টেস্ট সিরিজে এই ট্রফির জন্যই লড়াই।দুই অধিনায়ক ধনাঞ্জয়া ডি সিলভা ও নাজমুল হোসেন
টেস্ট সিরিজে এই ট্রফির জন্যই লড়াই।দুই অধিনায়ক ধনাঞ্জয়া ডি সিলভা ও নাজমুল হোসেন

উৎপল শুভ্রর লেখা

বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা টেস্ট: অভিজ্ঞতায় অসম দুই দলের লড়াই

শ্রীলঙ্কা দল মাত্রই অনুশীলন শেষে হোটেলে ফিরেছে। ফিরে সরাসরি সিলেট গ্র্যান্ড হোটেলের নয়তলার মিটিং রুমে। রুদ্ধদ্বার সভা নয়। দরজা খোলা, ভেতরের কিচিরমিচির বাইরে আসছে। সেটির ভাষা সিংহলিজ বলে কথাবার্তা বোঝার উপায় নেই। তবে সবচেয়ে সরব কণ্ঠটা সহজেই শনাক্ত করা গেল। অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুস।

ঘড়িতে তখন বিকেল পাঁচটা। বাইরে মেঘলা আকাশের নিচে সিলেট বিষণ্ন থেকে বিষণ্নতর হচ্ছে। দুপুর পর্যন্ত ঢাকাকে যেমন দেখে এসেছি, সিলেট যেন তার ফটোকপি। ঘণ্টা দুই-আড়াই আগে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিও হয়েছে। আজ শুরু সিরিজের প্রথম টেস্ট ম্যাচের শেষ চার দিনই যেটি আসবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়ে রেখেছে।

শ্রীলঙ্কার টিম মিটিংয়ে অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুসের সবচেয়ে সরব থাকাটায় অবশ্য অবাক হওয়ার কিছূ নেই। কথা তো বেশি বলবে ‘বড়’রাই। শুধু শ্রীলঙ্কা দলেই নয়, দুই দল মিলিয়েই ম্যাথুস বড়। বয়সে যেমন, তেমনি অভিজ্ঞতাতেও। ৩৭ ছুঁই ছুঁই অলরাউন্ডার সিলেটে খেলতে নামবেন ১০৮তম টেস্ট। চার গ্রেট জয়াসুরিয়া, মুরালিধরন, সাঙ্গাকারা ও জয়াবর্ধনেই শুধু শ্রীলঙ্কার হয়ে এর চেয়ে বেশি টেস্ট খেলতে পেরেছেন।

অভিজ্ঞতার দিক থেকে অসম এক টেস্ট ম্যাচই। শ্রীলঙ্কার তিন খেলোয়াড় ম্যাথুস, চান্ডিমাল আর করুনারত্নের মিলিত টেস্ট সংখ্যা (২৭৩) বাংলাদেশের পুরো স্কোয়াডের টেস্ট সংখ্যার (২৭১) চেয়েও বেশি। সাকিব আল হাসান তো আগে থেকেই ছিলেন না, মুশফিকও ছিটকে পড়ায় বাংলাদেশ পরিণত অনেকটা কচিকাঁচার দলে। ৫০-এর বেশি টেস্টের অভিজ্ঞতা বলতে এক মুমিনুল হক।

পেস বোলিং বিভাগ তো আরও নবীন। যেখানে ১২ টেস্ট খেলেই সবচেয়ে অভিজ্ঞ খালেদ আহমেদ। অথচ সিলেট আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামের সবুজ উইকেট এখানে সম্ভাব্য পেসার-রাজের ঘোষণা দিয়ে দিচ্ছে। খালেদের সঙ্গে গতিময় দুই তরুণ মুশফিক হাসান ও নাহিদ রানার একই সঙ্গে অভিষেক হয়ে গেলেও তাই অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

অভিজ্ঞতার কথা যখন হচ্ছেই, একটা জায়গায় অবশ্য দুই দলে প্রায় সমতা। দুই অধিনায়কেরই এখন হাঁটি হাঁটি পা পা পর্যায়। অধিনায়ক হিসেবে নাজমুল হোসেনের এটি তৃতীয় টেস্ট। ধনঞ্জয়া ডি সিলভা আবার তাঁর এক টেস্ট জুনিয়র। সিলেট নিয়ে দুজনের অনুভূতি আবার দুই রকম হওয়ার কথা। আজ টস করতে নামার সময় নাজমুলের নিশ্চয়ই মনে পড়বে সেই সুখস্মৃতি। টেস্ট অধিনায়কত্বে অভিষেক কেউই ভোলে না। নাজমুলের তো প্রশ্নই ওঠে না।

মাস চারেক আগে এই সিলেটেই অধিনায়ক হিসেবে তাঁর অভিষেক টেস্টে বাংলাদেশ নিউজিল্যান্ডকে হারিয়েছে। সেঞ্চুরি করে যাতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা অধিনায়কেরই। দেশে হারানোর আগেই প্রতিপক্ষের মাঠে নিউজিল্যান্ডকে টেস্টে হারিয়েছে বাংলাদেশ। এটাকে যদি ব্যতিক্রমী বলেন, শ্রীলঙ্কাকেও রাখতে হয় এর সঙ্গে। এই দুই দলের টেস্টে বাংলাদেশের একমাত্র জয়টি শ্রীলঙ্কায়। ২০১৭ সালে বাংলাদেশের শততম টেস্টে সেই ঐতিহাসিক জয়। দেশের মাটিতে জয় পাওয়াটা তুলনায় সহজ হওয়ার কথা, কিন্তু বাংলাদেশ সেই সম্ভাবনাই জাগাতে পারেনি সেভাবে।

বড় একটা সুযোগ ছিল দুই বছর আগে শ্রীলঙ্কার সর্বশেষ সফরে। যার কারণ শুধু ক্রিকেটীয় ছিল না। চরম অর্থনৈতিক দুরবস্থায় শ্রীলঙ্কা তখন ভেঙে পড়েছে। টেস্ট সিরিজ শুরুর আগের দিন অনেক দিনের পরিচিত শ্রীলঙ্কান সাংবাদিক বলছিলেন, ট্যুরটা না হলেই ভালো হতো। দেশের ওই পরিস্থিতিতে ক্রিকেটারদের যে মানসিক অবস্থা, ওরা খেলবে কীভাবে? গতকাল বিকেলে সেই একই সাংবাদিককে ফোন করায় তিনি হাসতে হাসতে বললেন, এখন তো শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক অবস্থা অনেকটাই ভালো। এবার টেস্ট সিরিজ ২-০ না হয়ে যায়ই না।

কোন দলের পক্ষে ২-০, এটা বলার কোনো প্রয়োজন দেখলেন না। তবে শ্রীলঙ্কার নিরঙ্কুশ জয়ের ভবিষ্যদ্বাণীটা যে নিছকই মজা, তা বুঝিয়ে দেওয়া কর্তব্য বলে মনে করলেন। সর্বশেষ টেস্ট সিরিজে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে জয়ের প্রসঙ্গও এল সেখানে। এল টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশ দলের সাম্প্রতিক উন্নতির প্রমাণ হিসেবে। তবে সর্বজনীন শ্রীলঙ্কান একটা উপলব্ধির কথাও যোগ করলেন সঙ্গে, ‘গত কিছুদিনে বাংলাদেশ যতটা এগিয়েছে, শ্রীলঙ্কা তার চেয়ে অনেক বেশি পিছিয়েছে।’

বাজবল যতই সব বদলে দেওয়ার চেষ্টা করুক, অন্তর্গত একটা শান্তি আছেই টেস্ট ক্রিকেটের চরিত্রে। তারপরও এই দুই দল খোঁচাখুঁচিটাকে এমন ছেলেমানুষির পর্যায়ে নামিয়ে এনেছে যে টেস্ট সিরিজেও অমন কিছু দেখা যাওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট ম্যাচে দুই শ্রীলঙ্কান ব্যাটসম্যান বড় সেঞ্চুরি করার পর ইচ্ছা করে অবসর নিয়েছিলেন—এটা মনে রাখলে তো কথাটাকে সত্যিই ধরতে হয়। দুই বছর আগের বিপর্যস্ত সেই শ্রীলঙ্কাও কিন্তু টেস্ট সিরিজ জিতেছিল। তাতে বড় ভূমিকা ছিল ওই অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুসের, বিশ্বকাপে যাঁর টাইমড আউট এই দুই দলের ক্রিকেট ম্যাচকে নতুন করে আবার এমন ঝাঁজালো করে তুলেছে। নইলে ‘নাগিন নাচ’-এর ওই কুৎসিত অধ্যায় তো চাপাই পড়ে গিয়েছিল।

এবার যেখানে টি-টোয়েন্টি সিরিজ জয়ের পর শ্রীলঙ্কানরা টাইমড আউট উদ্‌যাপন করে বাংলাদেশ দলকে লজ্জা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। ওয়ানডে সিরিজ জয়ের পর ‘ভাঙা’ হেলমেট দেখানোর অভিনয় করে যেটির জবাব দিয়েছেন সেই অনূর্ধ্ব-১৯ পর্যায় থেকে ম্যাথুসের বন্ধু মুশফিকুর রহিম। টেস্ট ক্রিকেট টি-টোয়েন্টি বা ওয়ানডের মতো অমন উত্তেজনার ফুলকি ছড়ায় না। এখানে অফুরন্ত সময়, তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে খেলা চলে দুলকি চালে। বাজবল যতই সব বদলে দেওয়ার চেষ্টা করুক, অন্তর্গত একটা শান্তি আছেই টেস্ট ক্রিকেটের চরিত্রে। তারপরও এই দুই দল খোঁচাখুঁচিটাকে এমন ছেলেমানুষির পর্যায়ে নামিয়ে এনেছে যে টেস্ট সিরিজেও অমন কিছু দেখা যাওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। শ্রীলঙ্কান অধিনায়ক ধনাঞ্জয়া ডি সিলভা তো তেমন কিছুর প্রতিশ্রুতি দিয়েই রেখেছেন!