ইংল্যান্ডের ক্রিকেট নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ‘দ্য ইনডিপেনডেন্ট কমিশন ফর ইকুইটি ইন ক্রিকেট (আইসিইসি)’
ইংল্যান্ডের ক্রিকেট নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ‘দ্য ইনডিপেনডেন্ট কমিশন ফর ইকুইটি ইন ক্রিকেট (আইসিইসি)’

ক্রিকেট সংস্কৃতিতে পচন, এটা সবার খেলা নয়

বর্ণবাদ, নারী ক্রিকেটারদের যৌন হয়রানি, ধর্মীয় বিদ্বেষ, নারী-পুরুষের বেতন-ভাতায় চূড়ান্ত বৈষম্য—সব মিলিয়ে ইংল্যান্ডের ক্রিকেট সংস্কৃতি পচে গেছে বলে দাবি করা হয়েছে এক প্রতিবেদনে। বহুল প্রতীক্ষিত প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে ‘দ্য ইনডিপেনডেন্ট কমিশন ফর ইকুইটি ইন ক্রিকেট (আইসিইসি)’।


ইংলিশ ক্রিকেটে জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও লিঙ্গবৈষম্যের ব্যাপারগুলো প্রাতিষ্ঠানিকভাবে খতিয়ে দেখতে ২০২০ সালের নভেম্বরে ইংল্যান্ড অ্যান্ড ওয়েলস ক্রিকেট বোর্ড (ইসিবি) এই কমিশন গঠন করে। ২০২১ সালের মার্চে আমেরিকায় পুলিশ হেফাজতে কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিক জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর পর শুরু হওয়া ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলনের সময় কমিশন আনুষ্ঠানিকভাবে এ বিষয়গুলো নিয়ে তদন্ত শুরু করে। ক্রিকেটার, আম্পায়ার, ক্রিকেট প্রশাসক, সমর্থকসহ মোট চার হাজার ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে ৩১৭ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে আইসিইসি, যার শিরোনাম দেওয়া হয়েছে ‘Holding Up A Mirror To Cricket’।

ব্যাপারটা এমন নয় যে এখানে শুধু কয়েকটি পচা আপেল আছে, বাকি সব ভালো। সবার আগে ক্রিকেটকে এই সত্যের মুখোমুখি হতে হবে। খেলাটির অবকাঠামো ও প্রক্রিয়ার ভেতরেই বৈষম্য আছে এবং সেটা প্রকাশিত
সিন্ডি বাটস

প্রতিবেদনে ৪৪টি সুপারিশ করেছে কমিশন। প্রথম সুপারিশ হচ্ছে নিজেদের ব্যর্থতার জন্য ইসিবির সবার কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে এবং অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে বর্ণবাদ, লিঙ্গবৈষম্য, অভিজাততন্ত্র ও শ্রেণিভিত্তিক বৈষম্য খেলাটিতে ছিল এবং এখনো আছে। এর প্রভাবও বৈষম্যের শিকার ব্যক্তিদের ওপর পড়েছে খুবই বাজেভাবে।

দ্য ইনডিপেনডেন্ট কমিশন ফর ইকুইটি ইন ক্রিকেট (আইসিইসি)-এর সদস্যরা

ইসিবি অবশ্য খুব একটা দেরি করেনি। প্রতিবেদন প্রকাশের পরই ইংল্যান্ড ও ওয়েলস ক্রিকেট বোর্ডের চেয়ারম্যান রিচার্ড থম্পসন এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘ইসিবি ও খেলাটির নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তিদের পক্ষ থেকে আমি তাঁদের কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করছি, যাঁরা কখনো না কখনো ক্রিকেট থেকে ছিটকে পড়েছেন এবং যাঁদের এই অনুভূতি দেওয়া হয়েছে যে ক্রিকেট তাঁদের জন্য নয়। ক্রিকেট সবার খেলা হওয়া উচিত এবং সব সময় তা-ই ছিল। তবে প্রতিবেদনের শক্তিশালী উপসংহারগুলো থেকে বোঝা যায় যে দীর্ঘকাল ধরে এখানে নারী ও কালো মানুষেরা অবহেলিত হয়ে ছিল। আমরা এর জন্য সত্যিই দুঃখিত।’

কমিশনের চেয়ারম্যান সিন্ডি বাটস বলেছেন, ‘ব্যাপারটা এমন নয় যে এখানে শুধু কয়েকটি পচা আপেল আছে, বাকি সব ভালো। সবার আগে ক্রিকেটকে এই সত্যের মুখোমুখি হতে হবে। খেলাটির অবকাঠামো ও প্রক্রিয়ার ভেতরেই বৈষম্য আছে এবং সেটা প্রকাশিত।’

গল্পগুলো এত ভয়ংকর ছিল যে এতে বোঝা যায় ক্রিকেট সংস্কৃতি পচে গেছে। কঠোর বাস্তবতা হচ্ছে ক্রিকেট সবার খেলা নয়
সিন্ডি বাটস

প্রতিবেদন প্রকাশ করতে গিয়ে বাটস বলেছেন, ‘এমন সব ঘটনার কথা আমরা জানতে পেরেছি, যেটা পড়তে গেলে আপনাদের অস্বস্তিকর লাগতে পারে। আমরা শুনেছি, এখানে নারীদের ক্রমাগত গৎবাঁধা অপমান ও হয়রানির শিকার হতে হয়, যৌন হেনস্তা করা হয়। নারীদের সঙ্গে এমন আচরণ করা হয়, যেটা দেখে মনে হতে পারে এটা ১৯২৩ সাল, ২০২৩ নয়।’

উদাহরণ হিসেবে বাটস মুসলিম ক্রিকেটারের জায়নামাজ নিয়ে তারই এক সতীর্থের অশ্লীল রসিকতা করা, নারী ক্রিকেটারদের যৌন বার্তা পাঠানো, ১৩ বছরের কিশোর ক্রিকেটারকে বর্ণবাদী আক্রমণ, এশিয়ান একজন খেলোয়াড়কে তাঁর সতীর্থের ‘সন্ত্রাসী’ বলার মতো কিছু ঘটনা তুলে ধরেছেন। বিবিসিকে বাটস বলেছেন, ‘গল্পগুলো এত ভয়ংকর ছিল যে এতে বোঝা যায় ক্রিকেট সংস্কৃতি পচে গেছে। কঠোর বাস্তবতা হচ্ছে ক্রিকেট সবার খেলা নয়।’

ইয়র্কশায়ারের সাবেক অফ স্পিনার আজিম রফিকের বর্ণবাদের শিকার হওয়ার ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। ইংল্যান্ডের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী ক্লাবের হয়ে খেলার সময় ২০২০ সালে রফিক বর্ণবাদের শিকার হন এবং সেই ঘটনা আদালতেও যায়। রফিক আদালতের কাছে বলেছিলেন, তাঁর বিশ্বাস, জাতিগত ও ধর্মীয় বিদ্বেষের কারণে তাঁর ক্যারিয়ার শেষ হয়ে গেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রফিকের এ ঘটনাটি প্রকাশ্যে আসার আগপর্যন্ত ইসিবি বর্ণবাদ নিয়ে মোটেও সোচ্চার ছিল না।

ইয়র্কশায়ারের সাবেক অফ স্পিনার আজিম রফিক


পুরুষ ক্রিকেটারদের সঙ্গে নারী ক্রিকেটারদের বেতন-ভাতায় বিশাল বৈষম্যের কথা তুলে ধরা হয়েছে প্রতিবেদনে। উদাহরণ হিসেবে দেখানো হয়েছে, সাদা বলের ক্রিকেটে ইংল্যান্ডের মেয়েদের গড় বেতন পুরুষদের বেতনের ২০.৬ ভাগ মাত্র। আন্তর্জাতিক ম্যাচের জন্য সীমিত ওভারের ক্রিকেটে নারীরা পান পুরুষের ম্যাচ ফির ২৫ ভাগ, টেস্ট ম্যাচের জন্য পান পুরুষদের ১৫ ভাগ মাত্র। বেতন কাঠামো ও আন্তর্জাতিক ম্যাচ ফিতে ভারসাম্য আনার সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।


প্রতিবেদন তৈরি করতে গিয়ে কমিশন কথা বলেছে ইংল্যান্ডের টেস্ট অধিনায়ক বেন স্টোকস, নারী দলের অধিনায়ক হিদার নাইট, সাবেক অধিনায়ক জো রুট, বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক এউইন মরগান, ইয়র্কশায়ারের সাবেক অফ স্পিনার আজিম রফিকসহ আরও অনেক ক্রিকেটারের সঙ্গে।