বাংলাদেশের ক্রিকেটে এই মুহূর্তে সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন সম্ভবত ‘এরপর কে?’। কানপুর টেস্টের আগে সাকিব আল হাসান অবসরের ঘোষণা দিলেন টেস্ট আর টি-টোয়েন্টি থেকে। সেই ভারত সিরিজেই মাহমুদউল্লাহ জানালেন, এরপর আর খেলবেন না আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি।
নাজমুল হোসেনেরটা সেই অর্থে আনুষ্ঠানিক কোনো ঘোষণা নয়, অবসরের ব্যাপার তো নয়ই। তবে সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী নাজমুল বিসিবিকে জানিয়েছেন, তিনি আর কোনো সংস্করণেই জাতীয় দলের অধিনায়কত্ব করতে চান না।
বিষয়টি যদিও এখনো মীমাংসিত নয়, সম্ভাবনা আছে নাজমুলের তাঁর অবস্থান থেকে সরে আসারও, কিন্তু এ ধরনের খবর ছড়িয়ে পড়া মানেই কোনো না কোনোভাবে সম্পূরক প্রশ্ন—এরপর কে? সেটা যিনি বিদায় বললেন তাঁর বিকল্প কে অর্থে তো বটেই, এরপর কে আবার ‘বিদায়’ বলেন, সেই অর্থেও।
এ ক্ষেত্রেও তা–ই হলো। বিষয়টি নিয়ে নাজমুল-বিসিবি আনুষ্ঠানিক আলোচনার আগেই পাখা মেলল ‘এরপর কে’র আলোচনা। আজ তো দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামের দ্বিতীয় টেস্টপূর্ব সংবাদ সম্মেলনে আরেক কাঠি এগিয়ে তাইজুল ইসলামকে এ রকম প্রশ্নও করা হলো—টেস্টের অধিনায়কত্ব দিলে তিনি তা নিতে প্রস্তুত কি না?
তাইজুলও বাউন্ডারি হাঁকানোর মতোই উত্তর দিলেন, ‘যেহেতু ১০ বছর ধরে খেলেছি, তো পুরোটাই তৈরি।’ তবে তিনি বলেছেন, নাজমুলের অধিনায়কত্ব না করা নিয়ে দলীয় পরিমণ্ডলে কোনো আলোচনা নেই। এ বিষয়ে কিছু তিনি নিজেও জানেন না।
মজার ব্যাপার হলো, সংবাদ সম্মেলন শুরুর কিছুক্ষণ আগেও সংবাদ সম্মেলন কক্ষের আলোচনায় তাইজুলের উপস্থিতি মোটেও ভবিষ্যৎ অধিনায়কের মতো ছিল না। টেস্ট ম্যাচ শুরুর আগের দিন তাইজুলকে কেন সংবাদ সম্মেলনে আনা হচ্ছে, সেটা নিয়ে বরং একটা বিরক্তিমাখা আলোচনাই চলছিল তখন। আর অধিনায়কত্ব ছাড়ার আলোচনা বাতাসে ভাসতে থাকার কারণে সংবাদ সম্মেলনে নাজমুলই বেশি প্রত্যাশিত ছিলেন। আবার একই কারণে বিতর্ক এড়াতে তাঁর না আসাটাও অস্বাভাবিক নয়।
একটা ম্যাচের আগের দিনের আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে সাধারণত অধিনায়কই আসেন। অথবা কোচ, কখনো কখনো কোচ অধিনায়ক দুজনই। হ্যাঁ, অনেক সময় কোচ, অধিনায়ক বাদ দিয়ে দলের সিনিয়র কোনো ক্রিকেটারও আসতে পারেন।তাইজুলকে অনায়াসেই সে কাতারে ফেলে দেওয়া যায় এবং এভাবে ভাবলে তাঁর সংবাদ সম্মেলনে আসাটাও গ্রহণযোগ্যতা পায়। কিন্তু কেউ যেন এটা মেনে নিতে রাজিই নন যে একজন সিনিয়র ক্রিকেটার হিসেবেও তাইজুল হতে পারেন দলের প্রতিনিধি, ১০ বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলে ফেলার পর তাঁকে শুধু একজন অভিজ্ঞ বাঁহাতি স্পিনার হিসেবে বিবেচনা করাটা ঠিক নয়।
আসলে সাধারণ্যে তাইজুলকে নিয়ে সেই সেন্টিমেন্টটাই তৈরি হয়নি। সাকিব আল হাসানের পর এখন তিনিই টেস্টে বাংলাদেশের হয়ে সবচেয়ে বেশি উইকেটের মালিক, অনেক ম্যাচেই বল হাতে উজ্জ্বল তাঁর পারফরম্যান্স। তবু বাংলাদেশের ক্রিকেটে ‘তাইজুল ইসলাম’ নামটা খুব বড় কোনো তারকার প্রতিবিম্ব হয়ে উঠতে পারেনি।
এর অন্যতম কারণ, বাঁহাতি স্পিনার হওয়ায় ক্যারিয়ারজুড়ে তিনি ঢাকা পড়ে থেকেছেন সাকিবের ছায়ায়। এ নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে চলতি সিরিজের মিরপুর টেস্টে তাইজুল অনেক প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন, তাঁর দিক থেকে অনেক কিছু পরিষ্কারও করেছেন।
কিন্তু তাইজুলের ক্যারিয়ার যে সাকিবের ছায়ায় ঢাকা পড়ে থাকল, সেটা তো বাইরের মানুষের চোখে। এত বছর খেলে ফেলার পর একজন জ্যেষ্ঠ খেলোয়াড় হিসেবে দলের ভেতরে তো তাঁর একটা অবস্থান তৈরি হওয়ারই কথা। আর সেটি দিয়ে দলে তাঁর ইতিবাচক ভূমিকা রাখার এটাই আদর্শ সময়। কারণ, তাইজুলের চেয়ে ঠিক এক ধাপ অভিজ্ঞ ক্রিকেটাররা সবাই এখন বিদায়ের মিছিলে। সে হিসেবে তাইজুলের কাছে এটা জানতে চাওয়া মোটেও অস্বাভাবিক নয় যে তিনি একটা সংস্করণের অধিনায়কত্ব নিতে প্রস্তুত কি না।
এই আলোচনার ঠিক আগের আলোচনাটাই অবশ্য ওটা—একজন জ্যেষ্ঠ ক্রিকেটার হিসেবে ড্রেসিংরুমে বা মাঠে তিনি কতটা প্রভাববিস্তারী ভূমিকা রাখতে পারছেন? হ্যাঁ, বল হাতে তাইজুল তা দারুণভাবেই পারছেন, কিন্তু সেটি তো বাঁহাতি স্পিনার তাইজুলের সাফল্য হলো। অভিজ্ঞতার কারণে প্রয়োজনে মাঠে হয়তো তাঁর পরামর্শও নেন অধিনায়কেরা, তাইজুলও নিশ্চয়ই সময়োপযোগী পরামর্শ দিতে পারেন। কিন্তু এত বছর খেলে তিনি দলের নিউক্লিয়াসের অংশ হতে পেরেছেন কি না, এতে ঠিক সে প্রশ্নের উত্তরটা মেলে না।
আজ তাইজুলের কাছেই জানতে চাওয়া হয়েছিল বিষয়টা নিয়ে। জবাবে তিনি যা বললেন, কিছু অব্যক্ত বক্তব্যও যেন মিশে থাকল তাতে, ‘আমি অবশ্যই ভূমিকা রাখতে পারি। তবে আমার কাছ থেকে আপনি কতটুকু নিচ্ছেন, তা গুরুত্বপূর্ণ। সেটা একজন সতীর্থ হিসেবে বা দেশের জনগণই হোক।’
মূল প্রশ্নটা এখানেই। অধিনায়কত্বের প্রসঙ্গটা না হয় বাদই দিন। একজন অভিজ্ঞ ক্রিকেটার হিসেবে মাঠের বাইরেও বাংলাদেশ দলকে অনেক কিছুই দিতে প্রস্তুত তাইজুল, কিন্তু তারকার পূজারি বাংলাদেশের ক্রিকেট কি তা নিতে প্রস্তুত?