‘কেমন আছ?’
সংবাদ সম্মেলনে এসেই মুখে চওড়া হাসি টেনে জানতে চাইলেন মোহাম্মদ নবী। ভাঙা ভাঙা বাংলায় তাঁর কথা শুনে সংবাদ সম্মেলনকক্ষে হাসি ছড়িয়ে পড়ল। এরপর শুরু হলো প্রশ্নোত্তর পর্ব, যেখানে নবী ঘুরেফিরে নিজ দলের বুদ্ধিদীপ্ত ক্রিকেটের কথাই বললেন। শারজায় কাল বাংলাদেশের বিপক্ষে আফগানিস্তানের ৭ উইকেটে জয়ের পেছনে যে বুদ্ধির খেলাটাই ছিল মুখ্য।
ম্যাচের আগের দিন সন্ধ্যায় উইকেট বুঝতে বাংলাদেশ দলের টিম ডিরেক্টর খালেদ মাহমুদ ও টেকনিক্যাল কনসালট্যান্ট শ্রীধরন শ্রীরাম শারজায় এসেছিলেন। উইকেট বুঝতে যেন ভুল না হয়, সে জন্যই এ বাড়তি সতর্কতা। কাল বাংলাদেশ ভাগ্যক্রমে টসও জিতেছে। অধিনায়ক সাকিব আল হাসান শারজার উইকেটকে টসের সময় ভালোই বলেছিলেন। সে জন্যই টসে জিতে তাঁর ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত। একাদশটাও গড়া হয় ভালো উইকেটের ভাবনা থেকেই।
কিন্তু ম্যাচ শুরুর পর দেখা গেল উইকেটের চরিত্র ভিন্ন। বল নিচু হচ্ছে। থেমেও আসছে, আর মুজিব-নবীর ঘূর্ণিতে খাবি খাচ্ছে বাংলাদেশ। উইকেটের চরিত্র আসলে আফগানদের ভালো জানা ছিল। জয়ের পর আফগান অধিনায়ক নবী বললেন, ‘এই উইকেটের মাটি নতুন। আর এই পিচে কেউ খেলেনি। তাই আগে বোলিং করে ভালো হয়েছে। পিচ সম্পর্কে জানার সুযোগ পেয়েছি। বুঝতে পেরেছি পিচ কেমন আচরণ করছে। সেটা কাজে লাগিয়েই আমরা দ্রুত উইকেট নিতে পেরেছি আর প্রতিপক্ষ দলকে চাপে রাখতে পেরেছি।’
আফগানিস্তান দল হিসেবে দিন দিন কত উন্নতি করছে, সেটি বোঝা গেল তাদের ব্যাটিংয়ে। বোলিংয়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার কৌশলটা আফগানিস্তানের অনেক দিনেরই। টসে জিতে আগে ব্যাট করে বোলিং দিয়েই সিংহভাগ ম্যাচ জিতেছে আফগানরা। এবারের এশিয়া কাপে সে ধারা থেকে বেরিয়ে আফগানিস্তান এখন রান তাড়া করে ম্যাচ জিতছে। প্রথমে শ্রীলঙ্কা, তারপর বাংলাদেশ—দুই টেস্ট খেলুড়ে দেশের বিপক্ষে রান তাড়ার চাপ সামলেছে নবীর দল।
অথচ এই আফগানিস্তানই আগে এলোপাতাড়ি ব্যাটিং করত। এখন সেই দলই এক রানকে দুই বানাতে মনোযোগী, গড়ছে জুটি। আর তাদের মেরে খেলার দক্ষতা তো সহজাত। ইব্রাহিম জাদরানের মতো টেস্ট ও ওয়ানডে ঘরানার ব্যাটসম্যানের তিনে খেলানোর কারণ সেটাই। নবীর ভাষায়, ‘এ জন্যই তাকে আমরা তিনে খেলাচ্ছি। সে ডেথ ওভার পর্যন্ত ইনিংসটা টেনে নিয়ে যায়। অন্যদিক থেকে আমরা বোলারদের মারতে থাকি। আমাদের প্রান্ত বদল করে খেলার মতো ব্যাটসম্যান দরকার ছিল। আজ ইব্রাহিম ঠিক সে কাজই করেছে।’
১২৭ রানের পেছনে ছুটতে গিয়ে আফগানিস্তান ৩ উইকেট হারালেও ইব্রাহিম আর কোনো ক্ষতি হতে দেননি। এক প্রান্ত ধরে রেখে আরেক প্রান্ত থেকে নাজিবুল্লাহ জাদরানকে মেরে খেলার স্বাধীনতা দিয়েছেন। নবী বলছিলেন, ‘এই উইকেট (ব্যাটিং) এতটা খারাপ ছিল না। হ্যাঁ মন্থর, ওরা আমাদের বোলারদের ওপর চড়াও হতে চেয়েছিল। যে কারণে উইকেট ছুড়ে এসেছে। আর ব্যাটিংয়ে আমরা শুরুতে বেশি উইকেট হারাইনি। চাপ হজম করে নিয়েছি। পরে প্রতি ওভারে ৯ থেকে ১০ রানও সহজে করতে পেরেছি।’
পরে নেমে মেরে খেলেছেন বাংলাদেশের মোসাদ্দেক হোসেনও। ৩১ বলে ৪৮ রান করা মোসাদ্দেকই ছিলেন বাংলাদেশ দলের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক। দিন শেষে তিনিই দলের প্রতিনিধি হয়ে এলেন সংবাদ সম্মেলনে। তাঁর দৃষ্টিতে মন্থর উইকেটে টপ অর্ডারের ব্যর্থতা আর রান কম ওঠাই বাংলাদেশের হারের কারণ, ‘এখানে ব্যাটিং করা কঠিন ছিল, বল নিচু হয়ে এসেছে। ওরা ভালো করেছে, ফলে ওদের কৃতিত্ব দিতে হবে। তবে ১০ থেকে ১৫ রান কম করেছি।’
রান তাড়ায় বাংলাদেশের গতিতেই এগোচ্ছিল আফগান ইনিংস। বাংলাদেশের বোলারদের কৃতিত্ব দিয়েছেন মোসাদ্দেক। উইকেটের সুবিধা কাজে লাগিয়ে যতক্ষণ সম্ভব ম্যাচে টিকে থাকার চেষ্টা করেছেন সাকিব-মেহেদীরা। কিন্তু দুটি বড় ওভারেই খেলা শেষ করেছে নাজিবুল্লাহ জাদরান। বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদেরও সে পরিকল্পনাই ছিল। কিন্তু সেই দুই বড় ওভার আর আসেনি। মোসাদ্দেকের ভাষায়, ‘এ জিনিস আমাদের ব্যাটিংয়ে মিসিং ছিল। আমরাও সেটা করার মতো অবস্থানে প্রায় চলে গিয়েছিলাম। তবে উইকেট হারালে কঠিন হয়ে যায়। উইকেট রাখতে পারলে ১৫ ওভার পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারতাম, তাহলে পরিস্থিতি ভিন্ন হতো। ওরা ভালো খেলেছে।’
আফগান স্পিন এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বড় বাধা ছিল। মোসাদ্দেকের এ ক্ষেত্রে সরল স্বীকারোক্তি, ‘বিশ্ব ক্রিকেটের সবাই জানে আফগানিস্তানের স্পিন আক্রমণ কতটা শক্তিশালী। সেদিক থেকে চিন্তা করলে আমাদের অমন বড় টার্ন (বাঁক) করানোর মতো বোলার নেই। রিস্ট স্পিনারও নেই। সবাই অর্থোডক্স। এভাবে বিশ্লেষণ যদি করেন, বোলারদের জন্য ম্যাচ হেরেছি, ব্যাপারটা আসলে এমন নয়। এখানে হার্ড লেংথের বল খেলা কঠিন। ১২৭ পর্যন্ত গিয়েছি, সেটি যথেষ্ট ছিল না।’
বোলিং আক্রমণ যখন এতটাই ভীতিকর, তাহলে আফগানদের বিপক্ষে টসে জিতে ব্যাটিং করার সিদ্ধান্তের কারণ কী হতে পারে? সে ব্যাখ্যাও দিয়েছেন মোসাদ্দেক, ‘রশিদ খানের বিপক্ষে যদি আপনি ব্যাটিং করেন, তাহলে আপনি চাইবেন না প্রতি ওভারে ৭ থেকে ৮ করে লাগলে রশিদ খানের বিপক্ষে খেলতে। আমি মনে করি, পুরোপুরি পরিকল্পনা অনুযায়ী ছিলাম না।’
দল দুটির দুই প্রতিনিধির কথাতেই টি-টোয়েন্টির ভাবনাটা ফুটে ওঠে। আফগানিস্তান দিন দিন মারকুটে টি-টোয়েন্টি দল থেকে ক্রিকেটীয় চাতুর্যে সাবলীল হচ্ছে। আর বাংলাদেশ? টি-টোয়েন্টির অথই সাগরে ঠাঁই পাচ্ছে না!