বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ম্যাচে আজ সহ-আয়োজক যুক্তরাষ্ট্র মুখোমুখি হচ্ছে প্রতিবেশী দেশ কানাডার। প্রায় ১৮০ বছর আগে ইতিহাসের প্রথম আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচটাও খেলেছিল এই দুই দেশ। বিশ্বকাপের রঙ্গমঞ্চে এই দুই দেশের প্রথম দেখা হওয়ার লগ্নটা তাই ঐতিহাসিক নয়তো কী!
নিউইয়র্কের সেন্ট জর্জেস ক্রিকেট ক্লাবের মাঠটার এখন আর কোনো অস্তিত্বই নেই। ৩০তম স্ট্রিট ও ম্যানহাটান ব্রডওয়ের মাঝখানে এখন যেখানে ব্লুমিংডেল পার্ক, সেটিরই কোথাও একসময় এই মাঠটা ছিল। ক্রিকেট ইতিহাস নিয়ে যাঁদের আগ্রহ আছে, তাঁরা হয়তো সেখানেই তা খুঁজে বেড়ান। কেন, কী হয়েছিল লুপ্ত হয়ে যাওয়া সেই মাঠে?
ইতিহাসের প্রথম আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচ। হ্যাঁ, দুই দেশের মধ্যে প্রথম কোনো আনুষ্ঠানিক ক্রিকেট ম্যাচ এই যুক্তরাষ্ট্রেই হয়েছিল।
এই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ম্যাচ নিয়ে যেকোনো প্রচারণায় ‘ঐতিহাসিক’ কথাটা ব্যবহার করে যাচ্ছে আইসিসি। বহু ব্যবহারে জীর্ণ হয়ে যাওয়ার পরও তা চোখে বা কানে লাগছে না। ২০২৪ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচটা যে আসলেই ঐতিহাসিক। বিশ্বকাপের সহ-আয়োজক যুক্তরাষ্ট্র যাতে মুখোমুখি হচ্ছে প্রতিবেশী দেশ কানাডার। প্রায় ১৮০ বছর আগে ইতিহাসের প্রথম আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচটাও খেলেছিল এই দুই দেশ। বিশ্বকাপের রঙ্গমঞ্চে এই দুই দেশের প্রথম দেখা হওয়ার লগ্নটা তাই ঐতিহাসিক নয়তো কী! বিশ্বকাপের ফিকশ্চার করার সময় ভেবেচিন্তেই এটিকে উদ্বোধনী ম্যাচ করা হয়েছে।
ওই ম্যাচের সময়কাল ১৮৪৪ সালের ২৪ থেকে ২৬ সেপ্টেম্বর। দুই দিনের ম্যাচ হওয়ার কথা ছিল। মাঝখানে এক দিন বৃষ্টির কারণে তা তৃতীয় দিনে গড়ায়। যেটিতে কানাডা জেতে ২৩ রানে। সেই ম্যাচ দেখেছিলেন প্রায় ২০ হাজার দর্শক। ম্যাচের প্রাইজমানি ছিল ১ হাজার ডলার। সেই সময় ক্রিকেট খেলার অপরিহার্য অনুষঙ্গ হয়ে ছিল বাজি। সেই সময়ে ১ লাখ ডলারের বেশি বাজি ধরা হয়েছিল সেই ম্যাচ নিয়ে। এখনকার হিসাবে যা প্রায় ৪২ লাখ ডলার।
ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট প্রতিদ্বন্দ্বিতার সবচেয়ে বনেদি ইতিহাস হতে পারে, তবে অ্যাশেজের চেয়েও প্রাচীন অটি কাপ। এটা আবার কী, নামই শোনেননি কখনো?
বাজির অঙ্কটা চোখ কপালে তুলে দেওয়ার মতো। এমন আরও অনেক কিছুই আছে সেই ম্যাচে। সেসবে আসার আগে বাজির অংশটা সেরে নেওয়া যাক। সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ আর অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রে ক্রিকেট ছিল তুমুল জনপ্রিয়। পত্রপত্রিকাতেও নিয়মিত এর খবর ছাপা হতো। তাতে যত না খেলা, তার চেয়ে অনেক বেশি শব্দ ব্যয় করা হতো বাজি নিয়ে। যুক্তরাষ্ট্র-কানাডা ম্যাচ নিয়ে আমেরিকানদের আগ্রহের প্রমাণও আছে ওই সময়ের পত্রপত্রিকায়। যে ম্যাচটার পোশাকি নাম ছিল ইউনাইটেড স্টেটস অব আমেরিকা ভার্সাস দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ারস কানাডিয়ান প্রভিন্স।
ক্রিকেটের প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ বলেই যা ‘ঐতিহাসিক’ নয়, কারণ আছে আরও। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ম্যাচে যে দুই দেশ খেলছে, খেলাধুলার ইতিহাসে সবচেয়ে প্রাচীন প্রতিদ্বন্দ্বিতার ইতিহাসটা তাদেরই লেখা। ১৮৪৪ সালে ওই ম্যাচের ৩৩ বছর পর টেস্ট ক্রিকেটের জন্ম। ফুটবল প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ দেখেছে এর ২৮ বছর পর। সেইলিংয়ের বিখ্যাত আমেরিকান কাপও এর সাত বছরের জুনিয়র।
ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট প্রতিদ্বন্দ্বিতার সবচেয়ে বনেদি ইতিহাস হতে পারে, তবে অ্যাশেজের চেয়েও প্রাচীন অটি কাপ। এটা আবার কী, নামই শোনেননি কখনো? অটি কাপ যুক্তরাষ্ট্র-কানাডার বার্ষিক ক্রিকেট লড়াইয়ের নাম। নিউইয়র্কে দুই দল প্রথম মুখোমুখি হওয়ার পরের বছর যা হয়েছিল কানাডাতে। ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত প্রায় নিয়মিত সফর বিনিময়ের পর ১৭ বছর তা বন্ধ ছিল। ২০১১ সাল থেকে আবারও যা শুরু হয়েছে। প্রথমে শুধুই একটা দুই দিনের ম্যাচ হতো। এখন যেটির সঙ্গে যোগ হয়েছে একটি ৫০ ওভারের ম্যাচ ও দুটি টি-টোয়েন্টি।
অভিবাসী–অধ্যুষিত এখনকার যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা দলের কজন এই ইতিহাসের কথা জানেন, কে জানে! তবে যুক্তরাষ্ট্রের অধিনায়ক মনাঙ্ক প্যাটেল জানেন বলে দাবি করছেন। আগেই জানতেন, নাকি এই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আগে জেনেছেন—এই প্রশ্নের অবশ্য পরিষ্কার উত্তর পাওয়া গেল না। যুক্তরাষ্ট্র থেকে ক্রিকেট হারিয়ে যাওয়ার সুনির্দিষ্ট সময় বা কারণটা যে তাঁর জানা নেই, এটা অবশ্য স্বীকার করে নিলেন।
একেবারে সাল ধরে তো আর বলার উপায় নেই। তবে যুক্তরাষ্ট্রে ক্রিকেট যে ১৮৬০-এর দশকে শুরু গৃহযুদ্ধের বলি, এ নিয়ে ইতিহাসবিদদের সবাই একমত। ক্রিকেটকে হটিয়ে বেসবলের উত্থান সেই সময় থেকেই। ক্রিকেটে উইকেট বানাতে হয়, বড় মাঠ লাগে। বেসবলে তা না হলেও চলে। ক্রিকেট ব্যাটটা একটু গোল করে নিলেই হয়ে যায়। যুদ্ধের সময় বেসবলই তাই হয়ে ওঠে সৈন্যদের বিনোদনের মাধ্যম। ১৯০০ সাল আসতে আসতে ক্রিকেট পশ্চাৎপটে চলে যায়। ১৯০৯ সালে সে সময়ের ইম্পিরিয়াল ক্রিকেট কনফারেন্সের শুধু কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোকে সদস্যপদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত যুক্তরাষ্ট্রের ক্রিকেট কফিনে শেষ পেরেকটা পুঁতে দেয়।
আমেরিকায় খেলার অভাব নেই। বাস্কেটবল, আমেরিকান ফুটবলও অনেক জনপ্রিয়। সঙ্গে অলিম্পিকের খেলাগুলো তো আছেই। তবে আমেরিকান জনমানস থেকে ক্রিকেটকে মুছে ফেলায় বেসবলের বলতে গেলে একক ভূমিকা। এ কথা মনে রাখলে এই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ম্যাচের ভেন্যু গ্র্যান্ড প্রেইরি ক্রিকেট স্টেডিয়াম বেসবলের বিরুদ্ধে একটা বদলা এরই মধ্যে নিয়ে ফেলেছে। এই স্টেডিয়ামটা তো বেসবলেরই ছিল। মাইনর কাউন্টির দল টেক্সাস এয়ারহগসের মাঠ। ২০২০ সালে করোনা মহামারির সময় দলটি বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার সুযোগে ইউএস ক্রিকেট তা কিনে নেয়। ক্রিকেট স্টেডিয়ামে রূপ দিতে খরচ হয়েছে প্রায় ২১ মিলিয়ন ডলার। দেখতে সুন্দরই হয়েছে। ছড়িয়ে যাওয়া গ্যালারিতে একটু এলায়িত ভঙ্গি।
তবে উদ্বোধনী ম্যাচে সেই গ্যালারির ১৫ হাজার আসনেই দর্শক থাকবেন কি না, তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। দর্শক বলতে তো অভিবাসী দক্ষিণ এশিয়ানরাই। ভারত-পাকিস্তান নিয়ে তাঁদের যত আগ্রহ, যুক্তরাষ্ট্র দল নিয়ে এর ধারেকাছেও নয়। অতীতে এর প্রমাণ মিলেছে। ২০১৯ সালে ফ্লোরিডার লডারহিলে ভারত-ওয়েস্ট ইন্ডিজ ম্যাচে ১৫ হাজার ধারণক্ষমতার গ্যালারি ছিল পূর্ণ। কদিন পর একই মাঠে দেশের মাটিতে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়ানডে অভিষেক দেখতে গ্যালারিতে ছিলেন সাকল্যে ১৯ জন!
তবে বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ম্যাচ বলে কথা, দর্শক-আগ্রহ তাই বাড়তেই পারে। সঙ্গে যদি এই ম্যাচের ঐতিহাসিক তাৎপর্য জানা থাকে, তাহলে তো আরও।