খারাপ পারফরম্যান্সের পর বাংলাদেশ দলের সমালোচকদের সমালোচনার ধরনটাকেই ভুল মনে হচ্ছে নির্বাচক রাজ্জাকের।
বাংলাদেশ দলের সাবেক এক ব্যাটসম্যান একবার বলেছিলেন, টেলিভিশনে সরাসরি দেখানো খেলাগুলোতে নাকি তিনি চাপে পড়ে যান। সারা দুনিয়ার মানুষ টিভিতে তাঁর খেলা দেখছে, ব্যাটিং করতে গিয়ে এটা যখন মাথায় আসে, তখন তাঁর সব গুলিয়ে যায়। পা নড়ে না, ব্যাট চলে না।
শুনে থ হয়ে গিয়েও আধো আধো বচনে বলেছিলাম, ‘তাহলে তো তোমার আন্তর্জাতিক ক্রিকেটই খেলা ঠিক হচ্ছে না! কারণ, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সব ম্যাচ টিভিতে সরাসরি দেখায়।’
এখন দিন বদলেছে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট তো বটেই, পৃথিবীর কোনাকাঞ্চিতে হওয়া ৫-১০ ওভারের খেলাও লাইভ হয়। সেসব ক্রিকেটে আবার ছেলে-বুড়ো সবাই খেলেন। সারা দুনিয়া দেখে। তাতে কেউ কোথাও চাপে পড়ে গিয়েছেন বলে শোনা যায়নি।
তবে কলম্বোর টিম হোটেল গ্র্যান্ড সিনামোনে কাল বিসিবির নির্বাচক আবদুর রাজ্জাকের কথা শুনে মনে হলো, হারিয়ে যাওয়া সেই দিন বোধ হয় আবার অন্য ফরম্যাটে ফিরে আসছে। কেউ ফেসবুকে কী বলল, ইউটিউবে কী দেখাল এবং মূলধারার সংবাদমাধ্যমের সমালোচনায় তো বটেই, ক্রিকেটারদের জন্য সব সমালোচনাই ভালো খেলার পথে একেকটা বাধার দেয়াল, চাপের পাহাড়। এই চাপ তাঁরা নিতে পারছেন না বলেই মাঠে কাত হয়ে পড়ছেন। দাসুন শানাকার মৃদুমন্দ বাউন্সারে পুল খেলতে গিয়ে ব্যাট চালাতে ভুলে যান মোহাম্মদ নাঈম।
আমি বলছি না মিডিয়া কিছু বলবে না। অবশ্যই বলবে। তবে সেটা একটা সীমারেখার মধ্যে থাকলে বাংলাদেশের জন্য ভালো, খেলার জন্য ভালো।আবদুর রাজ্জাক, নির্বাচক বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড
দুঃখিত, কারও নাম এভাবে নির্দিষ্ট করে বলা বোধ হয় ঠিক হলো না। কারণ, সেদিন সাকিব আল হাসান বলেছেন, কারও একটা আউটকে আলাদা করে দেখার দরকার নেই। কাল রাজ্জাকও বলতে চাইলেন, শুধু শুধুই মানুষ নাঈমের পেছনে পড়েছে। নাঈম ভালো খেলছেন, জাতীয় দলে আসার যোগ্যতা আছে বলেই এসেছেন। খামাখা সমালোচনা করে তাঁক চাপে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। রাজ্জাকের কথা থেকেই উদ্ধৃত করা যাক, ‘একটা ছেলেকে শুধু শুধু এ রকম করা...খারাপ খেলা মানে তো এটা নয়! শুনেছি, ওকে নিয়ে যা–তা বলা হচ্ছে। কিন্তু ও তো তাকে জাতীয় দলে না নেওয়ার মতো কিছু করেনি। জাতীয় দলে আসার মতো কাজই করেছে, যে কারণে ওকে দলে নেওয়া হয়েছে।’ তবে নাঈম যে প্রত্যাশা মেটাতে পারছেন না, সেটি রাজ্জাকও লুকাতে পারেননি, ‘হয়তো আমরা যে রকম আশা করছি বা ও যে রকম আশা করছে, এই মুহূর্তে সে রকম হচ্ছে না। তার মানে এই নয় যে ওকে ছুড়ে ফেলা হবে, ওর ওপর চাপ তৈরি করা হবে।’
এশিয়া কাপের দল, যেটা রাজ্জাকের চোখে ‘বেস্ট কম্বিনেশন’, নির্বাচক কমিটি নিশ্চয়ই একটা পরিকল্পনা মাথায় রেখেই এই দল করেছিলেন। রাজ্জাক মেনে নিচ্ছেন, দল তাঁদের সেই পরিকল্পনা মতো কাজ করতে পারেনি। তবে এটাকে আবার তিনি খুব নেতিবাচকভাবেও দেখেন না। কারণ, খেলতে গিয়ে কিছু ভুল তো হতেই পারে। আর যেকোনো টুর্নামেন্টে সবাই-ই চ্যাম্পিয়ন হতে চায়। হয় তো শেষ পর্যন্ত একটা দলই!
বাংলাদেশ দলের পারফরম্যান্স নিয়ে যে সমালোচনা, সেটার সঙ্গে অবশ্য চ্যাম্পিয়ন হওয়া না–হওয়ার কোনো সংযোগ নেই। বাংলাদেশের সমালোচকেরাও এখনো অত দূর পৌঁছাতে পারেননি যে বাংলাদেশ কেন চ্যাম্পিয়ন হলো না, তা নিয়ে সমালোচনামুখর হওয়ার সুযোগ পাবেন। এমনকি বাংলাদেশ কেন পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কাকে হারাতে পারল না, তা নিয়ে আক্ষেপ থাকলেও সমালোচনার বিষয়বস্তু কিন্তু সেগুলোও নয়।
আসলে একটা দল নিয়ে আপনি কতটুকু সমালোচনা করবেন, সেই সীমাও কিন্তু ওই দলই ঠিক করে দেয়। এবারের এশিয়া কাপে যেমন সমালোচনার বিষয় দুই ম্যাচে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের ২০০–ও করতে না পারা, আর কথা প্রসঙ্গে নাঈমের বিষয়ে তো বলেই ফেলা হলো। এর বাইরে আর খুব বেশি কিছু নিয়ে কি কেউ কিছু বলেছে?
যা–ই হোক, রাজ্জাক মনে করছেন, এসব সমালোচনাও না বুঝেই করা, ‘সমালোচনা থাকবে। আপনারা (সংবাদমাধ্যম) তো সমালোচনার জন্যই আছেন। সমালোচনা তো করবেনই। তবে বুঝলে সমালোচনা করার কথা নয়। আর না বুঝে করলে খুব একটা কিছু বলার নেই।’
সব মিলিয়ে বাংলাদেশের সমালোচকদের সমালোচনার ধরনটাকেই ভুল মনে হচ্ছে রাজ্জাকের। ক্রিকেটাররা একটু খারাপ খেললেই কেন ‘এত বেশি’ নেতিবাচক আলোচনা হতে থাকে, সেটাও দুর্বোধ্য তাঁর কাছে, ‘এক ম্যাচে খারাপ হলেই যেন বাংলাদেশ দল কোনো দিন কিছু করেনি! এ রকম কেন হয় জানি না।’
রাজ্জাক অবশ্য দাবি করলেন, তিনি সমালোচনার বিরোধী নন, তবে চান সমালোচনা হোক সীমিত পরিসরে, ‘আমি বলছি না মিডিয়া কিছু বলবে না। অবশ্যই বলবে। তবে সেটা একটা সীমারেখার মধ্যে থাকলে বাংলাদেশের জন্য ভালো, খেলার জন্য ভালো।’
তার মানে বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের চাপমুক্ত থেকে ভালো খেলার স্বার্থে নীরবতাই কাম্য। সঙ্গে সব মহল থেকে ক্রিকেটারদের উৎসাহ দিয়ে যেতে হবে। ভালো খেললে তো বটেই, ভালো না খেললেও তাঁদের চাপ থেকে বের করতে উৎসাহের বিকল্প নেই ভাবতে হবে।
একটা কথা অবশ্য রাজ্জাক ঠিকই বলেছেন। দলে কাদের থাকা উচিত, একাদশে কারা খেলবেন, কে কত নম্বরে ব্যাটিং করবেন, নতুন বলটা কার হাতে উঠবে—এসব নিয়ে কথা বাংলাদেশের বাইরে কোনো দেশেই এত বেশি হয় না। যদিও এই সংস্কৃতির বাইরে নয় বাংলাদেশের ক্রিকেটের ‘সূতিকাগার’ বিসিবিও। বোর্ডের বড় কর্তাদের সামনে খালি একটা সূত্র ধরিয়ে দিন। দেখবেন একাদশ, ব্যাটিং অর্ডার, বোলিং পরিবর্তন নিয়ে এমন এমন সব তথ্য বেরিয়ে আসবে; যেটা অন্য দেশের সাংবাদিকেরা এক হাজার এক রাত্রি পার করেও পাবেন না।
এ নিয়ে রাজ্জাকের কথাটাকে সর্বজনীনভাবে সবার জন্য প্রযোজ্য ধরে নিলে অবশ্য শুনতে খারাপ লাগবে না তা, ‘একমাত্র আমাদের দেশেই ওপেনিংয়ে কে খেলবে, সাতে কে খেলবে, আটে কে খেলবে, দশে কে খেলবে—সবার সে চিন্তা। পৃথিবীর কোথাও আমি এটা দেখিনি। দলের যখন যেখানে যাকে দরকার হবে, তখন সে সেখানে খেলবে। এখানে বাইরে থেকে বলার কিছু নেই। এটার কারণেও খেলোয়াড়েরা চাপে থাকে।’
কাজেই নীরব থাকুন। নীরবতাতেই মিলবে চাপমুক্তির পথ।