কাসুন রাজিতার করা ১৮তম ওভারের চতুর্থ বলটি ছিল হাতের পেছন থেকে করা স্লোয়ার। বলটি ব্যাটে খেলতে না পেরে হতাশায় চিৎকার করে ওঠেন গ্লেন ফিলিপস। পরের বলটিও ছিল ‘কার্বন কপি।’ ফিলিপস এবারও ব্যাটে খেলতে পারলেন না। ভরা গ্যালারিতে শ্রীলঙ্কার সমর্থকদের সামনেই হতাশায় হাত ছুড়লেন।
ফিলিপসের দুর্দান্ত ব্যাটিং আর ফিল্ডারদের ‘বাটার ফিঙ্গার’-এর কারণে লঙ্কান গ্যালারিতে তখন সুনসান নীরবতা। রাগ উদ্গিরণের শব্দটা তাই স্টাম্প মাইকে স্পষ্ট শোনা গেল। কিউই ব্যাটসম্যানের এমন রাগ-ক্ষোভের পেছনে ওই দুই বলে রান করতে না পারার হতাশাই শুধু নেই, ব্যাটে খেলতে পারলে সেঞ্চুরিটা যে তাঁর তখনই হয়ে যায়!
৯৩ রানে অপরাজিত থাকা ফিলিপস তিন অঙ্কে পৌঁছালেন পরের ওভারে। ১৯তম ওভারের প্রথম বলেই চার মারলেন মহীশ তিকসানাকে। পরের বলে কাভারে চালিয়ে খেলেও এল ১ রান। বাড়ল অপেক্ষা। কিন্তু বেশিক্ষণ নয়। পঞ্চম বলেই চার মেরে পৌঁছে যান তিন অঙ্কের ঘরে-সেঞ্চুরি! আনন্দে ফিলিপস যেন একটু উদ্বাহু নৃত্যও করলেন! শারীরিক ভঙ্গিটা অন্তত তেমনই ছিল।
শ্রীলঙ্কানদের তখন কাঁধ ঝুঁকে পড়েছে। ৪ ছক্কা ও ১০ চারে ৬৪ বলে ফিলিপসের ১০৪ রানের ইনিংসটির সমাপ্তি ঘটে শেষ ওভারে আউট হয়ে। আর নিউজিল্যান্ড তুলেছে ৭ উইকেটে ১৬৭। প্রতিপক্ষের সংগ্রহ খুব বেশি হয়নি, তবু লঙ্কানদের শরীরী ভাষা নেমে যাওয়ার কারণ? শ্রীলঙ্কার সমর্থকেরা তা নিশ্চয়ই ভুলে যেতে চাইবেন!
ফিলিপস ৪১ রানে ব্যাট করার সময় ১৩.২ ওভারে লং অফে তাঁর ক্যাচ নিতে পারেননি শ্রীলঙ্কা অধিনায়ক দাসুন শানাকা। তার আগে সপ্তম ওভারে ফিলিপস ১২ রানে ব্যাট করতে সেই একই জায়গায় মোয়ার মতো ক্যাচ ছাড়েন পাতুম নিশাঙ্কা। ধারাভাষ্যকার বলছিলেন, এই ক্যাচ মিসের আক্কেল সেলামি কী হতে পারে? নিউজিল্যান্ডের ইনিংস শেষে সবাই উত্তরটা জানেন।
ফিলিপস আউট হয়ে মাঠ ছাড়ার পর ভারতের সাবেক ওপেনার ওয়াসিম জাফর টুইট করেন, ‘ফেনোমেনাল নক।’ তা, কতটা ধ্বংসাত্মক-নিউজিল্যান্ডের স্কোরকার্ডেই পরিষ্কার। বাকিরা মিলে মারতে পেরেছেন মাত্র ১ ছক্কা ও ২ চার! রানের হিসাবে ফিলিপস ৬৪ বলে একাই ১০৪, আর বাকিরা মিলে ৫৯ বলে ৫৩! ‘মিস্টার এক্সট্রা’ নিউজিল্যান্ডের ইনিংসে চতুর্থ সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক (১০)।
ধারাভাষ্যকার ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাবেক পেসার ইয়ান বিশপ তাঁর টুইটে লিখেছেন, ‘সে নিজেকে দুর্দান্ত ব্যাটসম্যান হিসেবে গড়ে তুলেছে।’ এর পরের কথাটা মজার, ‘ফিল্ডিংয়ে নেমে সে কী করে, তা দেখার জন্য তর সইছে না।’ অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে অবিশ্বাস্য এক ক্যাচ নিয়েছিলেন ফিলিপস। বিশপ আজও তেমন কিছুই দেখতে চান। শুধু সেঞ্চুরিতে তাঁর মন ভরছে না! তবে সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডের (এসসিজি) দর্শকদের মন ভরেছে। ফিলিপস মাঠ ছাড়ার সময় দর্শকেরা উঠে দাঁড়িয়েছেন। তাঁদের মধ্যে শ্রীলঙ্কার সমর্থকেরাও ছিলেন।
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে এটি দ্বিতীয় সেঞ্চুরি। এর আগে বাংলাদেশের বিপক্ষে সেঞ্চুরি করেন রাইলি রুশো, এই সিডনিতেই। এই সংস্করণে ছেলেদের বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ডের দ্বিতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে সেঞ্চুরির দেখা পেলেন ফিলিপস। প্রথম কে? সেই স্মৃতি বাংলাদেশের ক্রিকেট সমর্থকেরা অন্তত ভুলে যেতে চাইবেন। ২০১২ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে পালেকেল্লেতে বাংলাদেশের বিপক্ষে ৫৮ বলে ১২৩ রানের ঝড় বইয়ে দিয়েছিলেন ব্রেন্ডন ম্যাককালাম।
নিউজিল্যান্ড প্রথম দুই ওভারের মধ্যে ২ উইকেট হারানোর চারে ব্যাটিংয়ে নামেন ফিলিপস। সেঞ্চুরি করে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের রেকর্ড বইয়ে নতুন এক নজিরও গড়েছেন ডানহাতি এই ব্যাটসম্যান। ছেলেদের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে চারে কিংবা তার নিচে নেমে সেঞ্চুরি করা প্রথম ব্যাটসম্যান ফিলিপস। তাঁর ব্যাটিংয়ের ধাঁচে একটি বিষয় পরিষ্কার-ফিলিপস যত বেশি বল খেলেন, তাঁর ইনিংস তত বেশি রানে সমৃদ্ধ হয়। প্রমাণ?
এই সেঞ্চুরির আগের ছয় ইনিংসের একটিতেও ৩০ বলও খেলতে পারেননি। এর মধ্যে বেশির ভাগ ইনিংস ছোটখাটো ‘ক্যামিও’। আছে আড়াই শ স্ট্রাইক রেটে ২৪ বলে ৬০ রানের ইনিংসও। কিন্তু গত জুলাই থেকে ইনিংসে অন্তত ৪০ বল খেললেই ফিফটি পূরণ হচ্ছে, আছে ৪১ বলে ৭৬ রানের বিস্ফোরণও। বিশপ ঠিকই বলেছেন, উইকেটে ছেলেটার ব্যাটিং দেখে চঞ্চল চড়ুই পাখির কথা মনে হলেও মাথাটা পরিষ্কার ও পরিণত হয়ে উঠছে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে।