জাকের আলীই তো ম্যান অব দ্য ট্যুর

ম্যাচসেরার পুরস্কার দেওয়া হয়। সিরিজসেরাও দেওয়া হয়। কিন্তু দ্বিপক্ষীয় সিরিজে কি সফরে সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার দেওয়া হয়? না। ক্রিকেটে ওসবের চল নেই। থাকলে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে ম্যান অব দ্য টুর, এর পুরস্কারটি জাকের আলীকেই দিতে হতো।

সেন্ট ভিনসেন্টে আজ জাকের কী করেছেন, তা আপনি জানেন। তৃতীয় টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের ১৮৯ রানের ৩৮.০৯ শতাংশ (৭২) রান জাকেরের। সেটাও ওভারসংখ্যায় মাত্র ৬.৫ ওভার (৪১ বল) ব্যাট করে। তবে ব্যাটিংটা যেভাবে করেছেন সেটা বোঝানোর সাধ্য নেই পরিসংখ্যানের।

জাকেরের ব্যাটিংকে বুঝতে পরিস্থিতি আসে সবার আগে। গোটা সফরে তিন সংস্করণ মিলিয়ে আটটি ম্যাচের হরেক রকম পরিস্থিতিই দাবি করছে, বাংলাদেশ দল দেশে ফেরার আগেই এই সফরের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কারের ট্রফিটা যেন বানিয়ে রাখা হয়। ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে জাকেরের হাতে শুধু একটি ম্যাচসেরার ট্রফি একদমই বেমানান।

এই সফরে টেস্ট সিরিজ ১-১ ড্র করেছে বাংলাদেশ। ওয়ানডে সিরিজে ৩-০–তে হয়েছে ধবলধোলাই। টি-টোয়েন্টি সিরিজে সেটাই ফেরত দিয়েছেন ওয়েস্ট ইন্ডিজকে। স্বাভাবিকভাবেই ভালো খেলেছেন আরও অনেকেই। জাকেরকে ছাড়িয়েও গেছেন বেশ কয়েকজন। কিন্তু পরিস্থিতি বুঝে ধারাবাহিকতা যদি হয় শর্ত, তাহলে অনানুষ্ঠানিক সেই ম্যান অব দ্য ট্যুরের পুরস্কারটি জাকেরের হাতেই ওঠে।

ম্যান অব দ্য ট্যুর নয়, জাকের নিচ্ছেন টি–টোয়েন্টি সিরিজের শেষ ম্যাচে সেরা ক্রিকেটারের পুরস্কার

সম্ভবত ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরের স্কোয়াডে জাকেরের অন্তর্ভুক্তি নিয়ে সে সময় প্রশ্ন তোলা জনতাই ট্রফিটি তাঁর হাতে তুলে দিতে চাইবেন। জাকেরের কারণেই যে তাঁদের কখনো হয়েছে মুখরক্ষা, আবার কখনো উঁচু হয়েছে মাথা। সমীকরণটিও এখন আসছে সেই মাথা থেকেই। দ্বিপক্ষীয় সিরিজে আইসিসি ম্যান অব দ্য ট্যুরের পুরস্কার চালু করলে মহাভারত এমন কী অশুদ্ধ হয়!

বরং শ্বেত-শুভ্র কিংবা রঙিন ক্রিকেট আরেকটু শুদ্ধ শুদ্ধ, আরেকটু রঙিন রঙিন লাগত। অ্যান্টিগায় প্রথম টেস্টে ২০১ রানে হারল বাংলাদেশ। দলের প্রথম ইনিংসে জাকেরের ব্যাট থেকে এল সর্বোচ্চ ৮৯ বলে ৫৩। পরের ফিফটিহীন দ্বিতীয় ইনিংসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৫৮ বলে ৩১। জাকের এ দুটি ইনিংস না খেললে বাংলাদেশের মুখ কিংবা মানরক্ষা হতো কি না, সেটা স্কোরবোর্ডে দেখে নিতে পারেন।

জ্যামাইকার স্যাবাইনা পার্ক রীতিমতো মহাকাব্যিক। বাংলাদেশের ১০১ রানে জয়ের সেই টেস্টে কারও কারও চোখে জয়ের নায়ক (ম্যাচসেরা) ওয়েস্ট ইন্ডিজের দ্বিতীয় ইনিংসে ৫ উইকেট নেওয়া তাইজুল ইসলাম নয়।

বরং বাংলাদেশের দ্বিতীয় ইনিংসে বাংলাদেশেরই টেস্ট ইতিহাসে অন্যতম সেরা ইনিংস খেলা জাকের; ১০৬ বলে ৯১ রানের সেই ইনিংসে অনূদিত হয়েছিল বিপদে বরফশীতল মাথা থেকে সুযোগ পেয়ে আগুনের লেলিহান শিখা হয়ে সবকিছু পুড়িয়ে ছাই করা! ইনিংসটির মাহাত্ম্য এমনই যে জাকের এরপর এই সফরে আর রান না পেলেও কেউ হয়তো তাঁকে নিয়ে প্রশ্ন তুলতেন না।

বাংলাদেশের ১০১ রানে জয়ের সেই টেস্টে ৯১ রান করেন জাকের

কিন্তু এই ক্যারিবিয়ান মাটিতেই বিশ্বকাপে ভালো করতে না পেরে সমালোচনায় দগ্ধ হওয়ায় জাকের এই সফর নিয়ে ভেবে রেখেছিলেন অন্য কিছু। কোমর বেঁধে প্রস্তুতি সেরে রেখেছিলেন। ওয়ানডে সিরিজেও তাই পেলেন রানের দেখা। প্রথম ম্যাচে জাকেরের ৪০ বলে ৪৮ বাংলাদেশকে এনে দিয়েছিল ৩০০ ছুঁই ছুঁই স্কোর। ক্রিকেটের ল অব অ্যাভারেজ জাকেরকে দ্বিতীয় ম্যাচে রান পেতে দেয়নি। কিন্তু তৃতীয় ম্যাচেই আবার স্বরূপে। বাংলাদেশের ৩২১–এ জাকেরের ৫৭ বলে অপরাজিত ৬২।

বাংলাদেশ তিনটি ম্যাচ হারলেও এই সিরিজে সফরকারীদের তৃতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক (৩ ম্যাচে ১১৩, ফিফটি একটি) ছিলেন জাকের। ওহ, বলাই হয়নি, টেস্ট সিরিজে দুই দল মিলিয়ে সর্বোচ্চ রানটা আবার তাঁর (২ ম্যাচে ১৭৬)। কিন্তু টেস্টে সিরিজসেরা হলেন তাসকিন। জাকের-সমর্থক হিসেবে আপনি দুঃখ পেতেই পারেন। কিন্তু এসব নিয়ে সম্ভবত জাকের ঘুণাক্ষরেও ভাবেননি। জাকের যে সত্যিকারের টিমম্যান, সেটা অনূদিত হয় তাঁর ব্যাটিংয়েই।

নইলে প্রথম টি-টোয়েন্টিতে ৫.৪ ওভারে ৩ উইকেটে দল যখন ৩৩, তখন নেমে শুধু দলের বিপদ এড়াতে ২৭ বলে ২৭ করতেন না। সেটাও আবার দলের ইনিংসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টিতে ২০ বলে ২১ রানও দলের প্রয়োজনে।

আজ ৭২ রানের দারুণ ইনিংস খেলেছেন জাকের

আর আজ তৃতীয় টি-টোয়েন্টিতে জাকের যেটা করলেন, সেটা যেন বাংলাদেশের নতুন ধাঁচের টি-টোয়েন্টি ব্যাটিংয়েরই দ্বার উদ্‌ঘাটন করল! শেষ ওভারে একাই তুলেছেন ২৫। মেরে স্টেডিয়াম পার করলেন দুবার। শেষ ৫ ওভারে বাংলাদেশের তোলা ৭৫ রানে জাকেরের একারই ৫৪।

গোটা সিরিজে দলের জন্য বিভিন্ন পরিস্থিতিতে নিজেকে নিংড়ে দিয়ে অবশেষে এই ম্যাচে খোঁজ মিলল আসল জাকেরের। যে জাকের অফ স্টাম্পে একটু সরে স্টান্স নিয়ে অনেকটাই বলেকয়ে বিশাল ছক্কা হাঁকাতে পারেন, যে জাকেরকে দেখে সীমানার দড়িতে লেপ্টে থাকতে চান ফিল্ডারেরাও।

ওহ, ভালো কথা। জাকের কিন্তু এই টি-টোয়েন্টি সিরিজেও সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক। কিন্তু সিরিজসেরা মেহেদী হাসান, এই যা!