মিরপুরের গ্যালারিতে আয়ারল্যান্ড অধিনায়ক বলবার্নির বাবা–মা
মিরপুরের গ্যালারিতে আয়ারল্যান্ড অধিনায়ক বলবার্নির বাবা–মা

মাঠে ছেলে দেশের অধিনায়ক, গ্যালারিতে বাবা ‘ফুলটাইম’ ক্রিকেট-দর্শক

তাইজুল ইসলামের বলে অ্যান্ডি ম্যাকব্রাইনের শটটা ডিপ মিড উইকেট বাউন্ডারি পেরোনোর আগেই গ্যালারির চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে গেলেন অ্যাশলি বলবার্নি। হাতে বাইনোকুলার ঠেকিয়ে শেরেবাংলা জাতীয় স্টেডিয়ামের পুরোনো ধাঁচের ম্যানুয়াল স্কোরকার্ডে চোখ রাখছিলেন একটু আগে। স্কোরকার্ডে ছয় রান যুক্ত হয়েছে এবার। হাততালি দিতে দিতে বলবার্নি বলে উঠলেন, ‘নট টু মেনি অফ দোজ টুডে!’ সেটির আগে তখন পর্যন্ত একটি ছক্কাই ছিল আয়ারল্যান্ড ইনিংসে।

পাশে বসা বলবার্নির স্ত্রী ক্যান্ডিকে কোনো কারণে ঠিক উচ্ছ্বসিত মনে হচ্ছিল না ততটা। হাতপাখাটা ক্রমাগত নাড়িয়ে যাচ্ছেন, হয়তো মাঠে আইরিশদের খুব একটা সুবিধাজনক অবস্থান নয়, এর সঙ্গে প্রচণ্ড গরমও ভদ্র মহিলার ওই অভিব্যক্তির কারণ। অ্যাশলি অবশ্য গল্প করছিলেন ভালোই।

ম্যাকব্রাইনের ওই ছক্কা আটকাতে গিয়ে চোট পেয়ে মাঠের বাইরে চলে গেলেন তামিম ইকবাল। কে চোট পেয়েছেন, শুরুতে খেয়াল করেননি বলবার্নি। জিজ্ঞাসা করে নিশ্চিত হওয়ার পর বলে উঠলেন, ‘ওহ, তামিম ইকবাল!’

আয়ারল্যান্ডকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন অ্যান্ড্রু বলবার্নি

অ্যাশলি বলবার্নি কাজ করতেন ‘আইরিশ সোসাইটি ফর প্রিভেনশন অব ক্রুয়েলটি টু চিলড্রেন’ নামের একটি সংস্থায়। ২০০৮ সালে আইরিশ টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন তাঁর কাছে ‘পারফেক্ট হ্যাপিনেস’-এর সংজ্ঞা ‘পেমব্রোক ক্রিকেট ক্লাবের দেয়ালে সূর্যস্নান, আমি আমার কোনো এক ছেলের খেলা দেখছি, একপাশে ক্যান্ডি, আরেক পাশে ঠান্ডা বিয়ার।’

অ্যাশলির পাশে স্ত্রী ক্যান্ডি আছেন, আরেক পাশে অবশ্য বিয়ার থাকার উপায় নেই। জায়গাটাও ডাবলিনের পেমব্রোক ক্রিকেট ক্লাব নয়, এখানে চৈত্রের সূর্যের তাপ দিনের এ সময়ে উপভোগ্য নয় মোটেও। এমন আবহাওয়ায় চেহারাটা লাল হয়ে উঠেছে আরও। তবে তাঁর সুখের আরেকটি কারণ ঠিকই আছে, কোনো এক ছেলে মাঠে খেলছেন!

যখন কথা হচ্ছিল, তখন অবশ্য তাঁর ছেলে মাঠে ছিলেন না ঠিক। আয়ারল্যান্ড অধিনায়ক অ্যান্ডি বলবার্নি অ্যাশলি বলবার্নির বড় ছেলে, প্রথম ইনিংসে আউট হয়ে গেছেন আগেই। যখনই থিতু হচ্ছেন বলে মনে হচ্ছিল, তাইজুল ইসলামকে সুইপ করতে গিয়ে ডেকে এনেছেন নিজের বিপদ। ‘তারা তো ভালো বোলার, ক্রমাগত আক্রমণ করে যাবে। আপনার সত্যিই অনেক ধৈর্য ধরতে হবে’, যেন ছেলের প্রতি একটা বার্তাই দিলেন বাবা।

মিরপুর টেস্টের প্রথম ইনিংসে ১৬ রান করেছেন বলবার্নি

বলবার্নি অবসরে গেছেন চার-পাঁচ বছর আগেই। এখন তাঁর ও তাঁর স্ত্রীর মূল কাজ ক্রিকেট দেখে বেড়ানো। বলবার্নির ভাষায়, তিনি ‘ফুল টাইম’ ক্রিকেট-দর্শক। অবসর নেওয়ার পর থেকেই এমন ‘কাজ’ বেছে নেওয়ার ইচ্ছা ছিল তাঁর, ‘করোনাভাইরাস আসার ঠিক আগ দিয়ে অবসরে গেলাম। পরিকল্পনা ছিল বিশ্বজুড়ে ক্রিকেট দেখে বেড়াব। কোভিড তো সব বন্ধ করে দিল। এখন পুষিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছি।’

অস্ট্রেলিয়ায় গত বছর স্মরণীয় এক টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ কাটিয়েছিল আয়ারল্যান্ড। বলবার্নিরা দেখেছেন প্রতিটি ম্যাচই। এখন পর্যন্ত আয়ারল্যান্ডের চারটি টেস্টই মাঠে বসে দেখার অভিজ্ঞতা হলো তাঁর। ছেলে বলবার্নিও আগের তিনটি টেস্টই খেলেছেন, এবার প্রথমবারের মতো টেস্টে আয়ারল্যান্ডকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

আমরা বেশির ভাগ ম্যাচেই থাকার চেষ্টা করি। সব ম্যাচে তো পারি না। টেস্ট তো বিশেষ কিছুই। বিশেষ করে আয়ারল্যান্ডে, যখন তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে টেস্ট খেলা হয়নি
অ্যাশলি বলবার্নি, আইরিশ অধিনায়কের বাবা

গ্যালারিতে বাবা-মায়ের উপস্থিতিও অ্যান্ড্রু বলবার্নির জন্য নিয়মিত দৃশ্যই, জানালেন তাঁর বাবা, ‘আমরা বেশির ভাগ ম্যাচেই থাকার চেষ্টা করি। সব ম্যাচে তো পারি না। টেস্ট তো বিশেষ কিছুই। বিশেষ করে আয়ারল্যান্ডে, যখন তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে টেস্ট খেলা হয়নি।’

মিরপুর টেস্ট দেখতে গতকাল ভোরে ডাবলিন থেকে দোহা হয়ে ঢাকা এসে পৌঁছেছেন। তার ওপর গ্যালারিতে তাঁদের উপস্থিতির খবর ছড়িয়ে পড়ার পর একাধিক সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে হয়েছে। ‘সাক্ষাৎকার’ দিতে দিতে ক্লান্ত কি না, এমন প্রশ্ন করা হলে হাসতেই হাসতেই বললেন, ‘না, আসলে এমনিতেই ক্লান্ত।’

তাইজুলের বলে এলবিডব্লু হয়েছেন বলবার্নি

এমন গরমের সঙ্গে মানিয়ে নিতে যে কষ্ট হচ্ছে, ফুটে উঠল তাঁর কথাতেই, ‘আমরা তো অভ্যস্ত না। আমাদের ছেলেরা নিশ্চিতভাবেই ভুগবে এমন তাপমাত্রায়। বিশেষ করে হেলমেট পরা থাকলে। সিলেটে বৃষ্টি ছিল শুনেছি। তবে এখানেই বোধ হয় সবচেয়ে বেশি গরম।’

মিরপুর টেস্ট দেখা শেষ করে সরাসরি শ্রীলঙ্কা যাবেন অ্যাশলি বলবার্নি। সেখানে এ মাসেই আরও দুটি টেস্ট খেলবে আয়ারল্যান্ড। সেখানেও পাশে তাঁর স্ত্রী থাকবেন, মাঠে খেলবেন তাঁর ছেলে অ্যান্ড্রু। পাশে বিয়ার থাকুক বা না থাকুক, সূর্যের উত্তাপ ডাবলিনের মতো উপভোগ্য হোক বা না হোক, ক্রিকেটটা যে অ্যাশলি বলবার্নি উপভোগ করবেন—এ নিয়ে খুব একটা সংশয় নেই।