ইতিহাস গড়তে কেমন লাগে?
নিগার সুলতানা তা আগেই জেনেছেন। পাঁচ বছর আগে এই বিজয়ের মাসেই। ২০১৯ সালে পোখারায় মালদ্বীপের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টিতে। সেদিন তাঁর ব্যাটে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রথম সেঞ্চুরি পেয়েছিল বাংলাদেশের নারী ক্রিকেট। ৬৫ বলে খেলেছিলেন ১১৩ রানের ইনিংস।
সেঞ্চুরি তো সেঞ্চুরিই, তবু টেস্ট কিংবা প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে সেঞ্চুরিকে স্বয়ং ক্রিকেটাররাই কিন্তু একটু অন্য চোখে দেখেন। কারণ হয়তো একজন ক্রিকেটার কতটা ভালো—সেটা বড় দৈর্ঘ্যের ম্যাচেই বোঝা যায়। ধৈর্য, ভোগান্তি, সহ্য, সহনশীলতা, পাল্টা আক্রমণ—এসব মানবীয় গুণের ক্রিকেটীয় পরীক্ষায় পাস করেই আসলে তিন অঙ্কের একটি ইনিংস বের করে আনতে হয়। তবে নিগার আজ যা অর্জন করেছেন, সেটির তাৎপর্য বোঝাতে আরও একটি বিষয়ও টানতে হয়।
ক্রিকেটীয় সামর্থ্য বিচারে সেটাও অনেক গুরুত্বপূর্ণ। গত এক মাসে শুধু টি-টোয়েন্টিই খেলেছে বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দল। আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজ। আর গত অক্টোবর থেকে হিসাব করলে মেয়েদের জাতীয় দলের খেলা ১০ ম্যাচের ৭টিই ছিল টি-টোয়েন্টি। বাকি তিনটি ওয়ানডে। এই সংক্ষিপ্ত সংস্করণ থেকে খুব অল্প সময়ের মধ্যে তিন দিনের ম্যাচে নেমে ব্যাটিংয়ের মেজাজ পাল্টে দুই-আড়াই শ বল খেলা চাট্টিখানি কথা নয়!
নিগার তাই আজ রাজশাহীর শহীদ কামারুজ্জামান স্টেডিয়ামে বিসিএলের তৃতীয় দিনে এমন একটি ইনিংস খেলে নিশ্চয়ই তেমন পরিতৃপ্তিই পেয়েছেন, যেটা টি-টোয়েন্টির ইনিংসটিতে পাননি?
এই প্রশ্ন তাঁকে যেহেতু করা হয়নি, তাই প্রতিক্রিয়াটাও সরাসরি জানা যায়নি। কিন্তু আপনি আন্দাজ করে নিতেই পারেন, আগেরটি হোক না আন্তর্জাতিক, তবু প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে আজকের সেঞ্চুরি তাঁর তৃপ্তির খাতায় আগেরটি থেকে মোটেও পিছিয়ে থাকবে না। কোথায় ৬৫ বলের ইনিংস (টি-টোয়েন্টির ১১৩), আর কোথায় ২৫৩ বলের ইনিংস!
ওভারের হিসাবে একটি ১০.৫ ওভার ব্যাপ্তির ইনিংস। আরেকটি ৪২.১ ওভার ব্যাপ্তির ইনিংস—ওয়ানডে ম্যাচে একটি ইনিংসের প্রায় কাছাকাছি সময় নিয়ে ব্যাট করতে হয়েছে নিগারকে। হোক না মেয়েদের ক্রিকেটে এবারের বিসিএল প্রথমবারের মতো প্রথম শ্রেণির টুর্নামেন্ট, প্রতিপক্ষও হোক না যতই দুর্বল—তবু শুধু শারীরিক সামর্থ্য বিচারেই এই ইনিংস ‘গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড।’ যেটা শেষ পর্যন্ত থেমেছে অপরাজিত ১৫৩ রানের প্রথম ইতিহাসে।
প্রথম ইতিহাস নিয়ে প্রশ্ন নিশ্চয়ই উঠবে না। সেই ইতিহাস নিশ্চয়ই এতক্ষণে আপনার জানা। নিগারের এই ইনিংস বাংলাদেশের মেয়েদের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে প্রথম সেঞ্চুরি। ২৫৩ বলের ইনিংসে যে সেঞ্চুরিটি এসেছে ২১৫ বলে। ধরুন আজ থেকে ১০০ বছর পরও নিগারের এই ইনিংসটি স্মরণ করতে বাধ্য থাকবে মেয়েদের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট, কিংবা তারপরও যতটা সময় গড়াবে, এ ইনিংসের তাৎপর্যও তত বাড়বে। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট যেহেতু একজন ক্রিকেটারের বড় খেলোয়াড় হয়ে ওঠার ভিত, সেটা দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটের জন্যও। তাই অনেক বছর পর হয়তো এমন কথাও উঠবে, নিগার ওই সেঞ্চুরিটি করেছিলেন বলেনই আজ...। মোটেও বাগাড়ম্বর নয়। ছেলেদের প্রথম শ্রেণিতে আল শাহরিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরিকে এখনো ওভাবেই বিচার করা হয়। তাই নিগারের গড়া আজকের ইতিহাসের তাৎপর্যই অন্য রকম।
কিন্তু যাঁকে নিয়ে এত কথা—তাঁর অর্থাৎ নিগারের কেমন লেগেছে? উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে আজ ম্যাচটি ড্র হওয়ার পর সাদা পোশাকে বাংলাদেশ নারী দল ও মধ্যাঞ্চলের এই অধিনায়ক যখন ক্যামেরার সামনে দাঁড়ালেন, তাঁর মুখে হাসি লেগে ছিল। অনুভূতিটা জানালেন এভাবে, ‘আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহর কাছে লাখো লাখো শুকরিয়া। বড় একটা মাইলফলক। প্রথমবারের মতো তিন দিনের ম্যাচে সেঞ্চুরি করা, আমি আমার প্রসেসের মধ্যে ছিলাম, সেটা ফলাতে পেরে আমি খুশি।’
৮৫ রানে গতকাল অপরাজিত থেকে মাঠ ছাড়ার পর রাতে কি ঠিকমতো ঘুমাতে পেরেছিলেন নিগার? ঘুমের ঘোরের তো বারবার ইতিহাস টোকা দিয়ে যাওয়ার কথা! কিন্তু নিগারের কথায় তেমন কিছুই মনে হলো না। আজকের জন্য খুব পরিষ্কার পরিকল্পনা ছিল তাঁর, ‘(কাল) মাঠ ছাড়ার সময় জানতে পারি ৮৫ রান করেছি। অনেকে বলছিল সম্ভব। আমিও ভাবলাম এটা সম্ভব, যদি আরেকটু ধৈর্য নিয়ে ব্যাটিং করতে পারি। আজ সকাল থেকে তাই নিজের স্বাভাবিক ক্রিকেটটাই খেলার চেষ্টা ছিল।’
লম্বা ইনিংসটি খেলার পেছনে প্রস্তুতির গল্পও শোনালেন নিগার। যেটা শুনলে অবাক হয়ে ভাবতে পারেন, শুধু বাকিদের দেখে প্রেরণা নিয়েই এমন ইনিংস খেলা সম্ভব! শুনুন নিগারের মুখেই, ‘প্রথম ইনিংসে (উত্তরাঞ্চলের) পিংকি আপা যেভাবে ব্যাট করছিলেন, অনেক সময় নিয়ে ধৈর্য নিয়ে (২৪৬ বলে ৮৬), ব্যাটিং দেখে মনে হচ্ছিল এভাবে আসলে ক্রিকেটটা খেলতে হয়। আমার তো একদমই অভিজ্ঞতা ছিল না। ওদের ব্যাটিং দেখেও অনেকটা প্রেরণা পেয়েছি।’
বোলারদের প্রশংসা করতে গিয়ে নিগার টেনেছেন টি-টোয়েন্টি থেকে তিন দিনের ম্যাচে মানিয়ে নেওয়ার বিষয়টি। অনেক ওভার বোলিং করতে হয়েছে। তেমনি ব্যাটিংয়ের মেজাজও পাল্টাতে হয়েছে। টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেকের জন্যও এবারের বিসিএলকে খুব গুরুত্বপূর্ণ বললেন নিগার, ‘খুব অল্প সময়ে এটার প্রস্তুতি নেওয়া, আমরা আসলে ভাবিনি। বিসিবিকে তাই ধন্যবাদ এই সময়কে এত সুন্দরভাবে কাজে লাগানোর জন্য। শুধু ন্যাশনাল ক্রিকেটার না, বাকি যে ক্রিকেটাররা আছে, তাদের জন্যও সুযোগ তৈরি করে দেওয়া হলো।’