কী বলবেন এটিকে—বাংলাদেশের ক্রিকেটে নতুন যুগের সূচনা?
বলতেই পারেন। নতুন অধিনায়ক, নতুন প্রধান নির্বাচক—নতুন যুগের সূচনা তো হচ্ছেই। আধুনিক ক্রিকেটে কোচের ভূমিকাও ক্রমে প্রসারিত হচ্ছে, বাংলাদেশে হয়তো তা একটু বেশিই। তবে সব দেশে, সব কালে কোনো ক্রিকেট দলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে অপরিবর্তিত থেকেছে এই দুটি পদ—অধিনায়ক ও প্রধান নির্বাচক। যেকোনো দলের বর্তমান তো বটেই, ভবিষ্যতের গতিপথ ঠিক করে দেওয়ায়ও বড় ভূমিকা থাকে এই দুজনের। গতকাল বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সভাটাকে এদিক থেকে যুগান্তকারীই বলতে হবে। যে সভায় গুরুত্বপূর্ণ আরও অনেক সিদ্ধান্তই হয়েছে। তবে বাকি সব ছাপিয়ে স্বাভাবিকভাবেই সব বড় হয়ে উঠেছে দুটি নাম—নাজমুল হোসেন ও গাজী আশরাফ হোসেন।
প্রথমটিকে অবশ্য রুটিন ঘোষণাও বলতে পারেন। কারণ, নাজমুল হোসেনকে বাংলাদেশ দলের নতুন অধিনায়ক হিসেবে ঘোষণায় সেই অর্থে কোনো চমক নেই। গত কিছুদিনের ঘটনাপ্রবাহে এটা ছিল সময়ের দাবি। তারপরও আনুষ্ঠানিক ঘোষণার আগপর্যন্ত একটু সংশয় তো ছিলই। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড সব সময় যে সময়ের দাবি মেনে চলে, এমন বলার যে উপায় নেই।
তারপরও নাজমুলকে অধিনায়ক ঘোষণা করাটাকে অনুমিত বলাই যায়, প্রধান নির্বাচক হিসেবে গাজী আশরাফ হোসেন যেখানে অবশ্যই চমক। এই অর্থে যে অনেক দিন ধরেই বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের এই কমিটির সঙ্গে তাঁর কোনো সংশ্রব নেই। ২০১৩ সালের বিসিবির পরিচালনা পর্ষদের নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পর বাংলাদেশের ক্রিকেট থেকে একটু গুটিয়েই নিয়েছিলেন নিজেকে। কখনো কখনো সরব হয়েছেন, তবে অন্য ভূমিকায়। বোর্ডের যেসব কার্যক্রম নিয়ে সমালোচনার অবকাশ আছে, সেসব নিয়ে মনের কথাই বলে এসেছেন সব সময়। কখনো সেটির মাধ্যম ছিল সংবাদপত্রে লেখা কলাম, কখনোবা টেলিভিশনের টক শো।
বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে বিসিবির কাছে এসব ‘অযোগ্যতা’ হিসেবে বিবেচিত হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু ছিল না। চমক মনে হওয়ার আরেকটা কারণ, গত কিছুদিন প্রধান নির্বাচক হিসেবে অনেকের নাম ভেসে বেড়ালেও গাজী আশরাফ হোসেনের নামটা সেভাবে শোনা যায়নি।
বাংলাদেশের প্রথম ওয়ানডে অধিনায়ক তিনি। খেলোয়াড়ি জীবন শেষে নানা ভূমিকায় বাংলাদেশের ক্রিকেটের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন। গাজী আশরাফ হোসেনকে জিজ্ঞেস না করেই লিখে দেওয়া যায়, এর মধ্যে তিনি নিশ্চয়ই সবচেয়ে গর্ব বোধ করেন ১৯৯৭ আইসিসি ট্রফিতে রাখা ভূমিকার জন্য। ‘নতুন যুগের সূচনা’ বলে যে কথাটা দিয়ে এই লেখাটার শুরু, বাংলাদেশের ক্রিকেটে আরও বৃহত্তর অর্থে নতুন যুগের সূচনা মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিত ওই আইসিসি ট্রফি জয়ের মাধ্যমে। যে জয়ে বড় গর্ডন গ্রিনিজ ও গাজী আশরাফ হোসেনের যুগলবন্দীর বড় অবদান। আইসিসি ট্রফিজয়ী দলের সহ-অধিনায়ক আমিনুল ইসলাম তো এই দুজনের মধ্যে গাজী আশরাফের ভূমিকাকেই বড় করে দেখেন। জেনেই বলতে পারি, এই ভাবনায় আমিনুল একা নন।
আইসিসি ট্রফির আগে-পরে বাংলাদেশের দল নির্বাচনেও পরোক্ষ ভূমিকা রেখেছেন, তবে সরাসরি নির্বাচকের ভূমিকায় এবারই প্রথম দেখা দিচ্ছেন গাজী আশরাফ হোসেন। এই দায়িত্ব তিনি কীভাবে পালন করেন, তা নিয়ে কৌতূহল তো এমনিতেই থাকত। সেই কৌতূহলটা আরও বেড়ে যাচ্ছে, গত কিছুদিন বিসিবির নির্বাচক কমিটির কার্যপ্রণালির কারণে। প্রায় ৯ বছর প্রধান নির্বাচকের দায়িত্ব পালন করে আসা মিনহাজুল আবেদীনের সময়ে দল নির্বাচনটা অনেকটাই ‘দশে মিলি করি কাজ’-এর মতো হয়ে দাঁড়িয়েছিল। দল নির্বাচনে বোর্ড সভাপতি তো বটেই, বোর্ডের অনেক পরিচালকও ‘অবদান’ রেখে এসেছেন বলেই শোনা যায়। সেসবকে শোনা কথা বলে উড়িয়ে দেওয়ার উপায় নেই। দল নির্বাচনের এই গোলমেলে প্রক্রিয়ার প্রতিবাদেই প্রধান নির্বাচকের পদ থেকে সরে গিয়েছিলেন আরেক সাবেক অধিনায়ক ফারুক আহমেদ।
গাজী আশরাফকে প্রধান নির্বাচক হিসেবে বেছে নেওয়াটা এ কারণেও চমক। দল নির্বাচনে পূর্ণ স্বাধীনতার নিশ্চয়তা না পেলে তাঁর এই দায়িত্ব নিতে রাজি হওয়ার কথা নয়। বিসিবি যদি সত্যিই তা দিয়ে থাকে, বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্যই তা একটা ইতিবাচক ব্যাপার
ব্যক্তিগত জীবনে তাঁরা দুজন পরস্পরের অনুরাগী না-ই হতে পারেন, তবে দৃঢ় ব্যক্তিত্ব এবং স্বাধীনচেতা স্বভাবের দিক থেকে গাজী আশরাফ হোসেন ও ফারুক আহমেদের মধ্যে মিল আছে। গাজী আশরাফকে প্রধান নির্বাচক হিসেবে বেছে নেওয়াটা এ কারণেও চমক। দল নির্বাচনে পূর্ণ স্বাধীনতার নিশ্চয়তা না পেলে তাঁর এই দায়িত্ব নিতে রাজি হওয়ার কথা নয়। বিসিবি যদি সত্যিই তা দিয়ে থাকে, বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্যই তা একটা ইতিবাচক ব্যাপার। দল নির্বাচনের কাজটা নির্বাচকদের ওপরই ছেড়ে না দিলে তাঁদের কাছে বিসিবির জবাবদিহি চাওয়ার এখতিয়ারও যে আর থাকে না।
বাংলাদেশের যে সংস্কৃতি, তাতে ড্রেসিংরুমের কর্তৃত্বটা একজনের হাতে থাকাই ভালো। নাজমুলকে তিন সংস্করণেরই অধিনায়ক করাটাকেও তাই নতুন যুগের সূচনা বলা যায়।
গাজী আশরাফ হোসেনের নতুন ভূমিকায় দৃশ্যপটে আসাটা চমক বলেই এ নিয়ে এত কথা বলা হয়ে গেল। যাতে নাজমুল হোসেনের অধিনায়কত্ব পাওয়াটাকে কম গুরুত্বপূর্ণ ভাবা হচ্ছে, এমন ভুল বোঝার অবকাশও থাকে। এর বড় কারণ তো অবশ্যই এটা যে নাজমুলের নেতৃত্বগুণ নিয়ে গত কিছুদিন অনেক কথা হয়েছে। সাকিব আল হাসানের ‘ডামি’ হিসেবে তিন সংস্করণ মিলিয়ে যে ১১টি ম্যাচে বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাতেই পরিষ্কার বুঝিয়ে দিয়েছেন, সাকিব, তামিম–পরবর্তী যুগে বাংলাদেশকে নিয়ে যাওয়ার জন্য তিনিই সবচেয়ে উপযুক্ত। শুধু মাঠের অধিনায়কত্বই নয়, মাঠের বাইরে নাজমুলের কথাবার্তায়ও ফুটে উঠেছে সত্যিকার এক অধিনায়কের প্রতিচ্ছবি। আপাতত বছরখানেকের জন্য দায়িত্ব পাওয়ায় বর্তমানের সঙ্গে একটু দূরে তাকানোরও সুযোগ পাবেন তিনি।
অধিনায়কত্ব ভাগ–বাঁটোয়ারার বদলে তিন সংস্করণেই নাজমুলকে অধিনায়ক করার সিদ্ধান্তটাও সাধুবাদ পাওয়ার মতো। এই ভাগ–বাঁটোয়ারার শুরুটা হয়েছিল ২০১৪ সালে, তবে সেটি মূলত মাশরাফি বিন মুর্তজা টেস্ট খেলতেন না বলে। প্রথম দিকে তা হয়তো কিছুটা কাজেও এসেছিল। তবে গত কয়েক বছরে একেক সংস্করণে একেকজনের অধিনায়কত্ব করাটা বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য বেশির ভাগ সময়ই ভালো হয়নি। দলে বিভেদও তৈরি করেছে কখনো কখনো। বাংলাদেশের যে সংস্কৃতি, তাতে ড্রেসিংরুমের কর্তৃত্বটা একজনের হাতে থাকাই ভালো। নাজমুলকে তিন সংস্করণেরই অধিনায়ক করাটাকেও তাই নতুন যুগের সূচনা বলা যায়। গত কিছুদিন সাকিব তা ছিলেন বটে, তবে সেটি তো ঘটনাচক্রে।
নাজমুল আর গাজী আশরাফের মাধ্যমে শুরু নতুন যুগ কেমন হয়, তা গভীর আগ্রহের বিষয় হয়ে থাকল।