বাংলাদেশ অধিনায়ক সাকিব আল হাসান
বাংলাদেশ অধিনায়ক সাকিব আল হাসান

সাকিব, কে লেখেন আপনার চিত্রনাট্য

সেমিফাইনালের স্বপ্ন দূর দিগন্তে মিলিয়ে যাওয়ার দিন থেকেই এই বিশ্বকাপ বাংলাদেশের জন্য ৯ পর্বের এক সিরিজ নাটক। এখন যা শেষের অপেক্ষায়। ১১ নভেম্বর শেষ পর্বটা মঞ্চস্থ হবে পুনেতে। অথচ নায়কই কিনা নেই!
সাকিবকে ঘিরে নাটকীয় ২৪ ঘণ্টার কাহিনিতে কী একটা মোচড়! সাকিব আল হাসানের জীবনটাই এমন। ইংরেজিতে বললে বোঝাতে সুবিধা হয়—নেভার আ ডাল মোমেন্ট।

সেই কবে থেকে হবে, হচ্ছে করেও সাকিবের বায়োপিক হয়নি এখনো। একদিন নিশ্চয়ই হবে। সেই বায়োপিকের চিত্রনাট্যকারকে ভালো একটা সমস্যাতেই পড়তে হবে। সমস্যাটা অন্য অর্থে।

নামী অনেক ক্রীড়াবিদই আছেন, যাঁদের মাঠের জীবন বর্ণাঢ্য, কিন্তু মাঠের বাইরের ব্যক্তিজীবন নিরামিষ। মানে অনেকটাই সরলরৈখিক। নাটকীয়তা নেই, বড় কোনো বিতর্ক নেই। তাঁদের বায়োপিককে সিনেমাটিক করতে অনেক মসলা যোগ করতে হয়। যেখানে সাকিবের ক্ষেত্রে চিত্রনাট্যকারকে পড়তে হবে ‘কোনটা বাদ দিয়ে কোনটা রাখি’ সমস্যায়।

সাকিবের জীবন মানেই তো ঘটনার ঘনঘটা। সেই জীবন চলে নিজের নিয়মে। কে কী বলল, কে কী ভাবল—তাতে থোড়াই কেয়ার। উদাহরণ তো অগণ্য। সব বলতে গেলে এই লেখা শেষ করাই কঠিন হয়ে যাবে। দরকারই–বা কী! কোন জিনিসটা আপনার অজানা! বাংলাদেশের আর কোনো তারকার জীবন নিয়ে এমন নিত্য কাটাছেঁড়া হয় না। আর কেউই বলতে গেলে প্রতিদিনই এভাবে খবরে থাকেন না। সেই খবর আবার বেশির ভাগ সময় তিনি নিজেই তৈরি করে দেন।

ভাঙা আঙুল নিয়েই শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ব্যাট করেছেন সাকিব

আগের বিশ্বকাপে অভূতপূর্ব এক অলরাউন্ড পারফরম্যান্সে ছিলেন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। এই বিশ্বকাপে একেবারেই বিবর্ণ। কোনো আলোচনাতেই নেই। সেই সাকিবই এখন ভারত বিশ্বকাপের সবচেয়ে আলোচিত চরিত্র। এমন এক কাণ্ড করে বসেছেন, যা নিয়ে উত্তাল পুরো ক্রিকেট–বিশ্ব। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ভেঙে পড়ার মতো অবস্থা!

টাইমড আউট বিতর্ক চলতে চলতেই আবার নতুন করে খবরে। আঙুল ভেঙে সাকিবের বিশ্বকাপই শেষ। এটাই শেষ বিশ্বকাপ—এ কথা শুনলেই সাকিব হাসি দিয়ে বলেন, ‘কীভাবে জানলেন? আমার তো মনে হয়, আমি ২০৩১ বিশ্বকাপেও খেলব।’ নিশ্চয়ই রসিকতা। ২০৩১ তো অনেক দূরে, ২০২৭ বিশ্বকাপেও সাকিবকে ঠিক কল্পনা করা যাচ্ছে না। কল্পনাতীত এই ঘটনাই যদি ঘটে না যায়, গত পরশু দিল্লির অরুণ জেটলি স্টেডিয়ামই ওয়ানডে বিশ্বকাপে শেষবারের মতো দেখল সাকিবকে।

সাকিবের শেষ ম্যাচ হিসেবে এর চেয়ে আদর্শ আর কী হতে পারত! কেন এ কথা বলছি? সাকিব মানে যে সাদার পাশেই কালো, সাকিব মানে যে এই নায়ক তো পরমুহূর্তেই প্রতিনায়ক—এই ম্যাচের সাকিবও তো ঠিক তা-ই। অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুসকে টাইমড আউট করে দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ১৪৬ বছরের ইতিহাসে নতুন একটা অধ্যায় যোগ করে ফেলেছেন। তা ক্রিকেটীয় চেতনার পরিপন্থী কি না, এই তর্ক এখনই শেষ হওয়ার নয়। আরও অনেক দিন তা চলবে এবং চলতেই থাকবে। সেই ম্যাচেই আবার দলকে জিতিয়ে ম্যান অব দ্য ম্যাচ। সাকিব আল হাসান তো এমনই।

১৪৬ বছরের ইতিহাসটা সংবাদ সম্মেলনেই হয়তো প্রথম জেনেছেন। যা শুনেই সাকিব মৃদু হেসে বললেন, ‘ক্রিয়েটিং হিস্ট্রি’। আসলেই তো তা-ই। ক্রিকেট খেলাটা যত দিন থাকবে, তত দিনই কখনো না কখনো ফিরে ফিরে আসবে এ ঘটনা। সঙ্গে সাকিব আল হাসানও।

নাজমুল হোসেনের সঙ্গে ম্যাচ জেতানো জুটি গড়েছিলেন সাকিব

তা বিপুল প্রভাবসমেতই। ক্রিকেট একটু হলেও বদলে যাবে। ব্যাটসম্যানরা দুই মিনিটের ওই নিয়ম সম্পর্কে অনেক বেশি সচেতন হবেন। ফিল্ডিং দলের অধিনায়কেরও মাথায় থাকবে এত দিন সব সময় সেভাবে খেয়াল না করা এই দুই মিনিট। টাইমড আউট নিয়ে শুচিবায়ুগ্রস্ততার ইতি ঘটে আগামী দিনে হয়তো আরও হবে এমন আউট। হলেই ফিরে আসবেন সাকিব আল হাসান। আর কখনো যদি না হয়, তাহলে তো এক এবং অনন্য হয়েই থেকে যাবেন।

মাঠের সাকিব আল হাসানের ঠিক-বেঠিক নিয়ে তর্ক চলতে থাকুক। তবে সংবাদ সম্মেলনের সাকিবকে নিয়ে কোনো তর্কের অবকাশ নেই। সম্ভাবনা জাগিয়েও ব্যাটিংয়ে সেঞ্চুরি পাননি। সংবাদ সম্মেলনে শুধু সেঞ্চুরি নয়, গ্লেন ম্যাক্সওয়েলের আগেই মনে হয় এই বিশ্বকাপের প্রথম ‘ডাবল সেঞ্চুরি’ করে ফেলেছেন। নিজে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ভালো-মন্দ যেটাই বলুন না কেন, সেটি নিতে সাহস লাগে। আরও সাহস লাগে সংবাদ সম্মেলনে ওভাবে বলতে।

এই ম্যাচে জয়টা এমন জরুরি না হলে সেই অনূর্ধ্ব-১৯ জীবন থেকে পরিচিত ম্যাথুসের সঙ্গে অমন করতেন কি না, নিজেই তা বলতে পারছেন না। জয়টা এমন করেই চেয়েছিলেন যে ম্যাচটাকে মনে হচ্ছিল যুদ্ধ। নইলে কি আর ভাঙা আঙুল নিয়ে অতক্ষণ ব্যাটিং করতে পারেন!

ইনিংসের শুরুর দিকেই আঙুলে লেগেছিল চামিরার বল। খট করে একটা আওয়াজ শুনেই বুঝেছিলেন, বিশ্বকাপ এখানেই শেষ। এখানেই শেষ মানে, এই ম্যাচের পর শেষ! সরে যাওয়া হাড়টা নিজেই জায়গামতো বসিয়ে নিয়েছেন। উইকেটে তাঁর সঙ্গী নাজমুলকেও কিছু বলেননি। তাঁর শুশ্রূষা করতে যাওয়া ফিজিওকেও না।

এটা তো ক্রিকেট ম্যাচ না, এটা যুদ্ধ। আহত সেনাপতি কি সেই যুদ্ধ থেকে পালিয়ে যাবেন নাকি! সাকিবের বায়োপিকে এই ম্যাচটাও থাকতেই হবে। চিত্রনাট্যকারের ঝামেলা দেখি আরও বাড়ল!