এবার লম্বা করে একটা শ্বাস নিতেই পারেন মিচেল স্টার্ক।
টানা আট বছর আইপিএলে ছিলেন না। যখন ফিরলেন, রীতিমতো চোখ কপালে উঠল সবার। আইপিএলে রেকর্ড ২৪ কোটি ৭৫ লাখ রুপির খেলোয়াড় বলে কথা! কিন্তু খেলা শুরু হতেই পাল্টে গেল অভাবনীয় অনুভূতির সেই ছবি। রেকর্ড গড়া ‘প্রাইজ ট্যাগ’ই হয়ে উঠল বিশাল বোঝা। ৩৪ বছর বয়সী স্টার্ক কাল রাতে সেই বোঝাটাই সফলতার সঙ্গে নামিয়ে ফেলেছেন।
চেন্নাইয়ে সানরাইজার্স হায়দরাবাদকে হারিয়ে আইপিএলের তৃতীয় শিরোপা জিতেছে কলকাতা নাইট রাইডার্স, যে জয়ে ম্যাচসেরা স্টার্ক! একসময় যে প্রাইজ ট্যাগের কারণে ‘সুপার ফ্লপ মিলিয়নিয়ার’র বদনাম শুরু হয়েছিল, সেটিই এখন ‘সুপারম্যান মিলিয়নিয়ার’। স্টার্ক লম্বা করে শ্বাস করে নিতেই পারেন। আর একঝলকে পেছনে ফিরে চোখ রাখতে পারেন গত দুই মাসে, কী সব ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের রাতই না পার করেছেন!
স্টার্ক আইপিএল ইতিহাসের সবচেয়ে দামি খেলোয়াড়ের ‘প্রাইজ ট্যাগ’ নিয়ে মাঠে নামার পর প্রথম ম্যাচেই ছিলেন সুপার ফ্লপ। হায়দরাবাদের বিপক্ষেই ৪ ওভারে দেন ৫৩ রান, তাঁর টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারে এর চেয়ে বেশি রান দেওয়ার তেতো অভিজ্ঞতাই ছিল মাত্র একবার। ঠিক পরের ম্যাচে চোখেমুখে একই হতাশা। এবার বেঙ্গালুরুর বিপক্ষে ৪৭ রান দিয়ে উইকেটশূন্য। মানে প্রথম দুই ম্যাচে ৮ ওভার বল করে রান খরচ ঠিক ১০০, কিন্তু উইকেটের কলাম শূন্য। ইকোনমি রেটও ছিল ১২ ছুঁই ছুঁই। ঠাট্টা-তামাশার জোয়ার শুরু হয়ে গেল সেখানেই।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নামের পাল্লায় মাপা হতে শুরু করল টাকা আর রান, বল, উইকেট। যেমন চার ম্যাচ শেষে তাঁর উইকেট যখন মাত্র দুটি, তখন হিসাবটা দাঁড়াল এ রকম—স্টার্কের একটি ডেলিভারির মূল্য ২৯ লাখ ৪৬ হাজার রুপি। আর একটি উইকেটের মূল্য ১২ কোটি ৩৭ লাখ ৫০ হাজার রুপি। যদিও স্টার্ককে কলকাতার পুরো মৌসুম পাওয়ার কথা, কিন্তু তখন আর সেসব খেয়াল করে কে!
তবে শুরুর ওই দুঃস্বপ্ন থেকে গা-ঝাড়া দিয়ে উঠতে এরপর আর সময় নেননি স্টার্ক।
বাংলা নববর্ষের দিনে কলকাতার ইডেন গার্ডেনে লক্ষ্ণৌ সুপার জায়ান্টসের বিপক্ষে নেন ২৮ রানে ৩ উইকেট। ধীরে ধীরে কমতে থাকে রান খরচের হারও। স্টার্কের মতো খেলোয়াড়দের দল সবচেয়ে বেশি চায় গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচগুলোয়। স্টার্কও মৌসুমে নিজের সেরা বোলিংটি করেন এমনই এক ম্যাচে—ওয়াংখেড়েতে মুম্বাই ইন্ডিয়ানসের বিপক্ষে। সেদিন নিজের শেষ ওভারে ৩ উইকেটসহ ৩৩ রানে ৪ উইকেট শিকার করেন স্টার্ক। সেদিনই এক যুগ পর ওয়াংখেড়েতে প্রথম জয় পায় কলকাতা নাইট রাইডার্স।
৩৪ বছর বয়সী স্টার্ক লিগ পর্ব শেষে হয়ে ওঠেন আরও উজ্জ্বল। যে হায়দরাবাদের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচেই ৫৩ রান খরচ করেছিলেন, প্রথম কোয়ালিফায়ারে সেই দলের বিপক্ষেই নেন ৩৪ রানে ৩ উইকেট। এর মধ্যে ট্রাভিস হেডকে শূন্য রানে বোল্ড করে দেওয়াটা ছিল বিশেষ মাহাত্মের । পুরো আসরে এদিনই প্রথমবারের মতো ম্যাচসেরা হন স্টার্ক।
রোববার চেন্নাইয়ের ফাইনালে আবারও প্রতিপক্ষ হায়দরাবাদ। এবার স্টার্ক আরও শাণিত। ম্যাচের প্রথম ওভারেই অভিষেক শর্মাকে বোল্ড করেন দুর্দান্ত এক ডেলিভারিতে, যা ফাইনালের সেরা বল তো বটেই, পুরো আসরেরই সেরা ডেলিভারির তালিকায় প্রথম দিকে থাকবে। আগে ব্যাট করা হায়দরাবাদকে যে মাত্র ১১৩ রানে আটকে দেয় কলকাতা, তাতে মূল সুরটা বেঁধে দেয় স্টার্কের প্রথম ওভারই। পরে নেন রাহুল ত্রিপাঠির উইকেটও।
সব মিলিয়ে ৩ ওভারে ১৪ রান দিয়ে ২ উইকেট—আবারও ম্যাচসেরা স্টার্ক। যে ম্যাচ শুধু ম্যাচই নয়, শিরোপা নির্ধারণীও। আইপিএলের ইতিহাসে এর আগে কখনোই কোনো খেলোয়াড় প্লে–অফে একাধিকবার ম্যাচসেরা হননি। প্রথম চার ম্যাচে মাত্র ২ উইকেট নেওয়া স্টার্ক মৌসুম শেষ করেছেন ১৪ ম্যাচে ১৭ উইকেট নিয়ে।
শেষ দিকে জ্বলে ওঠা স্টার্কের এমন বোলিংয়ের প্রভাব যে কেমন ছিল, তাঁর কিছুটা ফুটে উঠেছে হায়দরাবাদ অধিনায়ক ও স্টার্কের অস্ট্রেলিয়া দলের সতীর্থ প্যাট কামিন্সের মুখে, ‘কলকাতা দুর্দান্ত বোলিং করেছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেই পুরোনো বন্ধু স্টার্কই আবারও মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে।’ আর কলকাতা অধিনায়ক শ্রেয়াস আইয়ার তো জাদুর কাঠিই দেখছেন স্টার্কের মধ্যে, ‘বড় খেলোয়াড়েরা এভাবেই দরকারি সময়ে দাঁড়িয়ে যায়। নিজের কর্মনিষ্ঠা নিয়ে কখনোই আত্মতুষ্টিতে ভোগে না। একদম সঠিক উপলক্ষটাতেই স্টার্ক নিজের ভূমিকা রেখেছে। তার মধ্যে সেই জাদুর কাঠিটা আছে।’
এ তো গেল অধিনায়কদের কথা। কিন্তু স্টার্কের নিজের কেমন বোধ হচ্ছে এখন? বিশেষ করে শুরুর দিকের হতাশার কারণে প্রাইজ ট্যাগ যখন বোঝা হয়ে উঠেছিল, দলের প্রত্যাশা পূরণের পর সেসব ঠাট্টা-মশকরা কেমন লাগছে? কাল পুরস্কার বিতরণীতে রবি শাস্ত্রী করেছিলেন এমন প্রশ্ন। স্টার্কের উত্তর, ‘টাকাপয়সা নিয়ে প্রচুর রসিকতা হয়েছে। এবার আমি অনেক দিন পর আইপিএল খেললাম। বয়স বেড়েছে, অভিজ্ঞতাও বেড়েছে। আর এটাই আমাকে প্রত্যাশা পূরণ করতে সাহায্য করেছে। আমি যে আগের চেয়ে অভিজ্ঞ আর বয়স্ক, সেটার কারণে আমি খুশিও।’
খুশি নিশ্চয়ই প্রাইজ ট্যাগের কারণেও। আর যা-ই হোক, ২৪ কোটি ৭৫ লাখ রুপির মূল্য তো প্রমাণ করা গেছে!