হাওয়াই মিঠাইয়ের দিন বদলেছে। এখন হাওয়াই মিঠাই বিক্রি হয় কাঠিতে পেঁচিয়ে, পলিথিনে মুড়িয়ে। এক কাঠি হাওয়াই মিঠাইয়ের দাম ২০–৩০ টাকা। আমাদের ছোটবেলায় এ রকম ছিল না। কুমিল্লায় আমাদের জিলা স্কুলের সামনে হাওয়াই মিঠাইয়ের একটা রিকশা–ভ্যান থাকত। ভ্যানে লোহার আংটায় ঝোলানো থাকত ছোট ছোট সাদা কাগজের অনেকগুলো স্লিপ।
আমরা দুই টাকা দিয়ে একটা স্লিপ কিনতাম। তারপর সেটি ভ্যানে রাখা ভেজা কাঠের টুকরায় চেপে ধরলে ভেসে উঠত একটা সংখ্যা। ২, ৩ বা ৪। যে সংখ্যাটা উঠত, দুই টাকায় আমরা সেই কয়টা হাওয়াই মিঠাই পেতাম। স্লিপগুলোতে সাবান দিয়ে সংখ্যাটা লেখা থাকত। কাগজে সংখ্যাটা থাকত, কিন্তু দেখা যেত না।
অক্ষরেখা, দ্রাঘিমারেখার কথা নিশ্চয়ই জানেন। ভূগোলে পড়েছি, অক্ষরেখা হলো পৃথিবীর কেন্দ্র দিয়ে পূর্ব–পশ্চিমে কল্পিত রেখা। দ্রাঘিমারেখাও কল্পিত, এই রেখাগুলো পৃথিবীকে বেষ্টন করে আছে উত্তর–দক্ষিণে। অর্থাৎ, পৃথিবী আছে মানে পৃথিবীকে বিভিন্ন জলবায়ু অঞ্চলে ভাগ করতে অক্ষরেখা এবং দ্রাঘিমারেখাও আছে বলে ধরে নিতে হবে। আছে, কিন্তু এগুলোও দেখা যায় না।
সম্প্রতি আমরা আরও একটা রেখা আবিষ্কার করলাম, যেটা আছে, কিন্তু দেখা যায় না। আলোচিত সে রেখার নাম সাকিব–তামিম বিভেদরেখা। বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসানের এক সাক্ষাৎকার প্রকাশ্যে জানিয়ে দিয়েছে, জাতীয় দলের দুই মহাতারকার মধ্যে কথা বলার সম্পর্কও নেই। মাঠে ১১ জনের দুজন হলেও ব্যক্তিগত জীবনে তাঁরা আসলে দুই মেরুর বাসিন্দা। তাঁদের মাঝখানে চলে গেছে অক্ষ–দ্রাঘিমার মতো একটা রেখা। সে রেখা কতটা গভীর, তা সাবান দিয়ে লেখা আছে হাওয়াই মিঠাইয়ের ওই সাদা কাগজে। পানিতে ভেজালেই যা ফুটে উঠবে।
সাকিব–তামিমে বিভেদ থাকলেও সেটি দেখা না যাওয়ার কারণ, মাঠের বাইরে যে রকমই হোন, তাঁরা মাঠে এক। নিজেদের মধ্যে সেখানেও কোনো বিভেদ ছায়া ফেলে কি না, তা সাকিব–তামিমই ভালো জানবেন। তবে আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, বাংলাদেশ দলের প্রতিনিধিত্ব করতে গিয়ে তাঁরা এসব মাথায় আনেন না।
পারস্পরিক সম্পর্কে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ থাকতেই পারে। কিন্তু যতক্ষণ না কেউ অভিযোগ নিয়ে কারও কাছে নালিশ জানাচ্ছেন, তার বিচারই বা করার দরকার কী, তা জানারই বা দরকার কী! হ্যাঁ, আমরা এমন আশা করতেই পারি যে তাঁদের বিবাদ একদিন মিটে যাবে এবং সেটা তাঁরাই মেটাবেন।
তার আগে এই যে মনোমালিন্যটা প্রকাশ্য হয়ে গেল, এর সুস্পষ্ট কারণ না জেনেই ক্রিকেট সমর্থকেরা দুই গোলার্ধে বিভক্ত হয়ে এক দল সাকিবের পক্ষ নিলেন, আরেক দল তামিমের, তাতে আসলে কী লাভ হলো? এর কী প্রতিক্রিয়া পড়তে পারে সাকিব–তামিমের ওপর? তাঁরা কি জনতার চাপে বিভেদ ভুলে এক হয়ে যাবেন, নাকি মাঠের বাইরে একজন আরেকজন থেকে মুখ ফিরিয়েই থাকবেন?
সাকিব, তামিম দুজনই চাপে না–ভাঙা মানুষ। মাঠ এবং মাঠের বাইরে চাপ, তাপ সামলেই তাঁরা আজ এ জায়গায়। কাজেই এই আশা করার পক্ষে জোরালো কোনো কারণ নেই যে শুধু বিভেদটা জানাজানি হয়ে গেছে এবং এ নিয়ে আলোচনা–সমালোচনার মধ্যে পড়ে গেছেন বলেই তাঁরা আবার নিজেদের মধ্যে কথা বলা শুরু করে দেবেন। অন্যের কথায় নিজেদের অবস্থান বদলানোর বয়স তাঁদের নেই। তাঁরা কথা বলা শুরু করতে পারেন তখনই, যখন তাঁদের নিজেদের মধ্যে সেই বোঝাপড়াটা তৈরি হবে।
অবশ্য তার আগে বিষয়টা প্রকাশ্যে চলে আসাটা তাঁদের মধ্যে বাড়তি অস্বস্তি তৈরি করতে পারে। গত এক–দেড় বছরে বাংলাদেশ দলের আবহে যে ব্যাপারটা মোটামুটি স্বাভাবিক হয়ে এসেছিল, সেটিতে এখন একটা আলোড়ন উঠল এবং তা–ও ইংল্যান্ডের মতো দলের বিপক্ষে সিরিজের ঠিক আগে। মাঠে, ড্রেসিংরুমে দুজন মুখোমুখি হলে এখন নিশ্চয়ই আরেকটা নতুন পরিস্থিতি তৈরি হবে, যেটি স্বাভাবিকতা পেতেও কিছুটা সময় লাগবে।
বড় সমস্যা হবে দলের অন্যদের। সিরিজের চক্র শুরু হয়ে গেছে বলে পুরো দল এখন একসঙ্গে আছে। সেখানে খেলার বাইরে অবচেতনে হলেও তাঁদের চিন্তায় বিষয়টা উঁকি দেবেই। এ নিয়ে সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের আলোচনায় সবার চোখ যাবে। আড়চোখে তাঁরা তাকাবেন দুই অধিনায়কের আচরণের দিকে, যদি সেখানে কোনো পরিবর্তন দেখা যায়! দলের মধ্যে সাকিব–তামিমকে ঘিরে সত্যিই পক্ষ–বিপক্ষ থেকে থাকলে, বিভিন্নমুখী আলোচনায় সেটি আরও মাথাচাড়া দিয়ে উঠলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
এ ঘটনা সাকিব–তামিমকে এরই মধ্যে সংবাদমাধ্যমের বাড়তি আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু করে তুলেছে। সেটি কতটা, তা কাল মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামেই দেখা গেছে। সকালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরে দুপুরেই অনুশীলনে যোগ দিয়েছেন সাকিব। কিন্তু মিরপুরে তাঁর এই আসাটা যেন অনুশীলন করতে নয়, ‘আড়ি’ ভেঙে তামিমের সঙ্গে কথা বলা শুরু করতে! সবাই তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন শুধু এই দুজনের দিকে। যদি তাঁরা কথা বলেন!
বড়ই শিশুসুলভ আশা, বিশেষ করে মানুষ দুজন যখন সাকিব ও তামিম। তাঁদের ব্যক্তিগত বিষয় প্রকাশ হয়ে পড়ায় বড়জোর বাংলাদেশের ক্রিকেটে একটি নেতিবাচক আলোচনাই বাড়বে। সঙ্গে যোগ হতে পারে দুজনের কথা না বলা নিয়ে মসলামিশ্রিত অনেক জল্পনাকল্পনা। যে বিভেদের রেখা এত দিন শুধু সাকিব–তামিমই দেখে এসেছেন, এখন যে সেটি হাওয়াই মিঠাইয়ের সাদা স্লিপের লেখার মতোই স্পষ্ট চেহারায় ফুটে উঠেছে!