চায়ের দোকান এক অদ্ভুত জায়গা। সেখানে ইহজাগতিক থেকে পরলৌকিক—যাবতীয় সব সমস্যার মৌখিক সমাধান মেলে। একেকটি চুমুকে উঠে আসে একেক বিষয়। পাশে বসা কেউ আবার পাল্টা চুমুকে তার সমাধান দেন। এভাবেই চলে দিনমান। তো, ঘটনা হলো, গত পরশু তেমনই এক চায়ের দোকানে প্রৌঢ় এক মুরব্বি বলছিলেন, ‘আইচ্ছা, ব্যাটা কও তো, দলের নাম সাকিব, তামিম না বাংলাদেশ?’
আমতা আমতা করে কিছু বলার আগেই মুরব্বি নিজেই বললেন, ‘শোনো ব্যাটা, একখান ঘটনা কই। বয়সকালে আমরাও এই বৈঠ্যাবাড়ি (ক্রিকেট, ব্যাট তো বৈঠার মতোই) খেইলত্যাম। তো, হইলো কি, একবার এক টুর্নামেন্টের আগে দলের পুলাপানের মধ্যি ঝামেলা লাগি গেল! যে কয়জনের মধ্যি বাহাস (বিবাদ) লাগছিল, সে কয়জনের গিরাম (গ্রাম) তাগো পক্ষে খাড়ায় গেল! এই মারে তো এই ধরে! শেষ পর্যন্ত আমাগরে মুরব্বিরা কুনুমতে বুঝশুঝ দিয়্যা খেইলব্যার পাঠাইল। কিন্তু ওই ইস্তকই (পর্যন্তই)। একখান খেলায়ও জিতি নাই! কও তো ব্যাটা, কিসির জন্যি জিতপ্যার পারি নাই?’
আবারও আমতা আমতা করতেই মুরব্বি যেন বুঝে ফেললেন, ওনার যৌবনের কোনো ঘটনার হেতু আমার জানা সম্ভব না। নিজেই বললেন, ‘শোনো বাপু, খেলা নিয়ে পুলাপানের মধ্যি যে সুমস্যাই হউক, টুর্নামেন্টের আগে বাইরের মানুষজন এসব নিয়ে ক্যাচাল করলি, খেলোয়াড়গরে আর বাঁচাইব্যার পাইরবা না! উরা না চালিউ (চাইলেও) মনে মনে এসবে জড়ায় যাবি, ইয়ের পর ফিল্টিত (মাঠে) আন্ডা (ডাক) মারি চলি আসপি! আমাগরেও সিতাই হইছিল। তা বাপু, তুমাগরে সাকিব–তামিম...’—এতটুকু শুনেই উঠে দাঁড়াতে হলো। জিবের তলায় তেতো স্বাদ। কয়েক দিন ধরে বাংলাদেশ দলের বিশ্বকাপযাত্রা চাপা পড়েছে এ দুটি নামে। কেন? তা আবার বয়ান করা আর জাবর কাটা একই ব্যাপার। জানে তো গোটা বাংলাদেশই!
সম্ভবত, এই জানাতেই যত সমস্যা! ভ্রুকুটি জাগবে জানা কথা। কিন্তু তার আগে কিছু প্রশ্নের উত্তর দিন। আচ্ছা, সত্যি করে বলুন তো, বিশ্বকাপে খেলতে যাওয়া দলটার নাম বাংলাদেশ তো? সাকিব আল হাসান কিংবা তামিম ইকবাল নিশ্চয়ই নয়? তাহলে সাকিব–তামিম দ্বন্দ্বে গোটা বাংলাদেশ বিভক্ত হয়ে অন্য সব খেলোয়াড়ের ওপর ক্ষোভ ঝাড়ার কী হেতু?
একটি উদাহরণ দেওয়া যায়। কাল বাংলাদেশ দলের বিশ্বকাপযাত্রার আগে পরশু নিজের অফিশিয়াল ফেসবুক অ্যাকাউন্টে একটি ভিডিও পোস্ট করেন ওপেনার তানজিদ হাসান। মাত্র ৫ ওয়ানডে খেলা এই ২২ বছর বয়সী ওপেনারের এটা প্রথম বিশ্বকাপ। তাঁর রোমাঞ্চের মাত্রাটা অনুমান করাই যায়। সেই রোমাঞ্চ ও আনন্দ থেকেই সম্ভবত পোস্ট করা ভিডিওতে তানজিদ বলেছেন, ‘সবাই কেমন আছেন? আমি তানজিদ হাসান। বিশ্বকাপে দেশের প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পেয়ে আমি খুব রোমাঞ্চিত।’
ভিডিওর মন্তব্যে সমর্থকদের শুভকামনা জানানোর পাশাপাশি বেশ কিছু অন্য রকম মন্তব্যও আছে। এই যেমন ‘পুরোপুরি ফিট না হয়েও তামিম ইকবাল যে পারফরম্যান্স করবে, তার জায়গায় যে খেলবে, সে ফুল ফিট হয়েও ওই রকম পারফরম্যান্স করতে পারবে না’, ‘ডাক মারবা আনে’, ‘কোন বিবেচনায় একে দলে চান্স দিল’, ‘ফাস্ট রাউন্ডে তুমরা বাদ; পাট নিয়ে লাভ নাই ভাই’...। একেবারে নিশ্চিত করে বলা যায়, বাংলাদেশের বিশ্বকাপ দলে সুযোগ পাওয়া বাকি খেলোয়াড়দের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম পেজ কিংবা অ্যাকাউন্টের দশাও আলাদা নয়।
সাকিব–তামিম ইস্যুতে বিভক্ত দেশের সমর্থক সমাজ নিজ নিজ ‘গ্রুপ’ মেইনটেইন করে একের পর এক মন্তব্য–হামলা চালাচ্ছেন। এই যে তানজিদ, তিনি ওপেনার বলেই উল্লেখিত মন্তব্যগুলো তামিমের সমর্থকদের—এই দাবি তুললে সেটি সত্য না মিথ্যা, তার চেয়ে বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়, কেন এমন হয়? তামিম নিজে শুভকামনা জানিয়েছেন বিশ্বকাপে খেলতে যাওয়া বাংলাদেশ দলকে। সেখানে সমর্থকদের এমন আচরণকে ‘মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি’ বলেই মনে হয়। আর উদাহরণটাও একপক্ষীয় নয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সাকিবের সমর্থকেরাও কিন্তু বসে নেই! মানতে পারছেন না নিশ্চয়ই? যুক্তি দিতে পারেন, সমর্থকেরা তো এমনই! পছন্দের খেলোয়াড় নিয়ে যুক্তি হবে, তর্ক হবে, এরপর বুকে বুক মিলিয়ে সবাই দলের খেলা দেখবেন। আর অবশ্যই শুধু যা খুশি তা–ই বলার অধিকার তো শুধুই সমর্থকদের। খেলার ‘প্রাণ’ বলেই এই স্বাধীনতা তাঁদের জন্মগত অধিকার।
কিন্তু গত কয়েক দিনের চালচিত্রে তাকিয়ে এই আদর্শ কথাকে মহামতি প্লেটোর ‘কল্পরাজ্য’ থেকে আমদানি করা বলেই মনে হয়! দোস্তির মোহ কাটিয়ে দুশমন হয়ে দাঁড়ানো দুই তারকাকে নিয়ে কথা হচ্ছে, যুক্তি–তর্কও ছুটছে বর্শার ফলকের মতো, শুধু এসবের ঢাকঢোলে আসল ব্যাপারটাই অনুপস্থিত—দল, বাংলাদেশ দল! সত্যি করে বলুন তো, এই কদিনে সাকিব–তামিমের নাম যতবার উচ্চারিত হয়েছে, সে তুলনায় ‘বাংলাদেশ দল’ কথাটা সমর্থকদের মুখে উঠেছে কতবার? সাকিব–তামিমের মাধ্যমে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সম্ভবত ‘ডাব্বা মারাবিষয়ক আলোচনা’য় ‘বাংলাদেশ দল’ কথাটা দু–একবার উঠে আসতে পারে! তাতেও আপত্তি নেই। রাগ–ক্ষোভ মেটাতে তবু তো দেশের নামটা উচ্চারিত হচ্ছে!
অথচ রাত পোহালেই বিশ্বকাপ শুরু বাংলাদেশের। গুয়াহাটিতে আগামীকাল শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে প্রস্তুতি ম্যাচ খেলবে বাংলাদেশ। সন্দেহ নেই, গতকাল ভারতগামী উড়োজাহাজে ওঠার সঙ্গে বিতর্কগুলোও দেশে রেখে গেছেন ক্রিকেটাররা। মানে পেশাদার দল হিসেবে এটাই প্রত্যাশিত এবং বিশ্বকাপে ফল যা–ই হোক, দল হিসেবেই খেলবে বাংলাদেশ। অমুক ভাই কিংবা তমুক ভাইয়ের দল নয়, বিষয়টি দেশের প্রতিনিধিত্ব করার এবং ‘ঘরে’ যা–ই ঘটুক, সেসব প্রতিনিধি যখন সমর্থকদের জন্য লড়তে বের হন, তখন প্রশংসা না হোক, শুভকামনার আশা করতেই পারেন।
গতকাল বাংলাদেশ দল ভারতের উদ্দেশে উড়াল দেওয়ার আগে বিমানবন্দরে দলীয় ছবি তুলেছে। সে ছবি পোস্ট করা হয় বিসিবির অফিশিয়াল ফেসবুক অ্যাকাউন্টে। সেখানে শুভকামনা ও ‘অন্য রকম’ সব মন্তব্যের অনুপাতে ব্যবধান খুব বেশি নয়। দু–একটি মন্তব্য তুলে ধরা হলো—‘তাড়াতাড়ি শিক্ষা সফর পাস করে বাড়ি ফিরে আসেন’, ‘ইহা একটি সফল বনভোজন হতে যাচ্ছে’, ‘অভিশপ্ত এই টিমের জন্য ধ্বংস অনিবার্য’, ‘প্রতিটা ম্যাচ হারার জন্য অগ্রিম শুভকামনা রইল’, ‘সর্বোচ্চ লজ্জা নিয়ে দেশে যেন ফেরত আসতে পারেন, সেই কামনা রইল’...।
বাংলাদেশের ১৫ জনের স্কোয়াডে ৮ জনের এটা প্রথম বিশ্বকাপ। অর্থাৎ স্কোয়াডের সিংহভাগ খেলোয়াড়েরই এবার বিশ্বকাপে অভিষেক হবে। তাঁদের রোমাঞ্চের মাত্রাটা আন্দাজ করে নেওয়াই যায়। আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের এই যুগে ছোট কাঁধে যত বড় দায়িত্বই থাক, রোমাঞ্চকর সেই অনুভূতির বশবর্তী হয়েই ফেসবুক–টুইটারে চোখ থাকবে খেলোয়াড়দের। ভেবে বলুন তো, আমাদেরই সন্তানেরা যখন আমাদের এসব মন্তব্য দেখবেন, তখন বিশ্বকাপে ভালো করার তাড়নাটা কি কমবে না?
পাল্টা যুক্তি দিতে পারেন, খেলোয়াড়দের কাজ খেলা, ওসব ফেসবুক–টুইটারে সমর্থকদের কথাবার্তায় চোখ রাখবে কেন? বটে! কথাটা শোনায় ভালো, বেশ আদর্শ আদর্শও লাগে! কিন্তু বাস্তবতা হলো, এসব এড়ানো যায় না, এই যুগে তো অসম্ভব। ব্যাপারটা বুঝে নিতে পারেন রোজনামচার জীবন থেকে। মানুষের কথা এড়িয়ে চলা কি সম্ভব? তার মানে এই নয় যে বেহুদা প্রশংসা করতে হবে। হ্যাঁ, বাংলাদেশ দল বিশ্বকাপে খেলতে যাওয়ার আগে তামিম–সাকিবকে নিয়ে অপ্রত্যাশিত কিছু ব্যাপার ঘটেছে এবং তার সমালোচনাও ঠিক আছে। কিন্তু ব্যক্তি ইমেজ আর ইগোর সমর্থনে বা সমালোচনায় যদি দলটাই চাপা পড়ে যায়, তাহলে সেটা কি আর ক্রিকেট থাকে?
ক্রিকেট তো দলীয় খেলা। আর বিশ্বকাপে কিন্তু শুধু সাকিব খেলতে যাচ্ছেন না, বাদ পড়েননি শুধু তামিমই; এসব সমীকরণের ঘাত–প্রতিঘাতে শেষ পর্যন্ত একটি দলই কিন্তু খেলতে যাচ্ছে। আর সেই দলটার নাম বাংলাদেশ—আপনার, আমারই দেশ। সমর্থন দেবেন নাকি পছন্দ–অপছন্দের খেলোয়াড় থাকা বা না থাকায় দেশের মুণ্ডুপাত করবেন সেই সিদ্ধান্ত আপনার।