বোলিংয়ে ব্রেক থ্রু, ব্যাটিংয়ে চার-ছক্কা, লেগ স্পিনার রিশাদ হোসেনের শ্রীলঙ্কা সিরিজের সর্বশেষ অভিজ্ঞতা এমনই। পরশু চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজের নির্ধারণী ম্যাচে তাইজুল ইসলামের জায়গায় সুযোগ হয় ২১ বছর বয়সী রিশাদের। আর রিশাদের জন্য সুযোগ জিনিসটা বিরল। ঘরোয়া ক্রিকেটে তাঁর খেলার সুযোগ আসে কালেভদ্রে। জাতীয় দলেও তিনি নিয়মিত নন, বিশেষ করে ওয়ানডে ক্রিকেটে।
সেই রিশাদই পরশু দিনটাকে নিজের করে নিলেন অলরাউন্ড পারফরম্যান্সে। বোলিংয়ে ৫১ রান দিয়ে প্রতিপক্ষ দলের অধিনায়ক কুশল মেন্ডিসের উইকেট নিয়েছেন। এরপর ব্যাটিংয়ে নেমে যা করলেন, তা স্মরণীয় হয়ে থাকবে অনেক দিন। দলের জয়ের জন্য যখন দরকার ৫৮ রান, তখন তাঁর ব্যাট থেকে আসে ১৮ বলে ৪৮ রানের অবিশ্বাস্য এক ইনিংস। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজের শেষ ম্যাচেও বাংলাদেশকে প্রায় জিতিয়েই ফেলেছিলেন রিশাদ। কিন্তু সেদিন ৩০ বলে ৫৩ রানের বিস্ফোরক ইনিংসের পরও বাংলাদেশ হেরেছে ২৮ রানে।
ব্যাট হাতে এই দুই ইনিংসের সঙ্গে বোলিংয়ে ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি সিরিজের ৪ ইনিংসে ৪ উইকেট নেওয়া রিশাদ এখন বাংলাদেশ ক্রিকেটের সবচেয়ে আলোচিত নাম। নীলফামারীর এই তরুণ অবশ্য কয়েক বছর ধরেই জাতীয় দলের নেটে নিয়মিত। লেগ স্পিনার বলেই জাতীয় দলের নেটে তাঁর চাহিদা ছিল। প্রতিপক্ষ দলের লেগ স্পিন খেলার প্রস্তুতিটা রিশাদের বোলিং খেলেই নিতেন মুশফিক-সাকিবরা।
শুধু জাতীয় দল নয়, হাই পারফরম্যান্স দল, ‘এ’ দল, টাইগার্স—বিসিবি তাদের প্রতিটি প্রোগ্রামে রেখে রিশাদকে দিয়েছে নিজেকে গড়ে তোলার সুযোগ। ঘরোয়া ক্রিকেটের দলগুলোর লেগ স্পিনবিমুখ মানসিকতা তাঁকে কখনোই প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট, লিস্ট ‘এ’ ও বিপিএলে নিয়মিত হতে দেয়নি।
২০১৮ সালে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষিক্ত রিশাদ এখন পর্যন্ত দীর্ঘ পরিসরের ক্রিকেটে ম্যাচ খেলেছেন মাত্র ১৯টি, লিস্ট ‘এ’ ৩টি এবং ঘরোয়া টি-টোয়েন্টি ১৮টি। এর বাইরে থাকে শুধু বিসিবির বয়সভিত্তিক দল, হাই পারফরম্যান্স প্রোগ্রাম, টাইগার্স ও ‘এ’ দলের খেলা। রিশাদকে এসব প্রোগ্রামে রেখেই একটু একটু করে গড়ে তোলা হয়, ২০২৩ সালে এসে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি অভিষেক হয় রিশাদের, একই বছর নিউজিল্যান্ড সফরে পেয়ে যান ওয়ানডে ক্যাপ। এরপর থেকেই বাংলাদেশ দলে তিনি নিয়মিত মুখ।
তা রিশাদ জাতীয় পর্যায়ে এলেন কীভাবে? বাঁহাতি স্পিন–সংস্কৃতির বাংলাদেশে শীর্ষ পর্যায়ে লেগ স্পিনার হিসেবে জায়গা করে নেওয়া নিশ্চয়ই সহজ ছিল না। নীলফামারী জেলা শহর থেকে ৪ কিলোমিটার দূরে নিজপাড়া এলাকার ছেলে রিশাদকে সে কঠিন পথটাই পাড়ি দিতে হয়েছে। তবে পেশাদার ক্রিকেটার হওয়ার নেশা রিশাদের কঠিন পথটা পাড়ি দিতে সাহায্য করেছে।
রিশাদের ক্রিকেটার হিসেবে পথচলার শুরুটা হয় জেলা শহরের ছমিরউদ্দিন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ক্রিকেট টুর্নামেন্ট থেকে। সেই টুর্নামেন্টে ধারাবাহিকভাবে ভালো করার পর ক্রিকেটের নেশা পেয়ে বসে রিশাদকে। তখন থেকে নীলফামারীর নজরুল স্মৃতি একাডেমির হয়ে জেলার শেখ কামাল স্টেডিয়ামে অনুশীলন শুরু করেন।
২০১৭ সালে একাডেমির কোচদের পরামর্শে রিশাদ রবি স্পিনার হান্টে যোগ দেন। সেখানে জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে নির্বাচিত হয়ে রিশাদ চলে আসেন জাতীয় পর্যায়ে। সেখানেও বিচারকদের পছন্দের তালিকায় জায়গা করে জিতে নেন সেরা ‘অ্যাকুরেসি’ স্পিনারের পুরস্কার।
সেই প্রতিযোগিতার জয়ী স্পিনারদের নিয়ে বিসিবি দুটি ক্যাম্প করেছিল। সেখান থেকে রিশাদের জায়গা হয় বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৭ দলে। রিশাদকে এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। তিনি ২০২০ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপজয়ী দলের প্রাথমিক দলেও ছিলেন। তবে মূল দলে জায়গা না হলেও বিসিবি রিশাদকে হাই পারফরম্যান্স প্রোগ্রামে রেখে অনুশীলন ও ম্যাচের মধ্যে রাখার সুযোগ করে দেয়। এর পরের গল্পটা সবারই জানা।
তবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে রিশাদের পথচলা মাত্র শুরু। তাঁর মধ্যে ব্যাটিং প্রতিভার ছাপ আগে থেকেই ছিল। দীর্ঘদেহী হওয়ায় লেগ স্পিনেও বাউন্সটা তাঁর সহজাত। তবে বলের ওপর নিয়ন্ত্রণ, গতির বৈচিত্র্য, ম্যাচের অবস্থা বুঝে বল করার যে দক্ষতা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দরকার, তাতে উন্নতি করার জায়গা আছে রিশাদের।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেট মানেই প্রতিপক্ষের অ্যানালিস্টের সঙ্গে চোর-পুলিশ খেলা। যত সময় যাবে তত পথটা কঠিন হবে। এই পর্যায়ে ধারাবাহিকভাবে ভালো করতে হলে নিজের শক্তিকে আরও শাণিত করতে হবে, দুর্বলতাকেও কমিয়ে আনতে হবে। যদি উন্নতির পথ ধরে এগোতে থাকেন, তাহলে রিশাদ হয়ে উঠবেন সাদা বলের ক্রিকেটে বাংলাদেশ দলের ‘রত্ন’।