেত্রে সেটা হয়তো সম্ভব হবে না। অবশ্যই তার অ্যাকশন অনন্য, বিশ্বের অন্যতম সেরা বোলারও। এটা নিশ্চিত যে তাকে নকল করা কঠিন।’
ভারতের বোলিং বিভাগে বুমরার গুরুত্ব প্রশ্নাতীত। অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটিং অর্ডার ভাঙতে তুরুপের তাস হতে পারেনই। তবে ম্যাকসুয়েনিকে আশস্ত করেছেন তাঁর ওপেনিং সতীর্থ খাজা, ‘ক্রিকেটে নিশ্চয়তা বলে কিছু নেই...তবে তাকে আলাদা কিছু করতে হবে না। শুধু প্রক্রিয়াটার পুনরাবৃত্তি করলেই চলবে। শিল্ড পর্যায়ে সে চাপ সামলেছে।’
৬ টেস্টে অশ্বিনের মুখোমুখি হয়ে তিনবার আউট হয়েছেন হেড। তবে ভারতের এই বিশ্বমানের অফ স্পিনারের বিপক্ষে ২৯৫ বল খেলা হেডের স্ট্রাইক রেটও (৪২.৪০) মাথায় রাখতে হবে। এর অর্থ হলো অস্ট্রেলিয়ান বাঁহাতি ব্যাটসম্যানের অশ্বিনকে ঝামেলায় ফেলার মতো সামর্থ্যও আছে।
২০২০ সালে অ্যাডিলেডে অশ্বিনের বলে আকাশে ক্যাচ তুলে আউট হয়েছিলেন হেড। তবে গত বছর ভারতের সর্বশেষ অস্ট্রেলিয়া সফরের পর ঘরের মাঠে হেডের ব্যাটিং গড় ৫৪.১০, স্ট্রাইক রেট ৮৭.৪৬। ২০২০–২১ মৌসুমে সর্বশেষ অস্ট্রেলিয়া সফরে ৩ ম্যাচে ১২ উইকেট নিয়েছিলেন অশ্বিন। প্রস্তুত হউন, দুজনের লড়াই ভালোই জমতে পারে।
২০২০–২১ মৌসুমে অস্ট্রেলিয়ার ভারত সফরের পর টেস্টে ৫৪ ইনিংসে বিরাট কোহলির রান ১৭২২, গড় ৩৩.১১, সেঞ্চুরি ২টি।
পরিসংখ্যানটি কোহলির মাপের ব্যাটসম্যানের জন্য সন্তোষজনক হয়তো নয়। তবে চাপের মধ্যে তাঁর পারফর্ম করার সামর্থ্য জানা থাকলে উল্টোটাও হতে পারে। কে জানে এবার অস্ট্রেলিয়া সফরে দারুণ ছন্দেও ফিরতে পারেন! অস্ট্রেলিয়ায় কোহলির গড় ৫৩.১৩। আর টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার পেসার হ্যাজলউডের বিপক্ষে তাঁর গড় ৫৫.৭।
হ্যাজলউডকে শুরু থেকেই আক্রমণ করতে পারেন কোহলি। তাই সুযোগ থাকছে হ্যাজলউডেরও। আর অফ স্টাম্পের একটু বাইরে কোহলির দুর্বলতা তো সবারই জানা। হ্যাজলউড কিন্তু ওই লাইনেই বোলিং করতে অভ্যস্ত।
অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে ভারতের সাম্প্রতিক সাফল্যে বেশ বড় ভূমিকা রেখেছিল চেতেশ্বর পূজারার উইকেট কামড়ে পড়ে থাকা। এবার পূজারা নেই, তাই এই দায়িত্বটা কে নেবেন, সেটা একটা প্রশ্ন। রোহিত শর্মার প্রথম টেস্টে অনুপস্থিতি ভারতের নির্বাচকদের আরও বড় সমস্যায় ফেলেছে।
তবে প্রস্তুতি ম্যাচে উইকেটকিপার–ব্যাটসম্যান ধ্রুব জুরেল ভালো করায় তাঁকে পূজারার ভূমিকা পালন করতে হতে পারে। ভারতের সাবেক ক্রিকেটার ও ধারাভাষ্যকার রবি শাস্ত্রী এরই মধ্যে প্রশংসা করেছেন জুরেলের, ‘তার টেম্পারমেন্ট এবং চাপের মুহূর্তে ঠান্ডা মাথা আমাকে মুগ্ধ করেছে। খেলায় একদম ঝুঁকিহীন—বিশেষ করে চাপের মুহূর্তে। এই চাপে অনেকেই ভেঙে পড়ে...কিন্তু এই ছেলেটার টেম্পারমেন্ট তখন নজর কাড়ে। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজেও (এ বছরের শুরুতে) সে চাপের মুহূর্তে লড়েছে। তাই আমি যেটা দেখেছি, সেটার ভিত্তিতে বলতে পারি, সে ভালো ছন্দে থাকলে নামতে পারে।’